গোলান মালভুমি কেন এতো গুরুত্বপূর্ন

গোলান মালভুমি কেন এতো গুরুত্বপূর্ন

গোলান মালভুমি

 

সিরিয়ার গোলান মালভুমির ওপর ইসরাইলের দখলদারিত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। সিরিয়ার এই ভূখন্ড ইসরাইল জবর দখল করে রাখছে ১৯৬৭ সাল থেকে। আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায় ইসরাইলের দখলে থাকা গোলান মালভুমিকে কখনই ইসরাইলের ভ’খন্ড হিসাবে স্বীকার করেনি। জাতিসংঘের ২৪২ নম্বর প্রস্তাবে গোলানকে সিরিয়ার অংশ বলে জাতিসংঘ স্বীকৃতি প্রদান করে। সেখানে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মোতায়েন করা হয়। কিন্তু এরপরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গোলানকে ইসরাইলের অংশ বলে স্বীকৃতি প্রদান করে। 
গোলানের ওপর ইসরাইলের দখলাদারিত্বের এই স্বীকৃতি ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যে পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলতে পারে। গোলান মালভুমির অবস্থান ও ভূ কৌশলগত গুরত্বের দিক নিয়ে নতুন করে আলোচনা হচ্ছে। 
গোলান মালভুমি কোথায়  : 
দক্ষিণ পশ্চিম সিরিয়ার একটি পাথুরে মালভূমি হচ্ছে এই গোলান। এর আয়তন এক হাজার ৮০০ বর্গকিলোমিটার। ইসরাইলের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত সিরিয়ার এই অঞ্চলটির প্রায় এক হাজার ২০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ১৯৬৭ সালে আরবদের সঙ্গে ছয় দিনের যুদ্ধে দখল করে নেয় ইসরাইল।সামরিক এবং কৌশলগত কারণে গোলান মালভূমির গুরুত্ব অপরিসীম। গোলান মালভুমি থেকে সিরিয়ার ওপর পুরোপুরি নজরদারি করা সম্ভব। ইসরাইলের দখলে থাকা হারমেন পর্বতের অংশ এই মালভুমি। গোলান থেকে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক দূরত্ব মাত্র ৬০ কিলোমিটার। জর্দানের রাজধানী আম্মানের দূরত্ব মাত্র ১৩৫ কিলোমিটার। গোলানের উচু অবস্থান থেকে  দক্ষিন সিরিয়ার বেশির ভাগ এলাকার ওপর নজরদারি করা যায়। সিরিয়ার সেনাবাহিনীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য এটা একটি আদর্শ স্থান। পার্বত্য এলাকা হওয়ার কারণে সিরিয়ার সেনাবাহিনীর কোনো সম্ভাব্য আক্রমণের পথে এটি একটি প্রাকৃতিক বাধা হিসেবে কাজ করে। এছাড়া গোলান থেকে জর্ডান ও লেবাননের ওপর ইসরাইল সহজে নজরদারি করতে পারে। 
সামরিক গুরুত্ব ছাড়াও এই এলাকার সুপেয় পানির প্রধান উৎস এই মালভুমি। গোলান মালভুমি থেকে পানির প্রবাহ গ্যালিলি সাগর ও জর্ডান নদীতে গিয়ে পড়ে। ইসরাইলে ব্যবহৃত মিঠাপানির তিন ভাগের প্রায় এক ভাগ জোগান দেয় গোলান জায়গাটি চাষাবাদের জন্যও বিশেষ উপযোগী। এখানে ফল ও আঙুরের চাষ হয়, পশুপালন হয়।
কারা আছে গোলান মালভুমিতে :  
১৯৬৭ সালে ইসরাইল জায়গাটি দখল করার পর এখানকার সিরিয়ান আরব বাসিন্দারা অধিকাংশই পালিয়ে যায়। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল  যুদ্ধে সিরিয়া এটি পুনর্দখল করার চেষ্টা করেও পারে নি।
১৯৭৪ সালে ইসরাইল ও সিরিয়ার  মধ্যে এক যুদ্ধবিরতি হয়, আর ১৯৮১ সালে ইসরায়েল গোলানকে নিজের অংশ করে নেয় একতরফা ভাবে।
দখলের পর থেকেই গোলান মালভূমিতে ইসরাইলে বড় ধরনের সামরিক উপস্থিতি বজায় রেখেছে। মালভূমিটিতে বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার লোকের বসবাস।
এদের মধ্যে ২০ হাজার হলো অবৈধ দখলদারি ইহুদি যারা ইসরাইলের গড়া ৩০টি বসতি এলাকায় বাস করছে। ইসরাইল প্রতিনিয়ত আরব বা সিরিয়ানদের বসতবাড়ি দখল করে ইহুদিদের জন্য বসতি স্থাপন করছে।
ইসরাইল দখলের পরে এলাকার লোকজনকে উৎপাদিত ফসল সিরিয়াতে বিক্রি করতে বাধা দেয়। আস্তে আস্তে সাধারণ জনগণকে তাদের ইচ্ছামতো ফল-ফলাদি চাষ করার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে ইসরাইল। তারপরে আরব বা সিরিয়ানদের ওপর আরোপ করে অতিরিক্ত কর। তাদের কাছে সেচের পানি, সার ইত্যাদি বিক্রি করা হয় চড়া মূল্যে যা ইহুদিদের কাছে বিক্রি করা হয় প্রায় অর্ধেক দামে।
কিভাবে দখল হলো গোলান : 
আরব এবং ইসরাইলের মধ্যে ক্রমাগত তিক্ততা এবং সীমান্তে  ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র সংঘাতের প্রেক্ষাপটে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে সবচেয়ে  বড় সংঘাত  হয়েছিলো সিরিয়ার সাথে ইসরাইলের।  
পশ্চিমা বিশ্ব যোগাযোগ রক্ষা করে ইসরাইল আরব দেশ বিশেষ করে মিশর ও সিরিয়ার ওপর হামলা চালায়। এই যুদ্ধের  কিছুদিন আগে ইসরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের প্রধান গোপনে ওয়াশিংটন সফর করেন। তিনি আমেরিকার নেতৃত্বকে জানিয়ে ছিলেন যে ইসরাইল যুদ্ধ করতে চায়। ইসরাইলকে যুদ্ধে যাবার জন্য সবুজ সংকেত দেয় আমেরিকা।১৯৬৭ সালের জুন মাসের ২ তারিখে ইসরাইলের সামরিক কর্মকর্তারা যুদ্ধের জন্য তৈরি হয়ে যায়। হামলার শুরুতে ইসরাইল মিশরের বিমান ব্যবস্থাপনা ধ্বংস করে দেয়।  মিশরের বিমান বাহিনী শক্তিশালী থাকলেও তাদের সেনাবাহিনী ছিল দুর্বল।
১৯৬৭ সালের জুন মাসের ৫ তারিখ বিমান হামলা শুরু করে ইসরাইল। তাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল আরবদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেবে। এবং সেটি শুরু হয় মিশরকে দিয়ে।
ইসরাইল  সামরিক প্রস্তুতরি অংশ হিসেবে বছরের পর বছর ধরে আরবদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গোপন নকশা জোগাড় করেছে।
ইসরাইলের যুদ্ধ বিমানের পাইলটদের কাছে একটি বই দেয়া  হযয়েছিল, যেখানে মিশর, জর্ডান এবং সিরিয়ার বিমান ঘাটিগুলোর চিত্র ছিল।
ঘটনা প্রথমে বুঝতেই পারেনি মিশরের সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। দিন শেষে জর্ডান এবং সিরিয়ার প্রায় অধিকাংশ বিমান ঘাটি ধ্বংস করে দেয়  ইসরাইলের বিমান বাহিনী। পুরো আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চলে যায় তাদের নিয়ন্ত্রণে।
পাঁচদিনের যুদ্ধে মিশর, সিরিয়া এবং জর্ডানের সেনাবাহিনী ইসরাইলের কাছে পরাস্ত হয়। ইসরাযা গাজা উপত্যকা, মিশরের সিনাই মরুভূমি, সিরিয়ার গোলান মালভূমি এবং জর্ডানের কাছ থেকে পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেম দখল করে।
প্রথমবারের  মতো ইহুদিদের জন্য পবিত্র জেরুজালেম ইসরাইলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রনে আসে। সেখান থেকে বহু ফিলিস্তিনিকে বিতাড়িত করা হয়।  
১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর জেরুসালেম ও গোলান মালভুমি পুরোপুরি ভাবে ইসরাইলের নিয়ন্ত্রনে চলে যায়। গাজা ও পশ্চিমতীরে ইসরাইলে সৈন্য না থাকলেও প্রতিনিয়ত ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্মম নিপীড়ন ও হামলা চালানো হয়। দশকের পর দশক ধরে চলছে সংঘাত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতি নিয়ে ১৯৬৭ সালে যুদ্ধে আরব ভুমি দখল করেছিলো ইসরাইল। বিশ্ব সম্প্রদায় ইসরাইলের এই জবর দখলকে কখনো স্বীকার করেনি। কিন্তু উগ্রপন্থী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প ক্ষমতাগ্রহনের ইসরাইল জবর দখল করা ভ’খন্ডকে নিজের ভুমি বলে দাবি করছে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। জেরুসালেমকে রাজধানী ঘোষণা করেছে ইসরাইল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুতাবাসও সেখানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এবার গোলান মালভুমিকে ইসরাইলের ভূখন্ড হিসাবে ঘোষণা করা হলো। ইসরাইলকে আরব বিশ্বে ভ’কৌশলগত গুরুত্বপূর্ন স্থানটিকে ইসরাইলের পূর্ন নিয়ন্ত্রনের সুযোগ দেয়া হলো। 
একনজরে গোলান মালভুমি নিয়ে দ্বন্দ্ব 
১৯৬৭ : আরব-ইসরাইল যুদ্ধে গোলান মালভুমির নিয়ন্ত্রন গ্রহন করে ইসরাইল। 
১৯৭৩: সিরিয়া পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।
১৯৭৪ : ইসরাইল ও সিরিয়ার সৈন্য প্রত্যাহার। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মোতায়েন
১৯৮১ : ইসরাইল গোলানকে নিজের ভূখন্ড হিসাবে দাবি করে। আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়ের এই দাবি প্রত্যাখান করে। 
১৯৯৯ : গোলান নিয়ে সিরিয়া ও ইসরাইলের মধ্যে আলোচনা। 
২০০০ : এই আলোচনা বন্ধ হয়ে যায় 
২০১৩ : সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ গোলান মালভুমি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। সিরিয়া ও ইসরাইল সৈন্যদের মধ্যে গুলি বিনিময় । 
২০১৬ : ইসারইলের প্রধামন্ত্রী নেতানিয়াহু গোলানে মন্ত্রীসভার বৈঠক করেন
২০১৯ : যুক্তরাষ্ট্র গোলানকে ইসরাইলের ভ’মি হিসাবে স্বূকৃতি দেয়।