ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪২তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী:প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪২তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী:প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

প্রফেসর ড.আ.ব.ম.সাইফুল ইসলাম সিদ্দীকী

প্রফেসর ড.আ.ব.ম.সাইফুল ইসলাম সিদ্দীকী

আজ ২২ শে নভেম্বর। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪২তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। বহু চড়াই উৎড়াইয়ের মধ্য দিয়ে দেশের সপ্তম এবং স্বাধীনতার পর প্রথম সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে আত্মপ্রকাশ এর ১৯৭৯ সালের এই দিনে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব চাইতে বড় কৃতিত্ব তিন জন যোগ্য শিক্ষককে তার কর্ণধার বানাতে পেরেছে। পেয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ শত কোটী টাকার মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি। এ পর্যন্ত প্রদান করেছে মোট ২২,০০০ জনকে স্নাতকোত্তর,৬৭৬ জনকে এমফিল  এবং ৪৭৪ জনকে পিএইচডি ডিগ্রী।)

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক পটভূমিঃ   ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীনতার পর প্রথম এবং দেশের সপ্তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়।  বিশে^র কোন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্যে কোন আন্দোলন হয়েছিল কি না জানি না। কিন্তু বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার রয়েছে এক রক্তঝরা আন্দোলনের ইতিহাস। বৃটিশ আমলে বঙ্গে আরবী ইসলামী শিক্ষার উচ্চতর পঠন-পাঠনের জন্য ১৭৮০ সালে বিশিষ্ট ইসলামী শিক্ষানুরাগীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠিত হয় কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসা। ১৮৩৭ সালে সরকারী এক নির্দেশে আলীয়া মাদরাসায় বাধ্যতামূলক ইংরেজী শিক্ষার আশানুরূপ ফল না হওয়ায় ১৮৫৮ সালে কলিকাতা আলীয়া মাদরাসা বিলোপের সুপারিশ আসে। কিন্তু মুসলমানদের আন্দোলনের মুখে সে যাত্রা আলীয়া মাদরাসা নিশ্চিত বিলোপের হাত থেকে রেহাই পায়। এরপর থেকে এ উপমহাদেশে মুসলিম মনীষী ও শিক্ষাবিদগণ একটি স্বতন্ত্র ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন করতে থাকে। ১৯১৩ সালের মার্চ মাসে বগুড়া জেলার বানিয়া পাড়ায় মওলানা আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৮) কে সেক্রেটারি এবং মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (১৮৭৫-১৯৫০) কে জয়েণ্ট সেক্রেটারি করে গঠিত আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালা  আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করে। ১৯১২ সালে ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদসহ ঢাকায় একটি আবাসিক ‘মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠারও দাবী উঠে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামিক স্টাডিজ একটি বিভাগসহ প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে বহু কমিশন গঠিত হয় কিন্তু ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় ১৯৭৪ সালে মাওলানা ভাসানী সন্তোষে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেসরকারিভাবে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।

১৯৭৬ সালের ১লা ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব অনুধাবন করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। ১৯৭৭ সালের ১লা জানুয়ারী ড.এম.এ. বারীকে সভাপতি করে দ্যা ইসলামিক ইউনিভার্সিটি স্কীম’৭৭ গঠন করেন।  যার সুপারিশের আলোকে ১৯৭৯ সালে  ২২ নভেম্বর কুষ্টিয়া ঝিনাইদহ-এর মাঝামাঝি শান্তিডাঙ্গা-দুলালপুরে ১৭৫ একর জমির উপর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়। ১৯৮০ সালে জাতীয় সংসদে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এ্যাক্ট ১৯৮০/৩৭ পাশ হলে ১৯৮১ সালের ৩০ জানুয়ারী ড.মমতাজ উদ্দীন চৌধুরীকে প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ দেয়া হয়।

১৯৮২ সালের ২৮ অক্টোবর তৎকালীন লেঃ জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ১৯৮৩ সালের ১৮ জুলাইয়ের এক আদেশে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে গাজীপুরের বোর্ড বাজারে স্থানান্তর করেন। ১৯৮৫-৮৬ শিক্ষাবর্ষে  ২৮ জুন ধর্মতত্ত্ব ও ইসলামী শিক্ষা অনুষদাধীন আল-কুরআন ওয়া উলুমুল কুরআন ও উলুমুল তাওহীদ ওয়াদ দাওয়াহ বিভাগ এবং মানবিক ও সমাজ বিজ্ঞান অনুষদাধীন ব্যবস্থাপনা ও হিসাব বিজ্ঞান এ চারটি বিভাগ ৮ জন শিক্ষক এবং তিনশ’ ছাত্র নিয়ে এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। এখানে মাদ্রাসা ব্যকগ্রাউন্ড শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষার অবারিত সুযোগ প্রদান করার জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সকল বিভাগে ১০টি কোটা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। ১৯৯০ সালের ২ জানুয়ারী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে পুনরায় গাজীপুরের বোর্ড বাজার হতে কুষ্টিয়ায় স্থানান্তরের ঘোষণা দেয়। ১৯৯০-৯১ শিক্ষাবর্ষ হতে প্রথমবারের মত ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর গ্রোত্র/জাতি এবং ছাত্রী ভর্তির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

একাডেমিক কার্যক্রমঃ বর্তমানে এবিশ্ববিদ্যালয়ের ৮টি অনুষদাধীন ৩৪ টি বিভাগের মধ্যে ২২টি বিভাগে ¯স্নাতকোত্তর, এমফিল ও পিএইচডি, ইসলামিক রিচার্স ইনস্টিটিটিউটে ভাষা কোর্স ও বিএড ওএমএড কোর্স,অধিকাংশ বিভাগেই ১বছর ও ২বছর মেয়াদী ¯স্নাতকোত্তর সন্ধ্যকালীন কোর্স চালু আছে। এছাড়াও ফাযিল (¯স্নাতক) পাশ ও ৩১টি মাদ্রাসায় পরীক্ষামূলকভাবে ফাযিল ¯স্নাতক(অনার্স) কোর্স চালু করা হয়। ২০১৫ সালে ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় চালু হওয়ায় মাদ্রাসাগুলো সে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ন্যস্ত করা হয়েছে।

বর্তমান

বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮টি অনুষদাধীন ৩৪ টি বিভাগ, ৮(৫+৩) টি আবাসিক হল,একটি ইসলামিক রিচার্স ইনস্টিটিউট এবং ১টি স্কুল এন্ড কলেজ রয়েছে। বর্তমান অধ্যয়ণরত শিক্ষার্থী সংখ্যা-(বিদেশী ৩৬জনসহ)  মোট ১৪,৪৫৪ জন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ভবন ৫৫ টি। ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক সংখ্যা ৩৯৯জন। কর্মকর্তা ৪৬০ জন, সহায়ক কর্মচারী ১৩২ জন, সাধারণ কর্মচারী ১৮১জন। বর্তমান ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. শেখ আব্দুস সালাম গত ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ এ বিশ্ববিদ্যালয়ে  ১৩তম ভিসি হিসাবে যোগদান করেন।

প্রাপ্তিঃ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থানের পরেও বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এর অর্জন তুলনামূলকভাবে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইতে একেবারে কম নয়। প্রাপ্তিগুলো হলো-

১.    এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫জন প্রফেসর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি,৩জন প্রোভিসি,৬জন ট্রেজারার হিসেবে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন এবং করছেন।

২.    এ পর্যন্ত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪টি সমাবর্তন ও এবটি রজত-জয়ন্তী  উৎসব পালন  করা  হয়েছে। ১৬ বছর পর অনুষ্ঠিত ৪র্থ সমাবর্তনে দশ হাজার গ্রাজুয়েটের অংশগ্রহণ করে।

৩.    এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮টি অনুষদে ৮টি,কেন্দ্রীয়ভাবে ১টি,ইসলামিক রিচার্স ইনস্টিটিউট হতে ১টি,আল-কুরআন,আল-হাদীস,দাওয়াহ,আরবী,বাংলা,ইংরেজি এবং রাষ্ট্রনীতি বিভাগ হতে ১টি করে মোট ১৪ টি গবেষণা জার্নাল নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। 

৪.    ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২টি বিভাগ এ পর্যন্ত  প্রায় ২২,০০০ শিক্ষার্থীকে ¯স্নাতকোত্তর ডিগ্রী প্রদান করেছে।

৫.    চার শতাধিক কৃতি শিক্ষার্থী  দেশী-বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে  শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছেন।

৬.    ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রীর পাশাপাশি  ১৯৯৪-২০১৯ পর্যন্ত মাত্র ২৬ বছরে ৬৭৬ জন এম.ফিল. এবং ৪৭৪ জন পি-এইচ.ডি. মোট ১১৫০কে ডিগ্রী প্রদান করে। বর্তমানে (এম.ফিল. ২৬৫ জন+ পি-এইচ.ডি. ৩৩৮ জন) মোট ৬০৩ জন গবেষক গবেষণারত আছেন। ইতিমধ্যে বিভিন্ন অনুষদের অধীনে সহস্রধিক পিএইচডি,জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনার পঞ্চাশোর্ধ ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

প্রত্যাশাঃ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় হতে সম্পূর্ণ আলাদা আদলে গঠিত। তাই জাতির আশা ছিল অন্যান্য বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের মত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোন বিভাগের শিক্ষার্থীরা ঐশী জ্ঞানের সাথে সাধারণ শিক্ষার সমন্বয় করে ইসলাম বিষয়ে   মৌলিক ধারণাসহ বিশেষ জ্ঞান অর্জন করে দেশের সুনাগরিক হিসাবে দেশ জাতির উন্নয়নে নিবেদিত হবেন। কিন্তু এর কারিকুলাম ও সিলেবাস সে অনুযায়ী না হওয়ায় এর শিক্ষার্থীরা সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতই ডিগ্রী নিয়ে  বেরিয়ে যাচ্ছেন। এসব বিভাগে ইসলামিক স্টাডিজ  কোর্সটিও নন ক্রেডিট হওয়ায় এবং কোন কোন বিভাগে সে বিষয়ের শিক্ষক না থাকায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যহত হচ্ছে। তাই আশু প্রয়োজন হলো-

১. ইসলামী শিক্ষা সাথে আধুনিক অন্যান্য শিক্ষণ শাখাসমূহের সমন্বয় করে বিশেষ শিক্ষাচর্চার ব্যবস্থা করা। ২. স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে গবেষণা এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। ৩. ইসলামী জ্ঞান-গবেষণা এবং প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে বিশেষ অর্থ বরাদ্দসহ সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা। ৪. থিওলজী অনুষদের জন্য আলাদা ভবন নির্মাণ করা। ৫. ইসলামিক স্টাডিজ ননক্রেডিট  কোর্সটি  ক্রেডিট  কোর্স করে প্রতি বিভাগেস ইসলামিক স্টাডিজের শিক্ষকনিয়োগ দেয়া। ৬. ইসলামী শিক্ষা বিষয়ক আরো অনুষদ ও বিভাগ খোলা। ৭. গবেষকদের জন্য আবাসিক সুবিধাসহ স্কলারশীপের ব্যবস্থা করা। ৮. অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এমফিল পিএইচডিতে ভর্তি সহজিকরণ করা। ১০. মান সম্পন্ন থিসিসগুলো প্রকাশের ব্যবস্থা করা। ১১. অনুষদের ন্যায় বিভাগীয় জার্নালগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থে প্রকাশ করা। ১২. গবেষণার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে গবেষক শিক্ষকদের জন্য সম্মানজনক গবেষণা ভাতা প্রদান করা ১৩. বিশ্ববিদ্যালয় বার্তা পুণ প্রকাশ করা।  ১৪. বিশ্ববিদ্যালয়ে বার্ষিক বিবরণী প্রকাশ করা।  প্রতি অনুষদে বছরে অন্ততঃ ১টি করে আন্তর্জাতিক সেমিনারের ব্যবস্থা করা। ১৫. একাডেমিক ও হলগুলোর নাম ইসলামী ব্যক্তিত্বের নামে নামকরণ করা।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। সুদীর্ঘ সময়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কমিশনের বিভিন্ন মনীষী যেসব লক্ষ্য উদ্দেশ্যের কথা উল্লেখ করেন তা বাস্তবায়ন সময়ের দাবী।  আধুনিক শিক্ষার সাথে ইসলামী শিক্ষার সমন্বয় করে বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করাই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় মূল ধারায় ফিরে আসুক এটাই দেশ জাতির প্রত্যাশা।  

 

 লেখক : প্রফেসর আল-কুরআন এ- ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ 

 ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়,কুষ্টিয়া।

         ও লেখক

 ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় : ইতিহাস ও ঐতিহ্য,গ্রন্থ