ক্রাইস্টচার্চের হামলা ও মানবিকতা

ক্রাইস্টচার্চের হামলা ও মানবিকতা

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান


পৃথিবীতে প্রায় সব ধর্মাবলম্বীর মধ্যেই কিছু না কিছু উগ্রতা, ধর্মান্ধতা এবং অপব্যাখ্যা রয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে বর্তমানে দেশে দেশে জঙ্গিত্ব কিংবা আক্রমণাত্মক ঘটনা ঘটছে। তবে ধর্মকেন্দ্রিক সংঘটিত এসব ঘটনার আলাদা কিছু প্রেক্ষাপট রয়েছে। নিউজিল্যান্ডে ক্রাইস্টচার্চে আক্রমণকারী ব্যক্তি ব্রেনটন ট্যারেন্ট হামলা চালানোর আগেই ৭৪ পৃষ্ঠার এক বিশাল ম্যানিফেস্টো ঘোষণা করেছে। তার এই ম্যানিফেস্টোতে উল্লেখিত বিষয়গুলো পড়লে দেখা যাবে, সেখানে যেসব কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। নিউজিল্যান্ডে এ ঘটনার কারণ কেবলমাত্র  বর্ণবাদ নয়। এ হত্যাকা-ের নেপথ্যে ধর্মীয় কারণ রয়েছে। সেখানে ইসলাম বিদ্বেষ এবং অভিবাসন বিরোধী প্রচুর কথা লেখা আছে। যারা ১৬৮৩ সালের ভিয়েনা যুদ্ধ প্রতিহত করেছে, অর্থাৎ ইউরোপকে ওসমানীয়দের হাত থেকে রক্ষা করেছিল, সেসব শেতাঙ্গদের প্রশংসা করা হয়েছে। এর আগে ১১৮৯ সালে যারা এক্কা অবরোধের সময় জেরুজালেমকে মুসলমানদের হাত থেকে রক্ষা করেছিল, তাদের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। কাজেই নানাভাবেই নিউজিল্যান্ডে হামলার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। এ ধাঁচের যত ঘটনা ঘটেছে, এমনকি নরওয়ের অসলোর ঘটনায় যে কুখ্যাত গণঘাতক অ্যান্ডার্স ব্রেভিক ৭৭ জনকে হত্যা করেছিল তারও প্রশংসা করা হয়েছে। ঐ হামলাকারীও ১৫০০ পৃষ্ঠার ম্যানিফেস্টোর মাধ্যমে সামগ্রিক বিষয়ের ব্যাখ্যা তুলে ধরেছিল। ক্রাইস্টচার্চের হামলাকারী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পেরও প্রসংশা করেছেন। এই হামলার প্রেক্ষিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও বক্তব্য রেখেছেন। নিউজিল্যান্ডের দুটি মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় নিজেকে নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের বিষয়ে মিডিয়ার ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মিডিয়া এ হামলার দায়ভার তার ওপর চাপানোর ‘হাস্যকর চেষ্টা’ করছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। বর্তমানে আমরা মূলধারার মিডিয়া বলতে বিবিসি, সিএনএন, আল জাজিরা, এএফপি, রয়টার্স এর মতো মাধ্যমগুলোকেই বুঝি। যদিও এই সব মূলধারার মাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে পাল্টাপাল্টি নানা বক্তব্য রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গত নির্বাচনের সময় ভিতরে ভিতরে অনেক ঘটনাই ঘটেছে। প্রায় ১০০ এফএম রেডিও স্টেশন ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছে। এই সব রেডিও স্টেশন নিয়ন্ত্রন করত মূলত ১৫ থেকে ২২ বছর বয়সের ছেলে-মেয়েদের বিশেষ মতাদর্শিক ক্লাব। এই সব ক্লাবের কর্মকা- অনেকটাই বাংলাদেশে ছাত্র শিবিরের মতো। শিবিরের উত্থানের সময় আমরা যেমনটি লক্ষ্য করেছি, তাদের সাথীভাই, ধর্মীয় নেটওয়ার্ক থাকে। শিবিরের সাথীদের মতো আমেরিকাতেও খৃষ্টান যুবকদের সাথী সংগঠন রয়েছে। যাদের হাতে এই ১০০টির মতো এফএম রেডিওর নিয়ন্ত্রন। এই সব রেডিও ব্যবহার করে প্রচারণা চালানো হয়েছে। প্রচারণার বিষয়ই ছিল মূলত শেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্ব, ধর্মীয় ভাবাবেগ ও গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট তত্ত্ব। আফ্রিকা, এশিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত মুসলমানরা ইউরোপিয়দের জায়গা দখল করছে এবং যা কর্মসংস্থানের সমস্যা করছে। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে পশ্চিমা দুনিয়ার কিছু কিছু লোক এক পর্যায়ে বিশ্বাস করে যে,  সারাবিশ্বে  মুসলমানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যাবে। ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব হাজির বা প্রমাণ করা আর একটি লক্ষ্যণীয় বিষয়। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি প্রায় সব ধর্মের মানুষের মাঝেই দেখা যায়। এক পর্যায়ে আর কোনো ধর্ম থাকবে না, তার ধর্মই বিজয়ী হবে এবং সবাই এক ধর্মে চলে আসবে- এরকম অনেক বক্তব্য, মতামত বিভিন্নভাবে  ছড়িয়ে দেয়া হয়। আমি জানি না, ধর্ম নিয়ে এই সব কথা কোনো কিতাবে লেখা আছে কিনা। বিভিন্ন দিক থেকে বলা হয়, ধর্ম শেষ পর্যন্ত একটাই জয়ী হবে এবং বাকিগুলো পরাজিত হবে। সব মানুষ এক ধর্মের পতাকা তলে চলে আসবে। সারাবিশ্বে এক ধর্মের ঝান্ডা উড়বে। আমার মতে, বিভিন্ন ধর্মীয় উন্মদনা থেকে এই সব বলা হয়। ধর্ম সম্পর্কে এই সব বক্তব্যসমূহ আবার সামাজিক মাধ্যমসহ নানাভাবে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এই প্রবণতা কেবলমাত্র মুসলমানদের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। বিভিন্ন ধর্মের লোক তাদের নিজস্ব ধর্মীয় ব্যাখ্যায় এই সব কথা ব্যক্ত করছে। তাদের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব এবং এক সময় সব মানুষ সেই ধর্মের অধীনে চলে আসবে বোঝাতে গিয়ে নানা দৃষ্টান্তও দেখাচ্ছে। ফলে এই সবকিছুর মধ্য দিয়ে এক ধরনের ডিসকোর্স তৈরি হচ্ছে। আমাদের সমাজে সব বিষয় নির্দিষ্ট আইন-কানুন তথা নিয়মের মধ্যদিয়ে অগ্রসর হওয়া উচিত। কিন্তু যখন এর ব্যত্যয় ঘটে, তখন সমাজে হিংসা-বিদ্বেষ বেড়ে যায়। এই অবস্থায় ‘স্থানান্তরিত ক্রোধ’ সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ এক জায়গায় যখন কোনো ব্যক্তি সুবিধা করতে পারে না, তখন সে একটি প্রতিযোগিতামূলক অবস্থাকে দায়ী করে। বিষয়টি এমন যে, একজন শেতাঙ্গ হয়েও কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে পারলাম না। কিন্তু এই না পারার বহিঃপ্রকাশ ঘটে অন্যভাবে। অর্থাৎ একজন শেতাঙ্গ হয়েও কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে না পারার প্রতিবাদ সরাসরি হয়তো করে না। ফলে এই না পারার ক্ষোভ অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের উপর চাপানো চেষ্টা করা হয়। নিউজিল্যান্ডের দুটি মসজিদে সন্ত্রাসী হামলা ঘটানোর জন্য যে ব্যক্তি অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছে, তার সম্পর্কে বিস্তারিত আরও জানা যাবে। মূলত আক্রমনকারী এক ধরনের ডিপ্রেসনে ছিল। বিষয়টি এমনও হতে পারে, আক্রমণকারী সমাজ থেকে প্রাপ্ত সুবিধা থেকে বঞ্চিত। যখন মূল রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে কিছু করতে পারে না, তখন সে তার সঞ্চিত ক্ষোভ নিরীহ মানুষের উপর প্রকাশ করে। যার ফলে মসজিদে নিরীহ মানুষ নারী, শিশু, যারা নামাজ আদায় করতে গিয়েছিল, তাদের উপর গিয়ে পড়ল।এগুলোর অবশ্য মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা রয়েছে। নিউজিল্যান্ডের ঘটনার পর নেদারল্যান্ডের ইউট্রেখট শহরে যাত্রীবাহী ট্রামে হামলার ঘটনা ঘটেছে। নেদারল্যান্ড ছোট দেশ এবং লোকসংখ্যাও কম। ইউরোপের এই সব দেশে বড় ধরনের অপরাধ ঘটানোর কোনো সুযোগ নেই। ইউরোপ মহাদেশের দেশগুলো এতো উন্নয়ন করেছে যে, সেখানে এমন ঘটনা সংঘঠিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।  কিন্তু দুঃখজনক এমন শান্তিপ্রিয় উন্নত দেশেও এই সব হামলার ঘটনা ঘটছে। আর নিউজিল্যান্ডে এসব ঘটনা কল্পনাও করা যেত না।  সেখানে মানুষের সংখ্যা খুবই কম। সার্বিক পরিস্থিতি দেখে আমার মনে হলো, নিউজিল্যান্ডে পুলিশি ব্যবস্থা এক্ষেত্রে আমাদের চেয়েও দুর্বল। আমাদের দেশে ঘটনা ঘটার কয়েক মিনিটের মধ্যে পুলিশ, র‌্যাব, ফায়ার সার্ভিস সব ধরনের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। কিন্তু নিউজিল্যান্ডে ৩০-৪০ মিনিটের মধ্যে পুলিশ আসেনি। কারণ এমন ঘটনা ঘটবে, তা তাদের ধারণার মধ্যেই ছিল না। কারণ অতীত অভিজ্ঞতায় এই ধরনের ঘটনা ঘটার কোনো চিন্তা তাদের মাথায় ছিল না। নিউজিল্যান্ডে এতো মানুষের প্রাণহানির ঘটনা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আক্রমনের দৃশ্য ফেসবুকে লাইভ সম্প্রচার নিয়ে নানা কথা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সারা পৃথিবীতে সমালোচনা হচ্ছে। মানুষের জীবনে গোপনীয় বলে আর কিছুই থাকছে না। আক্রমণকারীরা অস্ট্রেলিয়া থেকে নিউজিল্যান্ডে গিয়ে ঘটনা ঘটিয়েছে। দুই দেশের মধ্যে তুলনামূলকভাবে অনেক কিছুতেই পার্থক্য রয়েছে। নিউজিল্যান্ডে ধর্মীয় উগ্রতার বিষয়গুলো ঠিক সেইভাবে ছিল না। বরং যা অস্ট্রেলিয়াতে ছিল। অস্ট্রেলিয়াতে ‘রিক্লেইম অস্ট্রেলিয়া’ নামে একটি সংগঠন রয়েছে। তারা বিভিন্ন্ ব্যানার হাতে সম্মুখে আসে এবং ঘোষণা করে ইসলাম দুনিয়ার শত্রু। তারা ২০১৫ সাল থেকে সক্রিয়। একইভাবে ‘অস্ট্রেলিয়ান লিবার্টি এ্যালায়েন্স’ নামে একটি সংগঠন এই সব কর্মকা- পরিচালনা করে। তারা স্পষ্টভাবে বলে “ইসলাম কেবল ধর্ম নয়, কর্তৃত্বপরায়ণ একটি শাসন ব্যবস্থা। এই কর্তৃত্ব কেবল নিজেদের মধ্যে নয়, তাদের একটি বৈশ্বিক অভিলাষ রয়েছে।” এখন প্রশ্ন বৈশ্বিক অভিলাষের বিষয়টি কোথা থেকে এসেছে? এর মানে সারাবিশ্ব ইসলামের নিয়ন্ত্রণে আসবে। বৈশ্বিক অভিলাষ বিষয়টি আইএস থেকে এসেছে যারা সারা বিশে^ খেলাফত কায়েমের জন্য ব্যার্থ যুদ্ধ চালাচ্ছে। যাই হোক বিষয়গুলো একটি হুমকি হিসেবে কাজ করে। যা অন্যদেরকে এগুলোর বিরুদ্ধে পাল্টা কিছু করার জন্য সংগঠিত হওয়ার জন্য আহবান করে। এই সব ঘটনার প্রেক্ষিতে আমাদের করণীয় কী হবে? এক্ষেত্রে ধর্ম একটি বড় বিষয়। কিন্তু এখানে সমস্যা হচ্ছে, যারা ধর্ম নিয়ে কাজ করে, তারা নিজেদের ধর্ম নিয়ে ব্যস্ত। ধর্মের শাশ্বত ব্যাখ্যার বাইরে গিয়ে যদি শুধুমাত্র নিজের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব, অন্য ধর্ম বাতিল-এমন বিষয় চর্চা হয়, তাহলে কাজ হবে না। যদি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৃথক পৃথক ধর্ম শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয় তাহলে ভালো ফল পাওয়া যাবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক নতুন বিভাগ খোলা হয়েছে, সেখানে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নামে কোনো বিভাগ খোলা হয়নি। কারণ তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব বিরোধীরা বলছে ইসলাম ধর্মের সাথে কোনো ধর্মের তুলনা হয় না। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগটির নাম দেয়া হয়েছে বিশ্বধর্ম। কমপেরাটিভ রিলিজিয়ন নামও দেয়া যায়নি। নাম দেয়া হয়েছে ওয়ার্ল্ড রিলিজিয়ন। কাজেই ওয়ার্ল্ড রিলিজিয়ন নামে একটি বিষয় সব স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে হবে। যেখানে ধর্ম, ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে জ্ঞান প্রদান করা হবে। এক ধর্ম যেন অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ না করে, অথবা আমারটাই ধর্ম অন্যটা ধর্মই না- এমন মনোভাব দূর করতে হবে। একজনের ধর্মবিশ্বাস অন্যজন বাতিল করা থেকে সরে আসতে হবে বরং অন্যের ধর্ম বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়েই ধর্মীয় কারণে সৃষ্ট সন্ত্রাস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অন্যের ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি কিভাবে শ্রদ্ধা জানাতে হয় তার একটি অবিস্মরনীয় দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা অ্যাডর্ণ ও সেদেশের সংখ্যাগরিষ্ট খৃস্টান জনগণ। এমনটি ভারতে বা আমেরিকায় কেউ করলে অনেকেই এটাকে ভোট টানার কৌশল হিসেবেই দেখতেন। যেদেশে জনসংখ্যার মাত্র ১.১% মুসলমান সে দেশের খৃস্টান প্রধানমন্ত্রীর এই আচরণ কেবলই মানবতা। মানব ধর্মেরই সেখানে জয় হয়েছে। আকাশ থেকে আসা সকল ধর্ম বিশ^াসীরা মানবিক হলেই ধর্মের কারণে অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি নেমে আসবে। কাজেই ধর্মীয় উগ্রতা, ধমার্ন্ধতা এবং অপব্যাখ্যার উর্ধ্বে উঠে মানবতার পরিচয় দেয়াই হোক ক্রাইস্ট চার্চের শিক্ষা। 
লেখকঃ উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।