রোহিঙ্গাদের নতুন ঠিকানা ভাসানচর

রোহিঙ্গাদের নতুন ঠিকানা ভাসানচর

রোহিঙ্গাদের ভাসচরের স্থানান্তর নিয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিরোধীতা করে আসছে শুরু থেকেই

ডা. মুহাম্মদ আব্দুস সবুর-

সম্প্রতি ১৬৪২ জন রোহিঙ্গাকে কক্সবাজারের শিবির থেকে ভাসানচরে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। এর আগে আরও ৩০০ জনের মতো রোহিঙ্গাদের সেখানে আশ্রায় দেওয়া হয়। এই রোহিঙ্গারা নৌকাযোগে মালোশিয়া বা অন্যদেশে যাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসে বেশ কয়েকদিন সাগরে ভেসে থাকার পর উদ্ধার করে ভাসানচরে প্রেরণ করা হয়।

নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার অন্তর্গত বঙ্গোপসাগরের একটি দ্বীপ ভাসানচর। পলি মাটি জমে এই চরটি জেগে ওঠে বছর ত্রিশেক আগে।  সন্দ্বীপ থেকে প্রায় ৪ মাইল ও মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় ৩৭ মাইল দূরে অবস্থিত এই দ্বীপটি এখনও মানুষের বসবাসের উপযোগী কিনা সেটা নিয়ে অনেক মহলই সন্দেহ পোষণ করেছেন।

মায়ানমারে সীমাহীন নির্যাতন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাত ও গণহত্যায় শিকার হয়ে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণের ঘটনা বিগত প্রায় ৪০ বছর ধরে চলে আসলেও ২০১৭ সালের আগস্টে ৭ লক্ষের অধিক শরণার্থী আশ্রয় নেয়। আগে থেকে থাকা ৩ লক্ষের বেশীর সাথে মিলিয়ে এখন বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় ১১ লক্ষ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর প্রায় অনুরুপ বর্বরতার শিকার হয়ে প্রায় ১ কোটি বাঙ্গালী আশ্রয় নিয়েছিল ভারতে। সেই অভিজ্ঞতার কারণে ও মানবিকতার স্বাভাবিক তাড়নাতেই বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ফিরেয়ে দেয়নি। কিন্তু প্রায় ৫ লক্ষ টেকনাফ ও উখিয়ার জনগন তাদের চাইতে দ্বিগুনের বেশী রেহিঙ্গাদের আশ্রয় দীর্ঘদিন ধরে দিতে যেয়ে সীমাহীন দূর্ভোগে পড়েছেন। বনভূমি উজাড় করে রোহিঙ্গাদের শিবির স্থাপনে পরিবেশের যেমন ক্ষতি হচ্ছে তার সাথে অপরাধ, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও মাদকের প্রসারও ঘটেছে। অপরদিকে পাহাড়ের পাদদেশে ঝড়-বৃষ্টি, গ্রীষ্ম-বর্ষা ও শীতে রোহিঙ্গারাও সীমাহীন দুর্ভোগের সাথে বাস করছেন।

লাখ খানেক রোহিাঙ্গদের সরিয়ে নিয়ে একটু ভালভাবে রাখার উদ্দেশ্যে সরকার নৌবহিনীকে দায়িত্ব দেয় ভাসানচরে বসতি গড়ার। ১৫ বর্গমাইলের এই এলাকায় ১৯ ফুট উচু করে বাঁধ নির্মান করা হয়েছে জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য। স্থাপনাগুলো ভূমি থেকে ৪ ফুট উচু করে তৈরী করা হয়েছে সম্ভাব্য পানির হাত থেকে রক্ষার প্রয়াসে। বসবাসের স্থাপনা ছাড়াও হাসপাতাল, মসজিদ, শিক্ষালয় সহ অন্যান্য স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে।

জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ভাসানচরে স্থানান্তরের বিরোধীতা করে আসছে শুরু থেকেই। তাদের শঙ্কা সমুদ্রের মাঝের এই সদ্য গঠিত দ্বীপে রোহিঙ্গারা ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। তাছাড়া তাদের ধারনা রোহিঙ্গাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে স্থানান্তর করা হচ্ছে। পক্ষান্তরে  সরকার সব সময়ই বলে আসছে ভাসানচরে নিরাপত্তার যথেষ্ঠ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আর রোহিঙ্গারা সেখানে যাচ্ছেন স্বইচ্ছায়, তাদের জোর করা হচ্ছে না। অনেকে মনে করছেন মায়ানমার সীমান্ত থেকে দূরবর্তী স্থানে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেবার ফলে তাদের মায়ানমারে প্রত্যাবাসন বিঘ্নিত হতে পারে। ১১ লক্ষের মাঝে মাত্র মাত্র ১ লক্ষ সরিয়ে নিয়ে কক্সবাজারের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সামাজিক ক্ষতি কতটুকু রোধ করা যাবে সেটি নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। 

রোহিঙ্গাদের চরম বিপদে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ যেমন বিশ্বের প্রশংসা পেয়েছে তেমন তাদের কিছু সংখ্যককে ভাসানচরে স্থানান্তর করে কিছুটা হলেও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যায় মূল সমাধান তাদের মায়ানমারে প্রত্যাবাসন, কিন্তু সেটা যে সহসা হবে না তা বোঝাই যাচ্ছে। প্রত্যাবাসনের পূর্বের সময়টুকু তারা যেন যতটা সম্ভব ভালো থাকেন তার জন্যে বাংলাদেশের সাথে বিশ্বের সবারই রয়েছে দায়িত্ব। কেননা মানুষ মানুষের জন্য।

লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও 
সম্পাদক: নিউজজোনবিডি ডট কম।