কী হচ্ছে আসামে? কতটা বিপদে পড়বে বাংলাদেশ

কী হচ্ছে আসামে? কতটা বিপদে পড়বে বাংলাদেশ

নাগরিকপঞ্জিতে নামের তালিকা দেখছে মানুষ


বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশি আসামের নাগরিকদের চূড়ান্ত নাগরিক তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি ও আসামের স্থানীয় কয়েকটি রাজনৈতিক দল অভিযোগ করে আসছিলো আসামে বিপুল সংখ্যক বাংলাভাষি বাংলাদেশি নাগরিক অবস্থান করছে। 
রাজ্যে মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে বলেও তারা অভিযোগ করে আসছিলেন। বাঙ্গালি বিতাড়নের নামে সেখানকার বাংলাভাষী মুসলমানরা বিভিন্ন সময় নির্যাতন এমনকি হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। এরমধ্যে অনেককে ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক রাখা হয়েছে। অনেককে আবার বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা হয়েছে। এখন নতুন এই চূড়ান্ত তালিকায় বাংলাভাষি হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোক নাগরিকত্ব হারিয়েছেন। 
আসামে চূড়ান্ত নাগরিক তালিকা (এনআরসি) থেকে বাদ পড়েছেন রাজ্যের প্রায় ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জন মানুষ। এই তালিকা প্রকাশের আগে এক বিবৃতিতে এনআরসি কর্তৃপক্ষ জানায়, চূড়ান্ত  তালিকায় মোট আবেদনকারী ৩ কোটি ৩০ লাখ ১৭ হাজার ৬৬১ জনের মধ্যে নাগরিক হিসেবে স্থান পেয়েছেন ৩ কোটি ১১ লাখ ২১ হাজার ৪ জন। আসাম সরকার জানিয়েছে, নানা নথিপত্র পেশ করেও যারা নিজেদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারেননি, তাদের ‘ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে’ আবেদন করার সুযোগ থাকবে। আসাম জুড়ে এই ধরনের প্রায় একশোটি ট্রাইব্যুনাল এর মধ্যেই কাজ করছে  এক সপ্তাহের ভেতর চালু করা হবে আরও একশোটি। মাস কয়েকের ভেতর মোট হাজার খানেক ট্রাইব্যুনালে বাদ পড়াদের আবেদনের শুনানি হবে। ট্রাইব্যুনালেও আবেদন ব্যর্থ হলে তাদের সুযোগ থাকবে উচ্চ  আদালতে অর্থাৎ হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার।
 তবে অনেক মানবাধিকার কর্মী ও বিশেষজ্ঞ আশঙ্কা করছেন, রাজ্যের যে সব গরিব প্রান্তিক মানুষ এতদিনেও ঠিকমতো কাগজপত্র দিতে পারেননি, বা প্রতি বছরের বন্যায় যাদের ঘরের সর্বস্ব ভেসে যায়  তারা  ট্রাইব্যুনালে বা হাইকোর্টে গিয়ে নতুন নথিপত্র পেশ করে এনআরসি-র রায় উল্টে দিতে পারবেন এমন আশা করা যায় না। অর্থাৎ প্রান্তিক পর্যায়ের বিপুল সংখ্যক অশিক্ষিত সাধারন মানুষ নাগরিকত্ব হারাবেন। এদের অনেকের পক্ষে উচ্চ আদালত পর্যন্ত মামলা পরিচালনা করার সামর্থ্য নেই। ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষ রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়বে। 
রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে থাকা এসব মানুষকে  বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর চেষ্টা হতে পারে বলে বাংলাদেশের অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। মার্কিন সাময়িকী টাইম ম্যাগাজিনের এক বিশেষ প্রতিবেদন  থেকে জানা গেছে, যারা নাগরিকত্ব হারাবেন তাদের আটক রাখতে আসামে দশটি ডিটেনশন সেন্টার বা আটক কেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। এই আটককেন্দ্রগুলোই সম্ভবত নাগরিক তালিকা থেকে বাদ পড়া মানুষদের নতুন গন্তব্য হতে চলেছে। 
আসামের নাগরিকদের এই তালিকা তৈরি পেছনে ছিলো বিজেপির আভ্যন্তরিন রাজনৈতিক কৌশল। বিজেপি সাম্প্রদায়িক বিষবাস্প ছড়ানোর জন্য দীর্ঘদিন থেকে দাবি করে আসছিলো আসামে ৪০ লাখ বিদেশি অবস্থান করছে। যাদের বেশির ভাগ বাংলাদেশি মুসলমান। তাদের দাবি ছিলো আসামের এই বিদেশিরা জনবিন্যাস পাল্টে দিচ্ছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পুর্ন বিপরীত। এই তালিকা প্রকাশের পর তার কিছুটা চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে আসাম থেকে বাংলাভাষি মুসলমান নাগরিকদের বিতাড়নের কৌশল নিয়ে বিজেপি এই দাবি করে আসছিলো। আবার এই তালিকা প্রকাশের পর এখন বিজেপি এনআরসি নিয়ে উল্টো সূরে কথা বলছে। 
বিজেপির একটি গোপন রাজনৈতিক এজেন্ডা হলো ভারতের মুসলিম জনবিন্যাস পাল্টে ফেলা। সম্প্রতি কাশ্মীরের বিশেষ অধিকার হরন করে সেখানকার স্থানীয় নাগরিকদের জমি কেনা বেচার ক্ষেত্রে যে বিধি নিষেধ ছিলো তা উঠে গেছে। ফলে কাশ্মীরে এখন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ জমি কিনতে পারবে। ধীরে ধীরে কাশ্মীরের জনবিন্যাস পাল্টে দেয়া হবে।
আসামের ক্ষেত্রে বিজেপির নীতি ছিলো বাংলাদেশি হিসাবে চিহিৃত করে আসামের প্রান্তিক মুসলিম জনগোষ্টীকে বিতাড়ন করা। এমন অনেক ব্যক্তির নাগরিক অধিকার হরন করা হয়েছে যারা ভারতের সেনা বাহিনীতে কাজ করেছেন। এমনকি কারগিল যুদ্ধে অংশ নিয়ে পদক পাওয়া মুসলিম সেনা কর্মকর্তাও রয়েছেন।  রাজ্যের আইন প্রনেতাও নাগরিকত্ব হারিয়েছেন। আবার অনেক পরিবারে বাবা, মা কিংবা স্বামীর নাম আছে কিন্তু স্ত্রী ও সন্তানদের নাম নেই। অর্থাৎ একই পরিবারের  কিছু লোক নাগরিকত্ব হারিয়েছেন, কিছু লোক পেয়েছেন। যা গুরুতর মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। আসামের চূড়ান্ত নাগরিক তালিকায় যে ১৯ লাখ লোকের নাম নেই। তার মধ্যে মুসলমানদের পাশাপাশি অনেক হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ আছে।
 এনআরসি প্রকাশের পর এখন বিজেপির নেতার এর সমালোচনা করছেন। হিন্দুরা বাদ পড়ায় বিজেপির হিন্দু জাতিয়তাবাদী আদর্শ ও নির্বাচনি অংক বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। বাঙালি হিন্দুরা আসামে বিজেপির পুরনো ভোটব্যাংক বলে পরিচিত। এই তালিকা প্রকাশের পর আসামের অর্থমন্ত্রী ও বিজেপি নেতা হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেছেন, এনআরসি বর্তমান অবস্থা নিয়ে আমরা হতাশ। 
তালিকা প্রকাশের পর আসাম অঞ্চলের প্রধান রণজিৎ কুমার এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেন, আমরা এই তালিকা বিশ্বাস করি না। আমরা খুবই অখুশি। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারকে আমরা অনুরোধ জানাই যেন জাতীয় পর্যায়ে একটি তালিকা করা হোক। আসলে বিজেপি টার্গেট করেছিলো আসামের মুসলিম নাগরিকদের। তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত না হওয়ায় এই হতাশা। 
নাগরিক তালিকা থেকে বাদ পড়া এই ২০ লাখের মতো মানুষের ধর্মীয় পরিচয় যাই হোক না কেন নাগরিক অধিকার হরন গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন। কোনো মানুষকে রাষ্ট্রহীন করা সবচেয়ে অমানবিক কাজ। আসামে বিজেপির এই তৎপরতা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যেমন উদ্বিগ্ন তেমনি আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিজেপির নেতারা খুব স্পষ্ট ভাবে বলেছেন ১৪ থেকে ১৫ লাখ বাংলাভাষিকে বাংলাদেশে ঠেলে দিতে চান। 
আসামের চূড়ান্ত নাগরিক তালিকা থেকে প্রায় ১৯ লাখ মানুষ বাদ যাওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছেন জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাই কমিশনার ফিলিপো গ্রান্ডি। এর মধ্য দিয়ে কেউ যেন রাষ্ট্রহীন না হয়ে পড়ে তা নিশ্চিত করতে ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “বিপুল সংখ্যক মানুষের জাতীয়তা হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা রয়েছে, এমন কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হলে ‘রাষ্ট্রীয় পরিচয়হীন নাগরিক’ সমস্যা সমাধানে বৈশ্বিক প্রচেষ্টা ব্যাহত হবে। এ প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত তথ্য প্রবাহ এবং আইনি সহায়তাসহ সর্বোচ্চ মানদন্ড অনুসরণের জন্য দেশটির প্রতি অনুরোধ জানান তিনি। তালিকা প্রকাশের পর রাষ্ট্রহীন এসব মানুষের সংখ্যা আসামের মোট জনসংখ্যার ৬ শতাংশ।
আসামের বিপুল সংখ্যক মানুষ নাগরিক অধিকার হারানোর ঘটনায় বাংলাদেশের মানুষ উদ্বিগ্ন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ঢাকা সফরের সময় আশ^স্ত করেছেন আসামের এনআরসি তৈরি ভারতের আভ্যন্তরিন বিষয়। এর সাথে বাংলাদেশের কোনো সর্ম্পক নেই। জয়শঙ্করের এই কূটনৈতিক বক্তব্যে বাংলাদেশের মানুষের উদ্বেগ কমেনি। কারন বিজেপির নেতারা সম্পুর্ন উল্টো সূরে কথা বলছেন। আসামের চূড়ান্ত নাগরিক তালিকা প্রকাশের  একদিন পর রাজ্যটির অর্থমন্ত্রী বিজেপি নেতা হিমন্ত  বিশ্ব শর্মা নিউজ-১৮ নামের একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন ‘১৪-১৫ লাখ বিদেশিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশকে তাদের এই ১৪-১৫ লাখ লোককে ফিরিয়ে নিতে বলা হবে।
অনেক বাংলাদেশি মনে করেন প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে যেভাবে এ দেশে ঠেলে দেয়া হয়েছে। একই ভাবে আসামের বিপুল সংখ্যক বাংলাভাষিকে এদেশে ঠেলে দেয়া হতে পারে। ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলে স্থিতিশীলতা ফিরে আনতে বাংলাদেশ সব ধরনের সহায়তা করলেও বাংলাদেশকে এখন অস্থির করে তুলতে চাইছে ভারত। শুধুমাত্র মুসলিম পরিচয়ের কারনে বিপুল সংখ্যক ভারতীয়ের নাগরিক অধিকার হরন করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে মিয়ানমার একই নীতি নিয়েছে। 
শুধু আসাম নয় বিজেপির এখন টার্গেট পশ্চিমবঙ্গ। এই রাজ্যে বিজেপি প্রভাব বিস্তারের জন্য এনআরসি তৈরির দাবি তুলছে। বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক লোক পশ্চিমবঙ্গে বসতি স্থাপন করেছে বলেও বিজেপির দাবি। যদিও পশ্চিম বঙ্গের ক্ষমতাসীন দল তৃনমুল কংগ্রেস এনআরসির সমালোচনা করেছে এবং বিজেপির রাজনৈতিক নোংরা কৌশল হিসাবে উল্লেখ করেছে। এছাড়া ভারতের আর্থসামাজিক অবস্থা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ এমন নয় যে বাংলাদেশের নাগরিকরা ভারতে গিয়ে বসবাস করবে। আসুন পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে বিজেপির নেতারা কী বলছেন
বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন ভারতের অভ্যন্তরীন নিরাপত্তার স্বার্থে ‘বাংলাদেশি মুসলমানদের’ তাড়াতে পশ্চিমবঙ্গেও নাগরিক তালিকা করা হবে। তবে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের মাধ্যমে হিন্দু শরণার্থীদের স্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট থাকবে বিজেপি। দিলীপের দাবি, ভোটব্যাংক ধরে রাখতে সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে বাংলাদেশি মুসলমানদের অনুপ্রবেশে সহায়তা করছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল কংগ্রেস। দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘আমাদের দাবি, আসামের মতো পশ্চিমবঙ্গেও নাগরিক তালিকা চালু করা হোক। তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার যদি এ কাজ করতে ইচ্ছুক না হয়, আমরা এটা কার্যকর করবো। ২০২১ সালে ক্ষমতায় এলে রাজ্য থেকে বাংলাদেশি মুসলিমদের তাড়িয়ে দেবো।’
 অপরদিকে টুইটারে দেওয়া পোস্টে আসামের নাগরিক তালিকাকে অভিসন্ধিমূলক ‘ব্যর্থ নাটকীয়তা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন মমতা বন্দোপাধ্যয়। তার দল তৃণমূলের দাবি, নাগরিক তালিকার নাম করে বাংলাভাষীদের আসাম থেকে তাড়িয়ে দিতেই এ উদ্যোগ নিয়েছে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি। টুইটে মমতা বলেন, নাগরিক তালিকা নিয়ে যারা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করেছিল, তাদের মুখোশ খুলে দিয়েছে এনআরসি। দেশকে জবাব দিতে হবে তাদের। দেশ ও সমাজের স্বার্থ পরিহার করে অসৎ উদ্দেশ্যে কাজ করলে এমনটাই ঘটে। মমতা বলেন, বাংলাভাষী ভাইবোনদের জন্য খারাপ লাগছে। জাঁতাকলে পড়ে ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে তাদের।
তৃণমূল নেতা ফিরহাদ হাকিমের অভিযোগ, আসাম থেকে বাঙালিদের তাড়াতে এনআরসি-কে হাতিয়ার করা হয়েছে। তার প্রশ্ন, ‘সরকার কী করে এতটা হীনমন্য হতে পারে যে, একটা সকালে তারা নাগরিকত্ব তালিকা প্রকাশ করলো এবং আসামের কয়েক দশকের বাসিন্দারা ঘরছাড়া  হলেন?’
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদি রাজনীতি ভারতে শুধু সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে না,  পুরো উপমহাদেশকে অস্থিতিশিল করে তুলছে। উদার, গনতান্ত্রিক রাজনীতির পরিবর্তে নিজ নাগরিকদের অধিকার হরনের রাজনীতি ভারতকে আর্ন্তজাতিক ভাবে উগ্র রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত করছে।