পাবনা অঞ্চলের সরিষা এখন দেশ ছেড়ে বিদেশে

পাবনা অঞ্চলের সরিষা এখন দেশ ছেড়ে বিদেশে

ছবি : প্রতিনিধি

দেশে উৎপাদিত সরিষার মধ্যে এক তৃতীয়াংশই উৎপাদিত হয় পাবনা অঞ্চলে। পাবনা অঞ্চলের সরিষার  গুনগতমান ভালো হওয়ায় রপ্তানিকৃত সরিষার মধ্যে এ অঞ্চলের সরিষার প্রাধান্য রয়েছে। জেলার সর্বত্রে এখন চোখ ধাঁধাঁনো সর্ষের ফুল। সমতল, অসমতল ও নদী তীরবর্তীসহ সর্বত্রে দিগন্তজোড়া অপররূপ সৌন্দর্য সরিষাক্ষেত ভরা মাঠ। চোখের দৃষ্টি সীমানা ছাড়িয়ে সর্ষের ফুলের সাথে যেন মেঘমালায় মিলে যায়। পাবনার মাঠ জুড়ে সরিষা ফুলের অপূর্ব হলুদ শোভার চোখ জুড়ানো দৃশ্য আর মন মাতানো গন্ধে প্রকৃতির সৌন্দর্য যেমন বাড়িয়ে দিয়েছে; তেমনি মৌমাছিরা মনের আনন্দে ফুল থেকে খাদ্য আহরণ করছে মনের আনন্দে। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার হলুদ স্বপ্নে বিভোর যেমন পাবনার কৃষক; তেমনি এ অঞ্চলের গুনগত মানের ভালো সরিষা কিনতে দূরদূরান্তের ব্যবসাসীরা প্রস্তুত।

শস্য আবাদে উর্ববরতায় ভরা পাবনায় এবারো সরিষার বাম্পার ফলন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পাবনা জেলার শাকসব্জির ন্যায় সরিষাও দেশের মোট চাহিদার এক তৃতীয়াংশ পূরণে ভূমিকা রাখে এবং এ অঞ্চলের সরিষা বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে বলে জানান জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিপ্তরের উপ পরিচালক মোঃ আবদুল কাদের।  

পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলার নয় উপজেলায় চলতি মৌসুমে বিভিন্ন জাতের উচ্চ ফলনশীল সরিষা ৪২ হাজার ৯শ’ মেট্রিক টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৩২ হাজার ৫শ ’ হেক্টর। যা গত বছরের চেয়ে এ বছর ৯শ’ ২০ হেক্টর বেশি। এ হিসেবে  উৎপাদনের টার্গেটের চেয়ে বেশি পরিমান সরিষা পাওয়া যাবে। আমন ধান কাটার পর ইরি-বোরো ধান রোপণের আগে জমি অলস পড়ে থাকে। এ সময়ে সরিষা চাষ করা হয়। ফলে একদিকে যেমন তেলের চাহিদা মিটিয়ে অর্থনৈতিকভাব লাভবান হয়; অন্যদিকে সরিষা কাটা জমিতে জৈব সারের ঘাটতি পূরণে বিরাট ভূমিকা রাখে।

পাবনা সদর উপজেলার বড় মটিয়াবাড়ী গ্রামের সরিষা আবাদকারী কৃষক স্বপন কুমার সরকার গত বারের চেয়ে এবার আধা বিঘা বেশি জমিতে সরিষা আবাদ করেছেন। তিনি পৌনে তিন বিঘা জমিতে উচ্চ ফলনশীল সরিষা (বারি-১৪) আবাদ করেছেন। আবাদে খরচও অন্য ফসলের চেয়ে কম। প্রতি বিঘায় ৬ থেকে সাড়ে ৬ মন সরিষা পাওয়া যায়। দামও ভালো পাওয়ায় তিনি আবাদের পরিধি বাড়াচ্ছেন বলে জানান। একই উপজেলার ধরবিলা গ্রামের কৃষক আকুব্বর হোসেন কৃষি বিভাগকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শক্রমে উচ্চ ফলনশীল সরিষা আবাদ করে খুবই লাভবান হচ্ছি। তিনি এবার ৪ বিঘা জমিতে সরিষা আবাদ করেছেন। তার প্রত্যাশা ভালো ফলনের সাথে সাথে দামও ভালো পাবেন।

সরিষার তেলের গুনাগুন বা এর উপকারিতা সম্পর্কে জানতে চাইলে পাবনা পাবনা ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (এডি) মোঃ আয়ুব হোসেন বলেন, “সরিষা  তেলের বহু ধরণের গুনাগুন আছে। তার মধ্যে বিশেষ করে ভর্তাজাতীয় খাবারে সরিষার তেলের জুড়ি নেই। সরিষার তেলে রয়েছে ১৯২৭ ক্যালরি। এক কাপ তেলে চর্বি থাকে ২১৮ গ্রাম। এর গুণ যেমন রান্নার ক্ষেত্রে রয়েছে; তেমনি প্রতিদিনের অনেক ছোটখাটো সমস্যায় এর প্রয়োগ আছে। সরিষার তেলে আছে প্রয়োজনীয় অনেক উপাদান-যা আমাদের ত্বকের জন্য খুব উপকারী।

এর মধ্যে আছে প্রোটিন, ভিটামিন ই, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ওমেগা, ফ্যাটি অ্যাসিড এবং পরিমাণমতো ভিটামিন এ। ক্ষুধার ওপর সুস্বাস্থ্য অনেকটা নির্ভর করে। পাকস্থলীর পাচক রস উদ্দীপিত করার মাধ্যমে ক্ষুধা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে সরিষার তেল।”

সরিষা তেলের গুনাগুন সম্পর্কে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পুষ্টি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ সহযোগী অধ্যাপক ডা. আজিজুল হক এ প্রতিনিধিকে বলেন,“ ব্যবহৃত সব তেলের মধ্যে সরিষার তেলই উৎকৃষ্ট। এ তেলের গুনাগুন বর্ণনা করে শেষ করা যায় না।  তবে মেশিনে ভাংগানোর চেয়ে ঘাইন ভাংগানো তেলে শত ভাগ বৈশিষ্ট বিদ্যমান থাকে। উপকারীতা সম্পর্কে ডা. আজিজুল হক বলেন, “সরিষার তেল হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করতে খুবই সহায়তা করে থাকে। রান্নায় ব্যবহৃত সরিষার তেল হার্ডের রোগের চিকিৎসা ও ঝুঁকি হ্রাস করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

তিনি বলেন, সরিষার তেল মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিডযুক্ত যা কোলেস্টেরলের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে  হ্রাস করে এবং এর ঝুঁকি হ্রাস করতে সহায়তা করে। সবচেয়ে বড় কথা হলো ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সক্ষম সরিষার তেল। ওমেগা-৩ পলিঅ্যানস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিডযুক্ত ডায়েটরি এর তুলনায় সরিষার তেল ডায়েটরি ফিস অয়েল বা কর্ণ অয়েল প্রাণীদের কোলন ক্যান্সার হ্রাস করতে খুব কার্যকর। সরিষার তেল রান্নায় স্বাদ বর্ধক হিসেবে কাজ করে। সরিষার তেল অ্যালিল আইসোথায়োসাইনেট নামক এক রসায়নিক যৌগ রয়েছে।

এই কারণেই এটি প্রতিটি খাবারের স্বাদ তুলনামূলকভাবে বাড়িয়ে তোলে। মূত্রাশয় ক্যান্সারে বাধা দেয় সরিষার তেল। শরীরের ওজন কমাতে সহায়তা করে সরিষার তেল হজমেও খুবই সাহায্যে করে। প্রদাহ হ্রাস করতে সহায়তা করে। এ তেল প্রদাহজনিত রোগের চিকিৎসার জন্য খুবই দক্ষ। ডায়েটে প্রতিদিন সরিষার তেল থাকলে তা শরীরের সংবেদনশীল স্নায়ুগুলিকে সক্রিয় করতে সহায়তা করে। প্রকৃতপক্ষে, সরিষার তেল ত্বকের জন্য সেরা হিসেবে বিবেচিত।  কারণ, এটি ত্বকের জন্য র‌্যাশ কমায়, পোকামাকড়কে ত্বক থেকে দূরে রাখে, ত্বক চকচকে এবং আরও সুন্দর ও আগের চেয়ে স্বাস্থ্যকর করে তোলে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ডিডি) মোঃ  আবদুল কাদের বলেন, গত কয়েক বছর ধরে পাবনায় সরিষা চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু তা নয়; বিশেষ করে দেশের মধ্যে বৃহত্তর পাবনা জেলায় (পাবনা ও সিরাজগঞ্জ) এক রকম সরিষা আবাদের জন্য খ্যাত। এবছর পাবনায় ৩২ হাজার ৫শ’ হেক্টর এবং সিরাজগঞ্জে ৬০ হাজার হেক্টর সরিষা আবাদের কথা ডিডি উল্লেখ করেণ। দেশের আর কোন এলাকায় এত পরিমাণ শস্য আবাদ হয় না।

শর্ট টাইমে উচ্চ ফলনশীল সরিষা আবাদ ভালো হওয়ায় গত বছরের ন্যায় এবারও বাম্পার ফলনের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। আর ফুল  থেকে মৌমাছি খাদ্য আহরণ করে বিধায় সরিষার ফলন বৃদ্ধি পায়। “আমাদের দেশের সরিষার তেল বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। সেই তেলের অংশে পাবনা ও সিরাজগঞ্জের তেলের প্রাধান্যতা রয়েছে বলে এডি উল্লেখ করেণ।