করোনার টিকা

করোনার টিকা

ডা. মুহাম্মদ আব্দুস সবুর

ডা. মুহাম্মদ আব্দুস সবুর-

কারোনার অতিমারীতে সারা পৃথিবী বিপর্যস্ত। গত বছরের ডিসেম্বরে চীনে প্রথম আবির্ভাবের পর বিগত এক বছরে এই ভাইরাস বিশ্বের ২২০ দেশে ও অঞ্চলে হামলা করেছে। যে সমস্ত দেশ প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছিল তারাও এখন দ্বিতীয় ধাক্কায় পর্যুদস্ত। কোন কোন দেশে সংক্রমণ কখনই নিয়ন্ত্রনে আনা যায়নি, যার মধ্যে রয়েছি আমরা। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে একটি কার্যকর টিকার সন্ধানে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। যুক্তরাজ্য ফাইজার ও বায়োনটেক উদ্ভাবিত টিকার জরুরী অনুমোদন প্রদান করে তার প্রয়োগ শুরু করেছে। ২৮ দিনের ব্যবধানে দুইটি টিকা ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত নিরাপত্তা প্রদান করবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে এই টিকার সংরক্ষণ ও সরবরাহের জন্য প্রয়োজন অতি শীতল অবস্থা- মাইনাস ৭০ ডিগ্রী সেলসিয়াস বা তার নীচে।

এরপর অনুমোদন পেয়েছে মডার্নার টিকা। এটিও দুই ডোজ ব্যবহার করতে হবে ২৮ দিন বা ১ মাসের ব্যবধানে। মডার্নার টিকা সংরক্ষণে প্রয়োজন মাইনাস ২০ ডিগ্রী সিলসিয়াস যা মোটামুটি সাধারণ ফ্রিজে সম্ভব। ফাইজার / বায়োনটেক প্রথম ১০ কোটির জন্য প্রতি ডোজের মূল্য নির্ধারণ করেছে ১৯.৫০ মার্কিন ডলার- বাংলাদেশী ১,৬০০ টাকা অর্থ্যাৎ দুই ডোজের দাম পড়বে ৩২০০ টাকার মত। মডার্নার টিকা প্রতি ডোজের মূল্য ধরা হয়েছে ২৫-৩৭ মার্কিন ডলার যা বাংলাদেশী টাকায় ২,১০০ থেকে ৩,১০০ অর্থ্যাৎ দুই ডোজের দাম ৪,২০০ টাকা থেকে ৬,২০০ টাকা।

এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ইসরাইল, কাতার, মেক্সিকো, সার্বিয়া, কুয়েত, চিলি ও কোস্টারিকায় করোনার টিকা প্রদান শুরু হয়েছে। মূলত: সব দেশ ফাইজার / বায়োনটেকের টিকা ব্যবহার করছে। কেউ কেউ মডার্নার টিকাও দিচ্ছে। এর বাইরে রাশিয়া স্পুটনিক ও চীন সিনোফার্ম টিকার ব্যবহার শুরু করেছে।

আমাদের দেশে যে টিকার প্রত্যাশা করা হচ্ছে সেটি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার। যুক্তরাজ্যের অনুমোদনের জন্য কাগজ-পত্র জমা দেওয়া হলেও এখনও অনুমোদন পায়নি, তবে শিঘ্রই পাবার আশা করা হচ্ছে। এই টিকাটিও দুই ডোজের ১ মাসের ব্যবধানে নিতে হবে। দাম ধরা হয়েছে ৪ মার্কিন ডলার অর্থ্যাৎ ৩৫০ বাংলাদেশী টাকা। দুই ডোজের দাম পড়বে ৭০০ টাকা।

ভারতের সিরাম ইনস্টিটিটিউট অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাটি যৌথভাবে উৎপাদন করবে। বাংলাদেশ এই টিকা পাবার প্রত্যাশা করছে। বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মা এই টিকা সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে পাবে বলে সমঝোতা স্বারকে স্বাক্ষর করেছে।

সারা পৃথিবীতেই করোনার টিকা এক মহার্ঘ বস্তু। অগ্রিম দাম দিয়ে ধনী দেশগুলো প্রস্তুতকারীদের কাছ থেকে টিকা কিনে নিচ্ছে। তাই অনুমোদন প্রাপ্ত টিকা প্রস্তুতকারীদের উৎপাদন সক্ষমতার উপর নির্ভর করছে অপেক্ষাকৃত কম ধনী দেশগুলো কবে ও কি পরিমাণে টিকা পাবে। এখন পর্যন্ত  অনুমোদন পাওয়া দুইটি টিকা অনুমোদিত হয়েছে জরুরী ভিত্তিতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখন পর্যন্ত কোন টিকাই অনুমোদন দেয়নি। এখন পর্যন্ত আমরা জানিনা এই টিকা করোনা থেকে কত সময়ের জন্য প্রতিরক্ষা দেবে। যেহেতু টিকা গ্রহণের সাথে সাথে প্রতিরক্ষা শুরু হয় না বরং প্রতিরক্ষা তৈরী হতে কিছু সময় প্রয়োজন হয়। আর যেহেতু সংক্রমণও চলছে, তাই কেউ কেউ টিকা গ্রহণের কারণে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরীর আগেই সংক্রমিত হতে পারেন।

যেহেতু করোনা ভাইরাসের বিভিন্ন পরিবর্তিত ধরণের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। আবার দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার আক্রান্ত হবার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তাই টিকা শেষ পর্যন্ত কতটা প্রতিরক্ষা প্রদান করতে পারবে সেটি নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।

কত ডোজের টিকা পাওয়া যাবে তার উপর নির্ভর করবে কারা টিকা পাবেন। সম্মুখ সারির যোদ্ধাদের প্রথম টিকা দেবার কথা চলছে। এদের সঠিকভাবে তালিকাবদ্ধ করে ঠিকমতো টিকা দেওয়া খুব সহজ হবে না। কারা টিকা প্রদান করবেন সে ব্যাপারেও সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত হয়নি। শিশু ও মহিলাদের জন্য সম্প্রসারিত টিকা প্রদানের যে কার্যক্রম চালু রয়েছে সেটা ব্যবহার করে কিংবা সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করে টিকা দেওয়া হবে সেটি নিয়ে পর্যালোচনা চলছে।

পরিশেষে বলা যায়, দেশের অধিকাংশ মানুষকে টিকার মাধ্যম প্রতিরক্ষা দেওয়া খুব সহজ হবে না, এটি বাস্তবায়িত হতে কয়েক বছরও লেগে যেতে  পারে। তাই সে পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজেকে নিরাপদ রাখাই যুক্তিযুক্ত।

লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও 
সম্পাদক: নিউজজোনবিডি ডট কম।