প্রমত্তা পদ্মার বুকজুড়ে শস্যক্ষেত আর বালুরাশি

প্রমত্তা পদ্মার বুকজুড়ে শস্যক্ষেত আর বালুরাশি

ছবি : প্রতিনিধি

প্রমত্তা পদ্মার ঐতিহ্য হারিয়ে এখন বুকজুড়ে ধুঁ ধুঁ বালু চর আর শস্যক্ষেত। পদ্মার বুক চিরে হেঁটে যাচ্ছে মানুষ। পার হচ্ছে গাড়ি-ঘোড়া, গৃহস্থরা চরাচ্ছেন গবাদি পশু। আবাদ হচ্ছে নানান জাতের ফসল।পদ্মার বুক জুড়ে চর জেগে এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মা মৃতপ্রায় নালায় রূপ নিয়েছে কুষ্টিয়ার কুঠিবাড়ি ঘেঁষে সেই কালের রাক্ষুসী পদ্মা । ঘোড়ার গাড়ি, অটোবাইক, মোটরসাইকেল আর পদব্রজে বালুরাশির মধ্যে দিয়ে পার হতে হচ্ছে পদ্মার বুকচিরে। পাবনা ও কুষ্টিয়া জেলার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত মৃত পদ্মা নদীপথে যাতায়াতের এখন এমনই যোগাযোগ মাধ্যম।

এ যেন নদী নয়। যেন বালি আর শস্য আবাদের বিস্তৃত ভূমি। পদ্মার বুকে আবাদ হচ্ছে ধান, গম, সরিষা, ভুট্টা, তিল, তিসি, বাদাম, কাউন, চিনা, কলাই, ধনিয়া, মৌরি, আলু, মরিচ, রশুন, পেঁয়াজ, বেগুন, লাউ, শিম, কপি, বাঁধাকপি, মুলা, কুমড়াসহ অরো অনেক ফসল। এরই মাঝে বিস্তৃত চর পড়ে আছে যেগুলো শুধু ধুঁ ধুঁ বালুচর।

গঙ্গার উৎপত্তি হিমালয়ের গাঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে এবং ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে। চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জে পদ্মা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। গঙ্গা দু’টি মুরশিদাবাদ জেলার গিরিয়ায় হুগলি এবং পদ্মা দু’টি বিতরণকারীতে বিভক্ত। হুগলি নদী, যা ভারতে দক্ষিণে অব্যাহত রয়েছে, এটি গঙ্গা (ঐতিহ্যগতভাবে) এবং ভাগীরথী নামেও পরিচিত। গোয়ালন্দে প্রবাহিত পদ্মা যমুনা (নিম্ন ব্রহ্মপুত্র) -এর সাথে যুক্ত হয়েছে এবং ফলস্বরূপ সংমিশ্রণটি পদ্ম নামের সাথে পূর্বদিকে চাঁদপুরে প্রবাহিত হয়েছে। এখানে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ নদী, মেঘনা পদ্মার সাথে মিলিত হয়েছে। মেঘনা হিসাবে দক্ষিণে প্রায় সোজা লাইন ধরে বঙ্গোপসাগরে শেষ হয়।

পদ্মায় সেই থৈ থৈ পানি  নেই। আছে শস্যক্ষেত, বালিরাশি।  পানির অভাবে এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মা মরা খালে পরিণত হয়েছে। নদীর পানি প্রবাহ শুকিয়ে নদী বক্ষে মাইলের পর মাইল বিরাজ করছে ধুঁ ধুঁ বালুচর। ভারতের মেরুকরণের প্রক্রিয়ার যাঁতাকলে নিঃষ্পেষিত হয়ে পদ্মা শুকিয়ে এ রুপ অবস্থা বিরাজ করছে। 

জানা গেছে, ভারতের মরুকরণ প্রক্রিয়ার ফলে শুষ্ক মওসুমে যৌবন হারিয়ে পদ্মা প্রায় পানিশূন্য হয়ে পড়ে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর অতীতের তুলনায় উদ্বেগজনক হারে নীচে নেমে যাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। পদ্মার শাখা নদীগুলোও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এখন শাখা নদীগুলোর নাম হয়েছে জোলা বা পোল।

পদ্মা নদী তীরবর্তী শানিকদিয়া এলাকার বেশ কয়েকজন বৃদ্ধ জানান, ‘ছোট বেলায় তারা ভয়াল-উত্তাল পদ্মার এপার (পশ্চিম) থেকে ওপারে (পূর্ব) তাকালে চোখে পড়তো দিগন্তছোঁয়া পানি আর পানি । আর এখন চোখে পড়ে ধুঁ-ধুঁ বালু চর। বিজলী বাতি জ্বলা জাহাজ তো দুরের কথা! পানির অভাবে পাল তোলা নৌকাও আর দেখা যায় না। ফলে পদ্মার বিস্তৃত জলসীমা ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে ও বালির চরের পরিধি বাড়ছে। ভারতের মরুকরণের কু-প্রভাবে উত্তরা লের জীব বৈচিত্র হুমকির সন্মুখীন হয়ে পড়েছে। মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ্য হচ্ছে এ অ লের কৃষক।

সরেজমিন শিলাইদহ কুঠিবাড়ি এলাকার শিলাইদহ ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, হেঁটে নদী পার হচ্ছেন স্থানীয়রাসহ  কুষ্টিয়া ও পাবনাবাসী। বিশাল বালুচর ভেঙ্গে ঘোড়ার গাড়ীতে কুষ্টিয়া থেকে পাবনা এবং পাবনা থেকে কুষ্টিয়ায়  মানুষ যাতায়াত করছেন। মোটরসাইকেলে আরোহীরা ধূলা উড়িয়ে নদীর বুক চিরে যাতায়াত করছেন নদী ও দু’পাড়ের (পাবনা-কুষ্টিয়া) তীরবর্তী মানুষ। নদী তীরবর্তী সাদিপুর গ্রামের গৃহস্থ শহীদ উদ্দিন শুকনো পদ্মার বুকে সবুজ ঘাস খাওয়াতে ২২টি গরু চরাতে যাওয়ার পথে এ প্রতিনিধিকে জানান, সেই পদ্মা কী আর আছে? নদী তীরবর্তী সাদিপুরে  যেখানে তার সাথে কথা হয়; সেখানে ছিল পদ্মার জলরাশি। আর এখন সেখানে বসতবাড়ি।  এই হচ্ছে তৎকালীন পদ্মা। যা নতুন প্রজন্মের কাছে অলৌকিক। একই গ্রামের আবেদ আলী তার এক পাল গরু-বাছুর এবং পার্শ্ববর্তী কুমিরগাড়ী-কোমরপুর গ্রামের মহব্বত আলী বিস্তৃত শুকনো পদ্মার বুকে গরু চরানোর সময় পদ্মা নদীর অনেক ইতিহাস একইভাবে বর্ণনা করছিলেন।