হেপাটাইটিস এবং তার চিকিৎসা

হেপাটাইটিস এবং তার চিকিৎসা

দেশে বছরে প্রায় ২০ হাজার মানুষ হেপাটাইটিস রোগে মারা যায়।

হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি এবং   নামে পরিচিত সংক্রামক রোগের একটি গ্রুপ। 
 
হেপাটাইটিস এ 
 
হেপাটাইটিস এ হল হেপাটাইটিস এ ভাইরাসের (HAV) কারণে হওয়া যকৃতের একটি তীব্র সংক্রামক রোগ। অনেক ক্ষেত্রেই খুব কম উপসর্গ থাকে, কিংবা কোনো উপসর্গই থাকে না, বিশেষত ছোটদের ক্ষেত্রে। যাদের মধ্যে উপসর্গ দেখা যায়, তাদের ক্ষেত্রে সংক্রমণ এবং উপসর্গের মধ্যে দুই থেকে ছয় সপ্তাহের ব্যবধান থাকে। যখন উপসর্গগুলো দেখা যায়, তখন সেগুলো সাধারণত আট সপ্তাহ স্থায়ী হয় এবং তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে: বমিভাব, বমি হওয়া, উদরাময়, হলুদ ত্বক, জ্বর এবং তলপেটে ব্যথা। প্রায় ১০–১৫% মানুষের ক্ষেত্রে প্রাথমিক সংক্রমণের পরবর্তী ছয় মাস সময়কালে উপসর্গগুলো আবার ফিরে আসে। বিরল ক্ষেত্রে যকৃতের তীব্র বিকলতা ঘটতে পারে, তবে এটা সাধারণত প্রবীণ মানুষদের বমিভাব ও বমি হওয়া, উদরাময়, হলুদ ত্বক, জ্বর এবং তলপেটে ব্যথা। 
 
চিকিৎসা : 
 
হেপাটাইটিস এ টিকা প্রতিরোধ করার জন্য কার্যকর। কিছু দেশে শিশুদের জন্য এবং আগে টিকা দেওয়া হয় নি এমন অধিকতর ঝুঁকিগ্রস্ত মানুষদের জন্য এটা নিয়মিতভাবে সুপারিশ করা হয় । এটা সারা জীবনের জন্য কার্যকর বলে মনে হয়। প্রতিরোধমূলক অন্যান্য পদক্ষেপের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হল হাত ধোওয়া এবং খাবারকে যথাযথভাবে রান্না করা। কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, প্রয়োজন অনুযায়ী বমিভাব বা উদরাময়েরজন্য বিশ্রাম ও ওষুধের পরামর্শ দেওয়া হয়। সংক্রমণগুলো সাধারণত সম্পূর্ণরূপে সেরে যায় এবং যকৃতের রোগ অব্যাহত থাকে না। যকৃতের চরম বিকলতা ঘটলে, যকৃত প্রতিস্থাপনের সাহায্যে তার চিকিৎসা করা হয়। 
 
হেপাটাইটিস বি 
 
হেপাটাইটিস বি একটি মারাত্মক সংক্রামক রোগ যা যকৃত বা লিভার কে আক্রমণ করে। হেপাটাইটিস বি ভাইরাস (HBV) এর আক্রমণে এ রোগ হয়। অনেক সময় সংক্রমণের প্রথম দিকে কোন লক্ষন প্রকাশ পায় না। তবে অনেক ক্ষেত্রে বমি বমি ভাব, চামড়া হলুদ হওয়া, ক্লান্তি, পেট ব্যাথা, প্রস্রাব হলুদ হওয়া প্রভৃতি লক্ষন দেখা যায় । সাধারনত এই লক্ষনগুলো কয়েক সপ্তাহ স্থায়ী হয় এবং কদাচিৎ লক্ষ্মণ প্রকাশ পাওয়ার পর পরিশেষে মৃত্যু হয়। সংক্রমণের পর রোগের লক্ষন প্রকাশ পেতে ৩০ থেকে ১৮০ দিন সময় লাগতে পারে। জন্মের সময় আক্রান্ত হওয়া রোগীদের প্রায় ৯০% ক্রনিক বা দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস বি তে আক্রান্ত হন যেখানে ৫ বছর বয়সের পর আক্রান্ত হওয়া রোগীদের ১০% এরও কম এতে আক্রান্ত হন। দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস বি তে আক্রান্ত রোগীদের বেশিরভাগেরই কোন প্রাথমিক লক্ষন থাকে না। যদিও এক্ষেত্রে এটি ধীরে ধীরে এটি সিরোসিস এবং যকৃতের ক্যান্সার এ রূপ নিতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী আক্রান্ত হওয়া রোগীদের প্রায় ১৫ থেকে ২৫% মৃত্যুবরণ করতে পারে। 
 
হেপাটাইটিস বি এর লক্ষণ : 
 

চোখ হলুদ হয়ে যায়, একে জন্ডিস বলে।

প্রশ্রাবের রং হলুদ হয়।

পেটে ব্যথা এবং সেই সাথে জ্বর হয়।

ক্ষুধা মন্দা এবং বমি বমি ভাব বা বমি হয়ে থাকে।

মাংসপেশি এবং হাড়ের সংযোগস্থলে ব্যথা হয়।

আক্রান্ত ব্যক্তি সবসময় অস্বস্তি অনুভব করে।

গায়ের চামরার উজ্জলতা নষ্ট হয়ে যায়। 

 
চিকিৎসা : 
 
রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেলে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া দরকার ৷ সাধারণত এর কোনো কার্যকরী চিকিৎসা নেই ৷ নিয়মিত চিকিৎসায় সুস্থ থাকা যায় কিন্তু আরোগ্য হওয়া যায় না ৷ এর মূল চিকিৎসা হলো রোগীকে পূর্ণ বিশ্রামে রাখা ৷ গ্লুকোজের সরবত খাওয়ালে উপকার পাওয়া যায় ৷ অড়হড় পাতা, ভুঁই আমলার পাতা ইত্যাদির রস খাওয়ায়ে উপকার পেয়েছেন বলেও অনেকে দাবি করেন । 
 
হেপাটাইটিস সি 
 
হেপাটাইটিস সি এক প্রকারের সংক্রমণ যা প্রধানত যকৃৎকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। হেপাটাইটিস সি ভাইরাস (এইচসিভি) এই রোগ সৃষ্টি করে। হেপাটাইটিস সি আক্রান্ত ব্যক্তির সচরাচর কোন উপসর্গ (স্বাস্থ্য সমস্যা বা তার রোগ আছে এমন কোন লক্ষণ) থাকে না। তবে দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণ যকৃতে ক্ষত এবং বেশ কয়েক বছর পর সিরোসিস সৃষ্টি করে। কোন কোন ক্ষেত্রে সিরোসিস আক্রান্ত ব্যক্তির যকৃৎ অকার্যকর, যকৃতের ক্যান্সার, বা খাদ্যনালী ও পাকস্থলীর শিরা স্ফীত হতে পারে, যার ফলে রক্তক্ষরণে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। প্রধানত শিরায় ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে রক্ত-থেকে-রক্তে সংযোগ, জীবাণু-যুক্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম, ও রক্ত সঞ্চালনের ফলে হেপাটাইটিস সি এর সংক্রমণ হয়। পৃথিবী জুড়ে আনুমানিক ১৩০-১৭০ মিলিয়ন লোক হেপাটাইটিস সি রোগে আক্রান্ত। 
 
হেপাটাইটিস সি এর লক্ষণ : 
 

মাত্র ১৫% ক্ষেত্রে হেপাটাইটিস সি তীব্র উপসর্গ সৃষ্টি করে। 

অরুচি, ক্লান্তি, বিতৃষ্ণাবোধ, পেশি বা সংযোগস্থলে ব্যথা, ও ওজন-হ্রাসসহ উপসর্গসমূহ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মৃদু ও অস্পষ্ট।

কেবল অল্প কিছু ক্ষেত্রেই তীব্র সংক্রমণের সঙ্গে জন্ডিস হয়ে থাকে।

১০-৫০% ব্যক্তির ক্ষেত্রে সংক্রমণ চিকিৎসা ছাড়াই ভাল হয়ে যায় এবং অল্প বয়সী মেয়েদের ক্ষেত্রে তা অন্যদের চেয়ে বেশি ঘটে । 

 
চিকিৎসা : 
 
সংক্রমিত ব্যক্তিদের ৫০-৮০% এর মধ্যে এইচসিভি দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণ সৃষ্টি করে। এর মধ্যে ৪০-৮০% ক্ষেত্রে চিকিৎসার মাধ্যমে রোগের উপসম হয়। বিরল ক্ষেত্রে চিকিৎসা ছাড়াই সংক্রমণ সেরে যায়। যাদের দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস সি রয়েছে তাদের উচিত অ্যালকোহল ও যকৃতের জন্য বিষাক্ত পদার্থ পরিহার করা, এবং হেপাটাইটিস এ ও হেপাটাইটিস বি এর টিকা নেয়া। সিরোসিস-এ আক্রান্ত ব্যক্তিদের যকৃতের ক্যান্সারের জন্য রয়েছে আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষা। 
 
 
হেপাটাইটিস ডি 
 
হেপাটাইটিস ডি হ্যাপাটাইটিস ডি ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট একটি রোগ, এটি একটি ছোট গোলাকৃতি খোদিত ভাইরাস। হেপাটাইটিস ডি সাবভাইরাল হিসাবে বিবেচনা করা হয় কারন এটি হেপাটাইটিস বি ভাইরাস এর উপস্থিতিতে শুধুমাত্র হতে পারে। 
 
হেপাটাইটিস ডি এর লক্ষণ ও চিকিৎসা : 
 
হেপাটাইটিস ডি এর লক্ষণ ও চিকিৎসা হেপাটাইটিস বি এর অনুরুপ । কিন্তু উচ্চ প্রাণঘাতী কারণে, তীব্র পর্যায়ে আরো আক্রমনাত্মক থেরাপিউটিক পদ্ধতির সুপারিশ করা হয় । 
 
হেপাটাইটিস ই 
 
হেপাটাইটিস ই এক প্রকারের সংক্রমণ যা প্রধানত যকৃৎকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। হেপাটাইটিস ই ভাইরাস এই রোগ সৃষ্টি করে। এই রোগ মল-মুখ মাধ্যমে ছড়ায়। সাধারণত সংক্রামিত খাদ্য বা জল-এর মাধ্যমে এই রোগ এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তি-তে ছড়িয়ে পড়ে। 
 
হেপাটাইটিস ই এর লক্ষণ : 
 

জ্বর 

অবসাদ 

ক্ষুধামান্দ্য 

বমি বমি ভাব ও বমি

পেট ব্যথা 

চিকিৎসা : 
 
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হেপাটাইটিস ই প্রায় ৪-৬ সপ্তাহে চলে যায়। বিশ্রাম করুন, স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করুন, অনেক পানি পান করুন, অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন।
  
সংগৃহীত ও সংকলিত:  পিয়ারলেস হসপিটাল, নওগাঁ।