তরুণ লেখকদের যত্ন নেয়া দরকার

তরুণ লেখকদের যত্ন নেয়া দরকার

আবু জাফর

তরুণ সমাজ যে কোন দেশের প্রধান সম্পদ হতে পারে। আজকের তরুণরাই আগামী বিশ্বের নেতৃত্ব দিবে এটাই স্বাভাবিক, এটাই হওয়ার কথা। যত যোগ্য ও দক্ষ নাগরিক তৈরি হবে ততই আগামী সুন্দর হয়ে গড়ে উঠবে। কিন্তু স্বদেশের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পারি বিভিন্ন নেশা ও বেকারত্বের অভিশাপে কুড়ে-কুড়ে খাচ্ছে তরুণ সমাজ কে।

 তাদের কেউ কেউ স্বদেশ থেকে পা দিচ্ছেন প্রবাস জীবনে। যাদের অধিকাংশই তরুণ, তাছাড়া একটু ভালো পড়াশোনা করলেই লুফে নিচ্ছে বিদেশি নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তির সুযোগ। ১৪ থেকে ৩০ বয়সটা তরুণ, যখন মানুষ তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল সময় পার করে। কারন তার ক্ষেত্র বিশেষে শিশুদের মত আনন্দ করতে বাঁধা তেমনি বড় মানুষের মত কোন সিদ্ধান্তও দিতে পারে না। লেখালেখি করে বিশ্বের অনেক লেখক-লেখিকাই আয় করছেন কোটি কোটি ডলার, হচ্ছেন জেমস পিটারসন, জন গ্রিনের বা জেফ কিনের মত জগত বিখ্যাত লেখক। কিন্তু আমাদের দেশে

লেখা পেশা হিসেবে নেওয়া দূরের কথা তাদের তেমন কোন স্বীকৃতিও দেওয়া হয় না যা দুঃখের বিষয়। বিশেষত তরুণ লেখকদের প্রতি যথেষ্ট যত্ন ও উৎসাহের অভাব। তরুণদের মধ্যে এখন অনেকেই খুব ভালো লিখছেন। অনেক বয়স্ক লেখকের চেয়েও তাদেরকে সচেতন মনে হয়। তাদেরকে পরামর্শ দেওয়ার দরকার আছে বলে মনে হয়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মানুষের চিন্তায় পরিবর্তন আসে। তাদের লেখা শামসুর রাহমান বা আল মাহমুদের মতো হবে না। রবীন্দ্রন-নজরুল দুজনে দুই রকমের কবিতা লিখেছেন। বুদ্ধদেব বসু, অমীয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে- তারাও তাদের মতো করে আলাদা আলাদা কবিতা লিখেছেন। যে কোনো তরুণের উচিত তার নিজের মতো করে লেখা, যে লেখাটি আগে কেউ লেখেনি। তার লেখাটি তার মতোই হবে।

এটাই একজন প্রকৃত লেখকের কাজ। অনেক তরুণ লেখককে বয়স্ক লেখকদের চেয়ে সচেতনভাবে লিখতে দেখা যায়। নতুন প্রজন্মের যারা ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করছে তারা অনুবাদের দিকে ঝুঁকলে হয়তো আমাদের দেশের সাহিত্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেতে পারে। আমাদের অনেক বড় বড় লেখক আছেন। বিশ্বমানের অনেক লেখাও হয়েছে। কিছু বই অনুবাদও হয়েছে। শুধু অনুবাদের ভাষার দুর্বলতার কারণে সেটা দেশের বাইরে সমাদ্রিত হচ্ছে না।

 হাজার বছর পরে এদেশের স্বাধীনতা অর্জন হয়। যার বীজ নিহিত আছে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে। আর এই আন্দোলনের মূলে ছিল একদল লেখক গোষ্ঠী। যারা তাদের জীবন বাজি রেখে লিখে গিয়েছিল স্বদেশের পক্ষে। যাদের কারণে দেশ পেয়েছি, স্বাধীনতা পেয়েছি, সেই জহির রায়হান, শহীদুল্লাহ কায়সাররা কি শুধু জন্ম আর মৃত্যুর দিনই স্বরণ হবে? তাহলে আমদের চেয়ে অকৃতজ্ঞ জাতি আর কারা হতে পারে? তাদের রেখে যাওয়া জীবন-দর্শন তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। আর যারা চর্চা করছে তাদেরও যত্ন নিতে হবে।

 কারন তরুণরাই পারবে সমকালীন মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, তুলে আনতেন। বর্তমানে তরুণ লেখকদের মধ্যে সাদাত হোসাইন আর কিঙ্কররা পাঠকপ্রিয়তা পাচ্ছে যা আশার আলে দেখায়। কিন্তু বড় বিষয় হল তাদের পরিচর্যা করার মানসিকতা দেশের মানুষের থাকতে হবে। নয়তো জহির-কায়সার- হুমায়ুন আহমেদহীন এদেশের লেখক শূন্যতা আজীবন পূরণ হবে না। বাংলাদেশে সারা বছর যেসব বই প্রকাশিত হয়, তার মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ ভাগই তরুণ এবং নবীন লেখকদের৷ বিশেষ করে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় তরুণ লেখকদের বই প্রকাশের আগ্রহই বেশি৷

শুধু প্রতিষ্ঠিত লেখকদের লেখা ছাপলে তো তা বিক্রি এমনিতেই হবে৷ তাহলে প্রকাশকের কৃতিত্ব কোথায়? বর্তমান তরুণ লেখকদের প্রচলিত গল্প, উপন্যাস আর কবিতার যে ঐতিহ্যগত ধারা, তা থেকেও বেরিয়ে আসার প্রবণতা স্পষ্ট৷ ফিকশন থেকে নন-ফিকশন ধারার দিকে ঝোঁক বাড়ছে। তরুণদের নতুন একটি জায়গা করে নিতে হবে৷ তাদের নিজস্বতা থাকতে হবে৷ ভিন্ন স্বাদ দিতে হবে পাঠকদের৷ চিন্তায় নতুনত্ব আনতে হবে৷ ২০০৮ সাল থেকে কালি ও কলম পুরস্কারটি প্রদান করা হচ্ছে যা তরুণ কবি ও লেখকদের। শিল্প ও সাহিত্যবিষয়ক পত্রিকা কালি ও কলম-এর মত আরো পুরুষ্কার চালু করা সময়ের দাবি।

 বই মেলাতেও নিয়মিত গুরুত্ব পাক তরুণ লেখকরা। লেখালেখির জন্য যে বিস্তর জ্ঞানের দরকার হয় তার জন্য চাই মুক্ত মন ও জ্ঞনাচর্চার সুযোগ। তবে আমরা দেখতে পাই খোদ রাজধানীতেই বড় বড় ২৩টি পাঠাগার থাকলেও তা নেমে এখন ৭টিতে এসেছে৷ দুই সিটিতে কাগজে-কলমে সরকারি ২৩টি ব্যায়ামাগার থাকলেও নেই প্রশিক্ষক, শরীরচর্চার সরঞ্জাম ও পরিবেশের অভাবে কর্পোরেট জিমনেশিয়াম জায়গা দখল করে নিয়েছে এগুলোর। রাজধানীর ১৯টি খেলার মাঠের মধ্যে ৮টি কোনোমতে টিকে আছে। কিন্তু দেখা মিলে, গড়ে উঠেছে প্রচুর স্নুকার ও বিলিয়ার্ড ক্লাব৷ আছে সাইবার ক্যাফে-ফাস্টফুড আর ফুডকোর্টের আধিক্য৷ ৷

এছাড়া শহরজুড়ে পাড়ায় পাড়ায় রয়েছে ভিডিও গেমের ব্যবসা৷ শপিংমল গুলোতে গড়ে উঠছে সিনেপ্লেক্স৷ অভিজাত এলাকায় বিলিয়ার্ড ও স্নুকার ক্লাবের পরিবেশ নিয়েও নানা কথা আছে৷ শিশা বার আর আয়েশি ধূমপানের ডুবে যাচ্ছে তরুণরা। এমন এক নাজুক পরিস্থিতিতে একদল তরুণ লেখককে দেখা যাচ্ছে প্রায়শই পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত কলাম-ফিচার লিখছে। তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

তাদের বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম নামক সংগঠনও আছে। তাদের সারাদেশে ১৩ টি পূর্ণাঙ্গ শাখা ও ৪টি আহ্বায়ক শাখাসহ  মোট ১৭টি শাখা রয়েছে, সদ্যস সংখ্যা সহস্র ছাড়িয়েছে। তাদের লেখা ফিচার-কলাম আর চিঠিগুলো নিয়মিতই পত্রিকায় প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু সরেজমিনে দেখা যায় তাদের তেমন কোন যত্ন বা গুরুত্ব কিছুই দেয়া হয় না। এখনকার মোবাইল ফোন, ফেসবুক, ইউটিউবে ভার্চুয়াল জগতের বাসিন্দা হওয়ার চেয়ে, দেশমাতৃকার নানা সম্যসা-সমাধান ও সম্ভাবনা নিয়ে নিয়ে লিখা এসব তরুণদের গুরুত্ব দেয়া এখন সময়ের দাবি। নইলে সময়ের আবর্তনে তারাও নিরুৎসাহিত হয়ে ঝরে পরবে। বাংলাদেশ হারাবে তার সম্পদ কে, পত্রিকাগুলোও ভরে উঠবে অপরিপক্ক লেখাতে।

আবু জাফর : অর্থ সম্পাদক, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, কুবি ইউনিট ।

abujafor295610@gmail.com