মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের প্রতিবাদ জানালো চিকিৎসকরা

মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের প্রতিবাদ জানালো চিকিৎসকরা

ছবি : বিবিসি

মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের তৃতীয় দিনে ধীরে ধীরে বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতিবাদ দেখা যাচ্ছে। দেশটির বড় শহরগুলোর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের চিকিৎসক, ফিজিশিয়ানসহ সেবাকর্মীরা শান্তিপূর্ণভাবে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

সেনা শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অংশ হিসেবে অনেকেই তাদের চাকরি ছেড়েছেন। অনেক চিকিৎসক রোগীর কথা বিবেচনায় নিয়ে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও তারা জান্তা সরকারের নতুন মন্ত্রীসভাকে স্বীকৃতি দেবে না বলে জানিয়েছেন। একই সাথে তারা রেড রিবন মুভমেন্ট মিয়ানমার ২০২০ নামে কর্মসূচীও ঘোষণা করেছে।

অনলাইন কিংবা অফলাইনে এই কর্মসূচীর সাথে একাত্মতা জানিয়েছে ইয়াঙ্গনের বাসিন্দারাও। তারা নিজেদের প্রোফাইল পিকচার বদলে লাল করেছে কিংবা তিন আঙুল দিয়ে স্যালুট দিয়েছে। এই কর্মসূচীটি মূলত সামরিক বাহিনীর সাথে সম্পর্কিত ব্যবসা এবং সেবা পরিহার কর্মসূচী।

এছাড়া বাসিন্দারা রাতে মোমবাতি জ্বালানো, রান্নার পাত্র এবং গাড়ির হর্ন বাজিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে ধাতব বালতি বাজানোর মাধ্যমে শয়তানের আত্মা তাড়ানোর প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

অনেক এমপিকে নেপিডোতে মিউনিসিপাল বা সরকারি অতিথি ভবনে আটকে রাখা হলেও মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তাদেরকে বাড়ি ফিরে যেতে বলা হয়। তবে সেনা অভ্যুত্থানকে স্বীকৃতি না দেয়ার কারণে অনেক এনএলডির এমপিই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।কিন্তু সরকারি অতিথি ভবন ছেড়ে যেতে এই এমপিদের ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়ে নোটিশ দিয়েছে সামরিক বাহিনী।

জাতিসংঘে চীনের বিরোধিতা

মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের আনা নিন্দা প্রস্তাব আটকে দিয়েছে চীন।সোমবার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা নেয় এবং অং সান সু চিসহ কয়েকশ শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করে।এর পর থেকে দেশটিতে সেনা অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে থাকা কর্মকর্তারা একটি সুপ্রিম কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করেছে যা মন্ত্রীসভার উপরে থাকবে।মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় শহর ইয়াঙ্গনে যদিও প্রতিরোধ এবং বেসামরিক নাগরিকদের অসন্তোষ বাড়তে শুরু করেছে।মঙ্গলবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ বৈঠকে বসে কিন্তু চীনের সমর্থন না করায় তারা কোন যৌথ বিবৃতি দিতে পারেনি।

যৌথ বিবৃতি দিতে হলে চীনের সমর্থন দরকার কারণ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ার কারণে ভেটো দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে চীনের।বৈঠকের আগে মিয়ানমারে থাকা জাতিসংঘের বিশেষ দূত ক্রিস্টিন শ্রেনার সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা নেয়ার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান। গত নভেম্বরের নির্বাচনের ফলাফল সামরিক বাহিনী মেনে নিতে অসম্মতি জানানোর পর এই অভ্যুত্থান ঘটলো।তিনি বলেন, এটা পরিষ্কার যে, "নির্বাচনের ফলে সু চির দলের জন্য বিপুল ব্যবধানে জয় নিশ্চিত হয়েছিল।"

জাতিসংঘের পদক্ষেপ কেন রুখে দিল চীন?

ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এলিয়ট প্রাসে-ফ্রিম্যান বিবিসিকে বলেন, "গ্যাসলাইটিং বা পেছন থেকে নিয়ামক হিসেবে কাজ করার মতোই এই বৈদেশিক নীতির মাধ্যমে জেনারেলদেরকে চীন স্পষ্ট করে না হলেও জোরালো সমর্থনের আভাস দিচ্ছে।""চীন এমনভাবে আগাচ্ছে যে মনে হচ্ছে, এটা পুরোপুরি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় যাতে 'মন্ত্রীসভায় রদবদল' দেখা যাচ্ছে। অন্তত চীনের রাষ্ট্রীয় মাধ্যম এভাবেই বিষয়টিকে চিত্রিত করছে।"

যদিও জাতিসংঘের এই বিবৃতি তাৎক্ষনিকভাবে কোন ফল বয়ে আনবে না ,তারপরও এটা "আন্তর্জাতিক সুসংহত প্রতিক্রিয়ার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য হবে। যা আপাতত আসছে না বলে মনে হচ্ছে।"দ্য ডিপ্লোম্যাটের লেখক এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিষয়ক সম্পাদক সেবাস্টিয়ান স্ট্রাংগিও বিবিসিকে বলেন, "আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ নিয়ে চীনের সন্দেহ প্রবণতার সাথে তাদের বর্তমান অবস্থান খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ।"

গত কয়েক দিন ধরে চীন বলে আসছে যে, নিষেধাজ্ঞা কিংবা আন্তর্জাতিক চাপ পুরো পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করবে।পশ্চিমা বিশ্ব মিয়ানমারকে দূরে ঠেলে রাখার বিষয়টি থেকে কৌশলগত ভাবে সুযোগ নেয় চীন। তার মানে এই নয় যে সেনা অভ্যুত্থানে চীন খুশি, বলেন সেবাস্টিয়ান স্ট্রাংগিও।

"এনএলডির সাথে তাদের বেশ ভাল বন্দোবস্ত করা ছিল এবং অং সান সু চির সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য তারা অনেক বিনিয়োগও করেছে। সামরিক বাহিনীর ফিরে আসা মানে হচ্ছে চীনকে নতুন করে মিয়ানমারের এই প্রতিষ্ঠানটির সাথে কাজ করবে হবে। এরা ঐতিহাসিকভাবেই চীনের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান।"

অং সান সু চি কোথায়?

অং সান সু চি যিনি নির্বাচিত সরকারের প্রধান ছিলেন তাকে সোমবার সকালে সামরিক বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর আর দেখা যায়নি।তবে তাকে নেপিডোতে তার বাসভবনে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।আরো অনেকেই আটক রয়েছেন যার মধ্যে প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট, তার দলের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা এবং তার ব্যক্তিগত অ্যাটর্নি। তাদেরকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

মঙ্গলবার সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি-এনএলডি তাকে অবিলম্বে মুক্তি দেয়ার দাবি জানিয়েছে। তারা সামরিক বাহিনীকে গত নভেম্বরের নির্বাচনের ফল মেনে নেয়ার আহ্বান জানায়। ওই নির্বাচনে এনএলডি ৮০% ভোট পায়।

এরমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে যে তারা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছে এবং ক্ষমতা নেয়ার বিষয়টিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সেনা অভ্যুত্থান হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এর মানে হচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি বর্তমান সরকারকে সহায়তা করতে পারবে না, যদিও এর বেশিরভাগ সহায়তাই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে যায়।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যরাও ক্ষমতা দখলের ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে।মিয়ানমার, যেটি বার্মা নামেও পরিচিত, সেটিকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সামরিক বাহিনী শাসন করেছে।এদিকে মঙ্গলবার মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর মালিকানাধীন টেলিভিশন নেটওয়ার্কের পেইজটি বন্ধ করে দিয়েছে ফেসবুক।এদিকে রাখাইন ও দক্ষিণের শিন রাজ্যে দোসরা ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতের পর ইন্টারনেট ও ফোরজি টেলি যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

মিয়ানমারের পরিস্থিতি কী?

সেনাপ্রধান মিন অং লাইংয়ের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছে। অর্থ, স্বাস্থ্য, স্বরাষ্ট্র এবং পররাষ্ট্রসহ ১১ জন মন্ত্রী ও ডেপুটির পদে রদবদল করা হয়।মঙ্গলবার তার মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকে মিন অং লাইং আবারো বলেন যে, ক্ষমতা নেয়াটা "অনিবার্য" হয়ে পড়েছিল।সেনা অভ্যুত্থানের পর পর দেশটি শান্তই ছিল। সব বড় শহরগুলোর রাস্তায় টহল দিয়েছে সেনারা। রাতে জারি করা হয়েছিল কারফিউও।মিয়ানমারে সেনা শাসনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। অনেক বাসিন্দা এখনো আগের সেনা অভ্যুত্থানের ভয়ঙ্কর স্মৃতি এখনো ভুলতে পারেনি।কিন্তু মঙ্গলবার সন্ধ্যায় গাড়ির হর্ন এবং রান্নার হাড়ি বাজিয়ে ইয়াঙ্গনের রাস্তায় প্রতিবাদ জানায় স্থানীয়রা।

অ্যাক্টিভিস্ট গ্রুপগুলোও নাগরিক প্রতিরোধ কার্যক্রমের ডাক দিয়েছে। তারা ফেসবুকে একটি গ্রুপ তৈরি করে তাদের প্রচেষ্টাকে সংঘবদ্ধ করার চেষ্টা করছে।অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এবং সু চির মুক্তির দাবিতে ৭০টি হাসপাতাল ও মেডিকেল বিভাগের কর্মীরা কাজ বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে।

এক নজরে মিয়ানমার

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ মিয়ানমার যার জনসংখ্যা ৫ কোটি ৪০ লাখ। বাংলাদেশ, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড এবং লাওসের সাথে সীমান্ত রয়েছে মিয়ানমারের।

১৯৬২ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সামরিক সরকার শাসন করেছে দেশটি। যার কারণে নিন্দা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছে দেশটি।গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবিতে বছরের পর বছর ধরে প্রচারণা চালিয়ে এসেছেন অং সান সু চি। ২০১০ সালে ধীরে ধীরে ক্ষমতা ছাড়তে শুরু করলেও সামরিক বাহিনীর হাতে এখনো পর্যাপ্ত পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।

২০১৫ সালে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে অং সান সু চির ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু দুই বছর পর রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর সামরিক বাহিনীর নির্মম অভিযানের পর লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে যায় এবং এ বিষয়টি সু চি ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্কে ফাটল ধরায়।তবে নিজের দেশে জনপ্রিয়ই ছিলেন সু চি এবং ২০২০ সালের নভেম্বরের নির্বাচনেও তার দল বিপুল জয় পায়। কিন্তু আবারো নিয়ন্ত্রণ নিতে এসেছে সামরিক বাহিনী।সূত্র : বিবিসি