কৃষকরা কেন এত বেশি ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন?

কৃষকরা কেন এত বেশি ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন?

কৃষকরা কেন এত বেশি ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন? - ছবি - সংগৃহীত

বাংলাদেশে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউটের করা এক জরিপে দেখা যাচ্ছে তাদের হাসপাতালে ক্যান্সারে আক্রান্ত যত পুরুষ রোগী ভর্তি হন তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পেশায় কৃষক। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সংস্থাটির হাসপাতালে যত রোগী ভর্তি হয়েছেন তাদের উপরে একটি জরিপ করেছে।

গত ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত জরিপে দেখা যাচ্ছে, ২০১৭ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে সংস্থাটির হাসপাতালে যত পুরুষ রোগী ভর্তি হয়েছেন - তাদের মধ্যে ৬৪ শতাংশই নানা ভাবে কৃষি কাজের সাথে জড়িত। আর নারী-পুরুষ মিলিয়ে যত ক্যান্সার রোগী ভর্তি হয়েছেন - তাদের ৩৪ শতাংশই পেশায় কৃষির সাথে জড়িত।

কৃষকদের কেন এত বেশি ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন?
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউটের এপিডেমোলজি বিভাগের ডা: হাবিবুল্লাহ তালুকদার ছিলেন এই জরিপের প্রধান। তিনি বলছেন, `বাংলাদেশে সরাসরি এই বিষয়ে কোন গবেষণা নেই। কিন্তু কৃষকদের আর্থ সামাজিক অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে খুব দেরিতে তাদের ক্যান্সার শনাক্ত হয়।'

`আর তারা খালি পায়ে, খালি গায়ে, হাত লাগিয়ে মাটি ও পানির মধ্যে কাজ করে। জমিতে যে কীটনাশক তারা দেয় - সেটির নিয়মিত সংস্পর্শে আসা একটি কারণ হতে পারে।'

তিনি আরো বলছেন, `পানিতে কারখানার রাসায়নিক দূষণ এখন অনেক বেশি। তার সাথে যখন কীট ও আগাছানাশক মিশে যাচ্ছে তখন তা আরো বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। তার সংস্পর্শেও অনেক বেশি আসছেন কৃষকরা।'

কীটনাশকের সাথে ক্যান্সারের সম্পর্ক কতটা?
যুক্তরাজ্যভিত্তিক ক্যান্সার রিসার্চ ইউকের তথ্যমতে কৃষিতে ব্যবহৃত কিছু কীট ও আগাছানাশকের সাথে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্পর্কে রয়েছে। ৯০ এর দশক থেকে কৃষিতে আগাছানাশক ও কীটনাশকের ব্যবহার নিয়ে কাজ করছে কৃষি বিষয়ক গবেষণা সংস্থা উবিনীগ।

সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আক্তার বলছেন, `জাতিসঙ্ঘের স্টকহোম কনভেনশনে কৃষিতে ব্যবহৃত ১২ টি রাসায়নিককে তালিকাভুক্ত করে তাকে ডার্টি ডজন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সেগুলোকে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যান করেছে - কারণ সেগুলোর স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে।’

তিনি বলেন, এমন বেশ কিছু কীট ও আগাছানাশক এখনো বাংলাদেশে ব্যবহৃত হয়। এরকম কয়েকটির নাম উল্লেখ করছিলেন তিনি। যেমন 'এলড্রিন', 'ডাইএলড্রিন', 'ডিডিটি', 'এনড্রিন', ইত্যাদি।

কিডনি, লিভার ও স্তনের ক্যান্সার, বন্ধ্যাত্ব, চোখ ও ত্বকের সমস্যা -এগুলো এসব রাসায়নিকের প্রভাবের মধ্যে অন্যতম। ফরিদা আক্তার আরো বলছেন, ‘বিশেষ করে ক্ষেত-মজুরের খরচ কমাতে আগাছানাশকের ব্যবহার বাংলাদেশে এখন অনেক বেশি হচ্ছে। যে কাজটা আগে মজুররা করতেন - সেটা এখন রাসায়নিক ছিটিয়ে করা হচ্ছে।’

উবিনীগের তথ্য মতে, খাদ্য পণ্য উৎপাদন করে না এমন কৃষিতে - যেমন তামাক ও চা উৎপাদনে - অনেক বেশি রাসায়নিক ব্যবহার হচ্ছে। ফরিদা আক্তার বলছেন, বাংলাদেশে আধুনিক কৃষি প্রবর্তন করার সাথেও কীটনাশক ব্যবহারের সম্পর্ক রয়েছে।

‘দেশে উচ্চ-ফলনশীল বীজ ব্যবহার শুরু হলো, যেগুলো ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা,- তার প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। কৃষকের ক্ষেতে তৈরি বীজের মতো তারা সব ধরনের পোকা প্রতিরোধ করতে পারে না। সেগুলোতে কীটনাশক বেশি দিতে হয়।’

কীটনাশকের ব্যবহার সম্পর্কে অসচেতনতা

দীর্ঘদিন ধরে কৃষি ও কৃষকদের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছেন শাইখ শিরাজ। তিনি বলছেন, বাংলাদেশে কৃষকরা এসব রাসায়নিক নিরাপদ পরিমাণের চাইতে বেশি ব্যবহার করছেন এবং নিজেদের সুরক্ষার ব্যাপারে তাদের কাছে তেমন কোন তথ্য থাকে না।

তার ভাষায়, ‘কৃষক যাচ্ছে কীটনাশকের দোকানে। বিক্রেতা যখন যেটার সুবিধা পায় সেটার ক্যাম্পেইন করে, সেটাই কৃষকের কাছে বিক্রি করে।’

‘দেখা যাচ্ছে এক ধরনের পোকা মারার জন্য সে তিন-চারটা কোম্পানির একই ফ্যামিলির কীটনাশক ব্যবহার করছে। কীটনাশক কোম্পানি তার অসচেতনতার যে দুর্বলতা সেটাকে পুঁজি করছে।’

তিনি বলছিলেন, তার কাছে অনেক সময় কৃষকরা বলেন যে যেদিন তারা জমিতে কীটনাশক দেন - সেদিন তাদের সেদিন শরীরে সমস্যা হয়।

কৃষকের কথা
পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের মোর্শেদ শিকদার দীর্ঘদিন ধরে পেটের নানা অংশে ব্যথা অনুভব করতেন। তিনি পেশায় একজন ক্ষেতমজুর ছিলেন। তার স্ত্রী খাদিজা খানম জানান, ‘ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ তাকে বরিশালে চিকিৎসকের কাছে নেয়া হয়। কিন্তু ততদিনে তার শেষ অবস্থা।’

খাদিজা খানম জানিয়েছেন, ‘তার অনেক যায়গায় ব্যথা হইত। পেট, বুক, পাঁজরের হাড়ের আশপাশে খালি ব্যথার কথা বলত। এলাকায় ডাক্তার দেখাইছি কিন্তু কেউ কিছু ধরতে পারে না। এরপর ডিসেম্বরে ১৫ তারিখ বরিশাল নিয়ে যাই। সেইখানে রিপোর্টে তার লিভার, লাং, ব্লাড ক্যান্সার সহ চার রকমের ক্যান্সার ধরা পড়ে। এরপর আর মাত্র ১৫ দিন বাঁইচা ছিল।’

বাংলাদেশে ফসলি ক্ষেতে গেলে প্রায়ই কৃষদের দেখা যায়, শুধু মুখে গামছা বেঁধে কীট ও আগাছানাশক স্প্রে করছেন। যা বাতাসের মাধ্যমে তার শরীরে ঢুকে যাচ্ছে । অনেকে কোন ধরনের সাবধানতাই অবলম্বন করেন না। যারা মজুর হিসেবে কাজ করছেন, তাদের জমির মালিক কোন ধরনের সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ করেন না।

কিন্তু কৃষকের অনেক সময় কোন উপায় থাকে না। যেমনটা বলছিলেন সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কৃষক ববিতা মণ্ডল।

তিনি বলছেন, ‘আমি জানি সবই। যখন অল্প যায়গায় সবজি লাগাই তখন নিম পাতা সেদ্ধ কইরা পানি ছিটাই। কিন্তু যখন পাঁচ-ছয় বিঘা জমিতে চাষ করি তখন তো পারি না। তখন কীটনাশক ব্যবহার না করে উপায় কি? আমার ফসল বাঁচাইতে হবে।’ তিনি‘আমার মজুরদের দিন প্রতি ৩০০ টাকা করে দিতে হয়। তাদের সবাইকে মাস্ক, গ্লাভস, পায়ে রাবারের জুতা কিভাবে দেব?’

সূত্র : বিবিসি