সপ্তাহ জুড়ে সারাবেলা, কৈশোরবান্ধব সেবাকেন্দ্র থাকুক খোলা

সপ্তাহ জুড়ে সারাবেলা, কৈশোরবান্ধব সেবাকেন্দ্র থাকুক খোলা

বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীর সেবা নিশ্চিতের পাশাাপাশি সক্ষমতা অর্জনের সুযোগ করে দিলে এই ছেলেমেয়েরা দারিদ্র্য, বৈষম্য ও সহিংসতা চক্র ভেঙে ফেলতে পারে। -প্রতীকী ছবি

খন্দকার নাঈমা আক্তার নুন-

অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন রুবি। পড়াশোনাতে বেশ ভাল ছিল। শুধু পড়াশোনা না, খেলাধুলাতেও তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। চঞ্চল, ডানপিটে রুবি হঠাৎ করেই নিশ্চুপ হয়ে গেল। সল্পশিক্ষিত মা-বাবা তা কখনো খেয়াল করে নি। রুবি নিজে কিছু বোঝার আগেই তার বাবা-মা তার বিয়ে ঠিক করে। আজ রুবি ৩ সন্তানের মা। তার দেহ জীর্ণ-শীর্ণ, রোগা তাকে দেখে মনে হয় সে অপুষ্টির স্বীকার। অপরদিকে তার সাথে পড়ুয়া আদিবা। আদিবাও রুবির মত চঞ্চল স্বভাবের ছিল। হঠাৎ করেই যখন আদিবা তার মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করলো, আদিবা তার মাকে বিষয়টি জানালো। আদিবার মা আদিবাকে বিষয়গুলো মানিয়ে নিতে সাহায্য করলো। আজ আদিবা ব্যাংকের অফিসার ও এক কন্যা সন্তানের মা। অথচ আদিবা আর রুবি একই সাথে পড়াশোনা করতো। আজ রুবির জীবনও আদিবার মতো হতে পারতো। এই ঘটনা শুধু রুবির সাথেই ঘটে যাওয়া না,বাংলাদেশে প্রায় ৫৯ শতাংশ মেয়ের সাথে ঘটে এমন ঘটনা। 

বাংলাদেশে প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ কিশোর-কিশোরী রয়েছে। প্রত্যেকটি কিশোর-কিশোরীর বয়ঃসন্ধি কালের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এই স্তরে তাদের দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তনগুলো হড়পা বানের মতো হঠাৎ করে খুব দ্রুত পরিবর্তন হয়। কিশোর-কিশোরীদের এই সময়ের জন্য তেমন কোন আগাম প্রস্তুতি থাকে না। যার ফলে দেখা যায় আবেগজাত, আচারণগত, সামাজিক সমস্যাসহ নানাবিধ সমস্যা। বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরী শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের জন্য তাদের প্রতি মনোযোগ দিতে হয়। এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীর সেবা নিশ্চিতের পাশাাপাশি সক্ষমতা অর্জনের সুযোগ করে দিলে এই ছেলেমেয়েরা দারিদ্র্য, বৈষম্য ও সহিংসতা চক্র ভেঙে ফেলতে পারে। 

আমরা এখনো আমাদের দেশের দারিদ্র্যতা নিরসন করতে পারি নি। এই দারিদ্র্যতার পরিণতি হচ্ছে বাল্যবিবাহ। বাল্যবিয়ের উচ্চহারের কারণে বাংলাদেশে বয়ঃসন্ধিকালে অনেক মেয়ে গর্ভধারণ, সহিংসতা ও অপুষ্টির শিকার হয়। ইউনিসেফের এক গবেষণায় দেখা যায়, বর্তমানে ২০ থেকে ২৪ বছরের নারীদের মধ্যে ৫৩ শতাংশ নারীর বিয়ে হয়েছে ১৮ বছরের আগে। মূলত প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে হয়ে কিশোরীদের। অল্প বয়সে গর্ভধারণের ফলে নানা জটিলতা মৃত্যু হয় মাসহ নবজাতকের। 

ইউনিসেফের আরেকটি তথ্যমতে, বাংলাদেশ বয়ঃসন্ধিকালে তিনজন মেয়ের মধ্যে একজনই রুগ্ন। ১১ শতাংশ কিশোরী অপুষ্টির শিকার। আর ২০ বছরের বেশি বয়সী নারীদের সন্তান প্রসবের সময় যে মাতৃমৃত্যুর ঘটনা ঘটে, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোরীদের ক্ষেত্রে এ ঘটনা পাঁচগুণ হারে বেশি ঘটে। তার কারণ হচ্ছে প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে অজ্ঞতা। প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি প্রতিটি মানুষের মানবাধিকার। তবে আমাদের দেশে বিশেষ করে তরুণদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি লজ্জাজনক বলে বিবেচিত। শুধুমাত্র এই লজ্জা আর অজ্ঞতার কারণেই কিশোর-কিশোরীরা বাল্যবিবাহ, অকাল গর্ভধারণ, অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক, প্রজনন স্বাস্থ্য জটিলতা ইত্যাদি সমস্যার সম্মুখীন হয়। 

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ২০১৩ সালের তথ্যমতে, তরুণ-তরুণীরা আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে না। যার ফলে ১৫-২৪ বয়সী তরুণ-তরুণীরা সামঞ্জস্যহীনভাবে এইচআইভিতে আক্রান্ত হচ্ছে। আর এই সকল সমস্যা নিরসনের জন্য কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক স্তরেই যৌন ও প্রজনন শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আমদের দেশে অনেক স্কুলে ছেলে-মেয়ে একসাথে পড়াশোনা করে তাই যৌন ও প্রজনন শিক্ষাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়, লজ্জার বিষয় মনে করা হয়। আবার গ্রামে অনেক ভ্রান্ত ধারণা, কুসংস্কার আছে যা কিশোর-কিশোরীর প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাঁধা। গ্রামে অনেকেরই ধারণা শারীরিক পরিবর্তনগুলো সবার সামনে প্রকাশ করা যাবে না। 

ছেলে- মেয়ে উভয়ের শারীরিক পরিবর্তন হয় এক্ষেত্রে দুজনেরই সমান পুষ্টির চাহিদা থাকে  তবে অনেক পরিবারের ধারণা ছেলেরা বাহিরে কাজ করে, ভবিষ্যতে পরিশ্রম করবে এজন্য তাদের অতিরিক্ত পুষ্টিকর খাদ্য দরকার। এসব ভ্রান্ত ধারণার ফলে পিছিয়ে পড়ছে আমাদের দেশের কিশোর-কিশোরী। এজন্য দরকার তাদের সঠিক প্রজনন শিক্ষা দেওয়ার। কৈশোরবান্ধব সেবাকেন্দ্রর সেবা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশে ৬০৩ টি সেবা কেন্দ্র রয়েছে। তবে এই সেবাকেন্দ্রগুলো সকাল ৯ টা থেকে বিকেল ৩ টা পর্যন্ত খোলা থাকে। কিন্তু আমাদের কিশোর-কিশোরীরা যারা আছে তারা সবাই ১০-১৯ বছর বয়সী, এরা সবাই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। আর এই সময়ে শিক্ষার্থীরা স্কুল, কলেজে থাকে। যার ফলে তারা কৈশোরবান্ধব সেবা কেন্দ্রের সেবাগুলো নিতে পারে না। আবার অনেক শিক্ষার্থীরা কৈশোরবান্ধব সেবাকেন্দ্র সমূহের নাম বা সেবাসমূহ জানে না। যদি এই কৈশোরবান্ধব সেবাকেন্দ্রসমূহ সপ্তাহে ৭ দিন ও সকাল ৯ টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত খোলা থাকে তবে কিশোরীরা তাদের স্কুল শেষ করে বা বন্ধের দিনও সেবা নিতে পারবে। ৩ কোটি ৬০ লাখ কিশোর- কিশোরীর জন্য ৬০৩ টি কৈশোরবান্ধব সেবাকেন্দ্র যথেষ্ট নয়, প্রতিটি জেলা- উপজেলায় কৈশোরবান্ধব সেবা কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। 

শুধু কিশোরীই নয়, কিশোরাও যাতে এ সেবার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে সে বিষয়ে দৃষ্টিপাত করতে হবে। প্রতিটি সেবাকেন্দ্রে একটি কাউন্সেলিং কর্ণারের ব্যবস্থা থাকলে প্রতিসপ্তাহে অভিভাবকদেরও প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষা সম্পর্কে ধারণা যাবে। এতে করে যে সকল অভিবাবক সল্পশিক্ষিত তারাও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হবে। প্রতিটি স্কুল, কলেজে শিক্ষকদের কিশোর- কিশোরীদের প্রতি বন্ধুসুলভ আচরণ করতে হবে। তাদেরকে প্রজনন স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা বিষয়ে সঠিক শিক্ষা দিতে হবে। কৈশোরবান্ধব সেবা কেন্দ্রের সেবাগুলো সম্পর্কে জানতে হবে, যাতে কিশোর-কিশোরী নিঃসংকোচে সেবাকেন্দ্রে সেবা নিতে যেতে পারে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে যাতে কিশোর-কিশোরীর সেবা নিশ্চিত হয়, স্কুল কলেজ করেও যাতে কিশোর-কিশোরীরা কৈশোরবান্ধব সেবাকেন্দ্র থেকে সেবা গ্রহণ করতে পারে। তাই পরিশেষে বলতে চাই- সপ্তাহজুড়ে সারা বেলা, কৈশোরবান্ধব সেবাকেন্দ্র থাকুক খোলা।

লেখক: শিক্ষার্থী, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, ২য় বর্ষ
            কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।