ভালোবাসা দিবসে

ভালোবাসা দিবসে

মুনজুরুল ইসলাম নাহিদ

.

(১) আশিকের বহু দিনের ইচ্ছে ভালোবাসা দিবসে মায়ের হাতে একটি গোলাপ তুলে দিয়ে শুভেচ্ছা জানাবে। রাজধানীর ব্যস্ত সড়কে ঘুরে ঘুরে ফুল বিক্রি করে সে। প্রতিবার ফেব্রুয়ারিতে ভেবে রাখে এবার ভালোবাসা দিবসে দিন শেষে মায়ের সামনে একটি গোলাপ নিয়ে হাজির হবে। ওর থেকে ফুল নিয়ে লোকেরা যেভাবে একে অপরকে উপহার দেয়, শুভেচ্ছা জানায় সে ভাবে সেই কথাগুলো বলবে মায়ের সামনে। ১৪ বছরের জীবনে ফুল বিক্রি শুরুর পর অনেকবারই এ কথা ভেবেছে কিন্তু কোনবারই হয়ে উঠে নি। এবার যেভাবেই হোক ইচ্ছেটা পূরণ করবে বলে নিজের সাথেই জেদ করেছে সে।

 (২) আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি। আশিকের কাঙ্ক্ষিত দিন। ভালোবাসা দিবস বলে প্রতিদিনের তুলনায় অনেক বেশি ফুল বিক্রি হবে। তাই সকালেই অন্য দিনের তুলনায় বেশি করে ফুল নিয়েছে বিক্রির জন্য। প্রফুল্ল মন নিয়ে পথে বের হয়েছে আশিক। আজ সে তার দুটি ইচ্ছে পূরণ করবে। সবচেয়ে ভালো গোলাপটি রেখে দিবে, যা দিয়ে দিন শেষে উপহার দিবে মাকে। আর মায়ের জন্য একটা ঔষধ কিনবে। অনেকদিন আগে ডাক্তার লিখে দিয়েছিল কিন্তু একসাথে অনেকগুলো টাকা লাগবে তাই এতদিন কেনা হয়নি। মনে পড়ে কয়েকবার ডাক্তারের লিখে দেওয়া প্রেসক্রিপশনটা ফার্মেসিতে দেখিয়েছিল, কিন্তু কাছে যে টাকা থাকত সে টাকায় নিতে পারেনি। প্রেসক্রিপশনটা আজও পকেটেই আছে। ভাবতে ভাবতেই পকেট থেকে কাগজটা বের করে আশিক। কালো কালিতে লেখাগুলো বুঝতে না পারলেও সে জানে, অনেকগুলো টাকা আর এই কাগজটা দিলে সেই ঔষধ পাওয়া যাবে। কয়েক মাস থেকে সে আজকের দিনটির অপেক্ষায় আছে। বেশি ফুল বিক্রি হলে সে টাকায় কিনতে পারবে ঔষধটা। পৃথিবীতে মা ছাড়া কেউ নেই আশিকের। মা অসুস্থ্য হওয়ার পরেই সে ফুল বিক্রি শুরু করেছে। মা সুস্থ্য থাকতে কতো ভালো সময় কাটতো একসময় এমন অনেক কথাই আজ মনে পড়ছে ওর।

(৩) সত্যিই আজ সারাদিন অনেক ফুল বিক্রি হচ্ছে। আজ ফুল কেনার জন্য মানুষকে অনুরোধ করতে কেন যেন অনেক ভালো লাগছে আশিকের। প্রতিটি ফুল বিক্রির পর টাকা হাতে পেতেই চোখে আনন্দের ঝিলিক খেলে যায়। সবচেয়ে ভালো গোলাপটি একপাশে রেখে দিয়েছে যত্ন করে। অনেকেই নিতে চেয়েছিল কিন্তু দেয়নি সে। মাঝে মাঝে ফুল বিক্রির পর তাকিয়ে দেখে কীভাবে লোকেরা একে অপরকে ফুল দেয়, কীভাবে কথা বলতে হয়। মনে মনে কয়েকবার প্র‍্যাকটিসও করে নিয়েছে মাকে কীভাবে ফুল দিবে।

(৪) মায়ের জন্য রাখা ফুলটি ছাড়া সবগুলো ফুল বিক্রি করেছে আশিক। মায়ের জন্য রাখা ফুলটিকে সযত্নে মুড়িয়ে রেখেছে কাগজে।পকেটে আজ অনেকগুলো টাকা। হাত দিয়ে ধরতেই মন ভরে যাচ্ছে। হাতটা প্যান্টের পকেট থেকে বের করতে ইচ্ছে করছে না। তাই একহাতে ফুল নিয়ে আর অন্য হাত পকেটে রেখেই ঔষধের দোকানে যায় আশিক। বুকপকেট থেকে বের করে দেয় অনেকদিন থেকে সাথে রাখা প্রেসক্রিপশনটা। দোকানদার একপাতা ঔষধ বের করে আশিকের সামনে রাখে। আশিক পকেট থেকে টাকাগুলো বের করে গুছিয়ে দোকানীকে দেয়। দোকানদার হিসেব করে ওকে জানায় ঔষধের দাম থেকে বিশ টাকা কম আছে সেখানে। নিতে হলে আরোও বিশ টাকা দিতে হবে। মুহূর্তেই আশিকের মুখটা বিমর্ষ হয়ে যায়। সে ভাবতে পারেনি আজও টাকা কম হবে। সকাল থেকে কতশত পরিকল্পনা ছিল মাকে ঔষধটা দিবে আজ। তা বুঝি আজও হবে না। আর ভাবতে পারে না আশিক। চোখের সামনে দাঁড়ানো ফার্মেসির লোকটিকেও ঝাপসা লাগছে। হঠাৎ মাথায় একটা প্রশ্ন খেলে যায়। দোকানীকে ফুলটা দিলে কী ঔষধ দিবে? ভাবতেই বুকটা কেঁপে উঠে, চোখ চলে যায় সারাদিন আগলে রাখা ফুলটির উপর। কী করবে ভেবে পায় না। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয় একবার চেষ্টা করে দেখবে ফুল নিয়ে ঔষধ দেয় কিনা। গলা দিয়ে যেন কথা বের হতে চাচ্ছে না। তবুও জোর করেই বলে, "ফুল নিবেন? আমার কাছে খুব ভালো একটা ফুল আছে।" এই বলে কাগজ থেকে ফুলটি বের করে সামনে ধরে আশিক। কিন্তু দোকানী ফুল লাগবে না বলে জানায়। এ সময় ফার্মেসীতে থাকা অপর এক ব্যক্তি দোকানীকে উদ্দেশ্য করে বলে, "ভাই আজতো ভালোবাসা দিবস। ভাবির জন্য একটা ফুল নিতে পারেন, খুশী হবে।" তার কথা শুনে দোকানী ফুল নিতে রাজি হয়। আশিক কাঁপা কাঁপা হাতে দোকানদারের হাতে ফুলটি তুলে দেয়। আর সামনে থাকা ঔষধের বোতলটি নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। চোখ ফেটে জল আসে। ভেতরটায় কেমন যেন ফাঁকা বোধ হয়। ঔষধের বোতলটা বুকে চেপে সে অনুভূতি কমানোর চেষ্টা করে হাটতে থাকে আশিক।

লেখক- শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া