যেভাবে উন্নয়শীল দেশের কাতারে বাংলাদেশ

যেভাবে উন্নয়শীল দেশের কাতারে বাংলাদেশ

যেভাবে উন্নয়শীল দেশের কাতারে বাংলাদেশ

বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়, মুন্সীগঞ্জের আহসান উল্লাহ তখন ১৬ বছরের কিশোর। বাবা নেই। জায়গা-জমি কিংবা সম্পদও নেই। কৃষি কাজে দিনমজুরিই একমাত্র ভরসা। অন্যের জমিতে ‘কামলা দিয়ে’ সংসার চালাতে থাকেন তিনি। কিন্তু ৫০ বছর পর আবুল হোসেন এখন এলাকায় বেশ স্বচ্ছল হিসেবে পরিচিত। ১৮ একর জমিতে করছেন আলু চাষ করেন। পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন কৃষি বীজের ব্যবসা। মুন্সীগঞ্জ ছাড়িয়ে যেটি বিস্তৃত হয়েছে অন্যান্য জেলাগুলোতেও।আহসান উল্লাহ তার গল্প বলতে শুরু করলেন।

‘শুরুটা করেছিলাম অল্প কিছু জমি লিজ নেয়ার মাধ্যমে। তখন সরিষা, গম এসব আবাদ হইতো। ৮০ সালের পর শুরু করলাম আলু চাষ। নতুন জাতের আলু'র বীজ, আধুনিক সার ব্যবহার শুরু করলাম। অন্যদের চাইতে ফলন বেশি হইতে থাকলো। লাভও বাড়তে থাকলো। এইভাবে বলতে পারেন তিলেতিলে আজকের এই অবস্থায়।’

গত ৫০ বছরে কৃষক আহসান উল্লাহ'র নিজের যেমন উন্নয়ন হয়েছে তেমনি কৃষি খাতেও নতুন নতুন জাতের ফলন শুরু হয়েছে।গতানুগতিক ধান, গম, আলু, ভুট্টা ছাড়াও ক্যাপসিকাম, ড্রাগন ফল কিংবা স্ট্রবেরির মতো নতুন কৃষি পণ্যের উৎপাদন শুরু হয়েছে।

যেগুলোতে অনেক কৃষক যেমন লাভবান হয়েছেন, তেমনি কর্মসংস্থানও হয়েছে। উৎপাদন বাড়ায় দেশটি এখন খাদ্যেও স্বয়সম্পূর্ণ।যদিও কৃষি নির্ভর অর্থনীতির দেশ হয়েও স্বাধীনতার পরে খাদ্য ঘাটতি ছিলো ব্যাপক।সেই সময়ে দারিদ্র এবং ভঙ্গুর অর্থনীতির কারণেও বিশ্বে আলোচনায় ছিলো দেশটি। বাংলাদেশকে তাচ্ছিল্য করা হতো 'তলাবিহীন ঝুড়ি' বলে।

যেভাবে বদলেছে অর্থনীতি

মোটাদাগে কয়েকটি সূচকে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের অর্থনীতির চিত্র বোঝা যায়।বিবিএস এবং বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এসব সূচকের প্রথম যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যাচ্ছে, ১৯৭৩-১৯৭৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানি আয় ছিলো মাত্র ২৯৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।সে সময় জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিলো ৩.৮ শতাংশ।মাথাপিছু আয় মাত্র ১২৯ ডলার।দারিদ্রের হার ৭০ শতাংশ।

৫০ বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে, রফতানি আয় বহুগুণে বেড়ে মিলিয়ন ডলার থেকে এসেছে বিলিয়ন ডলারের ঘরে। ২০২০ সালের হিসেবে যা ৩৯.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।জিডিপি বেড়ে হয়েছে ৫.২৪ শতাংশ।মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৬ গুণ। অর্থাৎ দুই হাজার ৬৪ ডলার।দারিদ্রের হার কমে হয়েছে ২০.৫ শতাংশ।এক সময় যে দেশটি তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে আখ্যায়িত ছিলো এখন বলা হচ্ছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে সেই দেশটি হতে যাচ্ছে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ।স্বল্পোন্নত থেকে দেশটি এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠে এসেছে।

উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর

বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকাভূক্ত হয় ১৯৭৫ সালে। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের অন্তর্ভূক্ত হতে তিনটি শর্ত রয়েছে।

২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ তিনটি শর্তই পূরণ করে। পরে ২০২১ সালেও তিনটি শর্ত পূরণে প্রয়োজনীয়তা দক্ষতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ।জাতিসঙ্ঘের নিয়মানুযায়ী, কোনো দেশ পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় উত্তরণের মানদণ্ড পূরণে সক্ষম হলে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ পায়।বাংলাদেশ সেই সুপারিশ পেয়েছে।

জাতিসঙ্ঘের তিনটি শর্তের প্রথমটি হচ্ছে, মাথাপিছু আয়। এরপর অর্থনৈতিক ঝুঁকি এবং সবশেষে মানবসম্পদ উন্নয়ন।মাথাপিছু আয়ে জাতিসঙ্ঘের শর্ত পূরণে ন্যনতম দরকার এক হাজার দুই শ’ ৩০ ডলার। বাংলাদেশে সেখানে ২০২০ সালে মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৬৪ ডলার।

অর্থনৈতিক ঝুঁকি কতটা আছে, সেটা নিরূপণে ১০০ স্কোরের মধ্যে ৩২ এর নিচে স্কোর হতে হয়। বাংলাদেশ সেখানে নির্ধারিত মানের চেয়েও ভালো করেছে। অর্থাৎ ২৫.২ স্কোর করেছে।মানবসম্পদ উন্নয়ন যোগ্যতায় দরকার ৬৬'র উপরে স্কোর। বাংলাদেশ সেখানে পেয়েছে আরো বেশি ৭৩.২ স্কোর।

কিন্তু এসব সূচকে বাংলাদেশ কীভাবে উন্নতি করলো?

অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, গত কয়েকদশকে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের রফতানি আয় বেড়েছে। রেমিটেন্স বেড়েছে। কৃষি-শিল্পের উৎপাদন এবং কর্মসংস্থান বেড়েছে। অবকাঠামো উন্নয়নও হয়েছে।

মূলতঃ প্রান্তিক পর্যায়ে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান এবং উৎপাদন, রফতানি বৃদ্ধি -সবমিলিয়েই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশে।শুরুতে কৃষি খাত এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখলেও ৮০'র দশক থেকে সেখানে মূল ভূমিকা রাখতে শুরু করে শিল্প খাত।আরো নির্দিষ্ট করে বললে তৈরি পোশাক খাত। রফতানি এবং কর্মসংস্থান দুটো ক্ষেত্রেই তৈরি পোশাক খাতের বড় ভূমিকা আছে।

বাংলাদেশ রফতানি করে এখন যে আয় করে তার ৮৩ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। অন্যদিকে এ খাতে কাজ করে লাখ লাখ শ্রমিক যাদের সিংহভাগই নারী। তাদেরও জীবন মানের উন্নয়ন ঘটেছে।ঢাকার অদূরে সাভারের একটি পোশাক কারখানায় কথা হয় এরকমই একজন শ্রমিক সুলতানার সাথে।

উত্তরাঞ্চলের দারিদ্রপীড়িত অঞ্চল থেকে কাজের সন্ধানে সাত বছর আগে সাভারে আসেন তিনি। পরে কাজ নেন পোশাক কারখানায়।সুলতানা বলছেন, পোশাক কারখানায় কাজ করেই তার পরিবারে দারিদ্রের অবসান হয়েছে।

‘যখন গ্রামে ছিলাম, তখন বাবা’র পক্ষে সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছিলো না। পরে ঢাকায় এসে গার্মেন্ট কারখানায় চাকরি নিলাম। সাত বছর পর এখন আমার পরিবার ভালোই আছে। মাসে মাসে টাকা পাঠাই বাড়িতে। কিছু জায়গা কেনা হয়েছে, গরু কেনা হয়েছে। অল্প কিছু টাকাও জমাতে পেরেছি।’সুলতানার একটি কন্যা সন্তান আছে। তিনি বলছেন, ভবিষ্যতে তার কন্যা যেনো স্কুলে পড়ালেখা করে ভালোকিছু হতে পারে সেটাই তার মূল লক্ষ্য।

এছাড়া ভবিষ্যতে গ্রামে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছাও আছে তার।‘আমি কিছু টাকা জমিয়েছি। আরো কয়েকবছর চাকরি করে আরো কিছু টাকা জমাতে চাই। এরপর গ্রামে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা আছে। সেখানে গিয়ে একটা গরুর খামার দিবো, মুদি দোকান দিবো। নিজেই কিছু করার চেষ্টা করবো।’

মানবসম্পদ সূচকে অগ্রগতি

শুধু অর্থনৈতিক সূচক নয়, বাংলাদেশ গত পঞ্চাশ বছরে মানবসম্পদ সূচকেও গুরুত্বপূণ উন্নতি করেছে। জাতিসঙ্ঘের সূচকে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর ৭৩.২ শতাংশ।এই সূচকের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে মূলতঃ শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর হিসেবে দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে প্রতি হাজারে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা ছিলো ১৫৩ জন।যেটি ২০১৮ সালে এসে প্রতি হাজারে মাত্র ২২ জনে নেমে আসে।

এছাড়া বিবিএস ১৯৮১ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর সংখ্যা দিয়েছে প্রতি হাজারে দুই শ’ ১২ জন। যেটি ২০১৮ সালে হয়েছে প্রতি হাজারে ২৯।

১৯৯১ সালে মাতৃ মৃত্যুর হার ছিলে ৪.৭৮ শতাংশ। সেটি এখন ১.৬৯ শতাংশে নেমে এসেছে।

অপুষ্টি এবং মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি সেখানে স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বেসরকারি এনজিও ও প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে।বেসরকারি এসব প্রতিষ্ঠান প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া এবং সেবা নিতে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে।সরকারের সাথেও আর্থিক কিংবা অন্যান্য সুবিধা নিয়ে যৌথভাবে কাজ করেছে।

সব মিলিয়ে বাংলাদেশের মানবসম্পদ সূচকে অগ্রগতির সাথে সাথে নিরেট অর্থনৈতিক সক্ষমতাও এমনভাবে বেড়েছে যেখানে বিদেশী ঋণ সহায়তা নির্ভর উন্নয়নে অভ্যস্ত বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করছে ৩০ হাজার কোটি টাকার মেগা প্রজেক্ট পদ্মাসেতু।স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার সাথে সাথে যেটি গেলো ৫০ বছরে বাংলাদেশের রূপান্তরের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন।

সূত্র : বিবিসি