ক্যাসিনোতে কারা যায় ? সেখানে কী হয়

ক্যাসিনোতে কারা যায় ? সেখানে কী হয়

ক্যাসিনো


জুয়া খেলা কবে শুরু হয়েছিলো তার ইতিহাস জানা খুব দুস্কর। অনেকে মনে করেন  প্রায়  দুই হাজার বছর আগে জুয়া খেলার উত্থান। জুয়া খেলাকে কোনো সমাজে ভালো ভাবে গ্রহন করা হয় না। ফলে জুয়া খেলার জন্য একটি নির্দিষ্ট স্থান গড়ে তোলা হয়। যা সমাজের সাধারন মানুষের চোখে একটি নিষিদ্ধ স্থান হিসাবে পরিচিত। ক্যাসিনো হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের জুয়া খেলার একটি নির্দিষ্ট স্থান যাকে জুয়ার আড্ডা বা আসর বলা যায়। কিন্তু সেটা হয় সুবিশাল পরিসরে। সাধারণত ক্যাসিনো এমনভাবে বানানো হয় যে এর সাথে কিংবা পাশাপাশি হোটেল, রেস্টুরেন্ট, শপিংমল, আনন্দভ্রমণ জাহাজ এবং অন্যান্য পর্যটন আকর্ষণ থাকে। এর সাথে থাকে নারী সংযোগের সুযোগ। 


ক্যাসিনো ইতালীয় ভাষার শব্দ যার মূল ক্যাসা অর্থ ঘর। ক্যাসিনো বলতে ছোট ভিলা, গ্রীস্মকালীন ঘর কিংবা সামাজিক ক্লাবকে বোঝানো হতো। ইতিহাসের প্রায় সব সমাজেই কোন না কোন রূপে জুয়ার প্রচলন ছিলো। প্রাচীন গ্রিক -রোমান হয়ে নেপোলিয়নের ফ্রান্স থেকে বর্তমান বাংলাদেশ সব খানেই জুয়ার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। বিভিন্ন তথ্যে দেখা যায় ১৬৩৮ সালে  ইউরোপের ভেনিসে ক্যাসিনো প্রতিষ্টা হয়। ১৯ শতকের দিকে ক্যাসিনো বলতে এমন সব ভবনকে বোঝানো হতো যেখানে আনন্দদায়ক কাজকর্ম হতো। ইতালিতে বিভিন্ন অর্থে  ক্যাসিনো শব্দটি ব্যবহার করা হয়। যেমন পতিতালয়। ইতালী ভাষায় জুয়ার আসর বোঝাতে ভিন্ন উচ্চারণে ক্যাসিনো বলে। জার্মান এবং স্প্যানিশ ভাষায় ক্যাসিনো বা কাসিনো দ্বারা অফিসার মেস বোঝানো হয়।


অনিয়ন্ত্রিত জুয়ার আসরের মধ্য দিয়েই ক্যাসিনোর উৎপত্তি। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জুয়ার আসরে চলে ক্যাসিনোর রমরমা ব্যবসা। উড়ানো হয় হাজার হাজার কোটি টাকা। বিশ্বজুড়ে রয়েছে এমন অসংখ্য ক্যাসিনো যেখানে জুয়ার নেশায় মেতে থাকেন জুয়াড়িরা। আমেরিকা, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া বা ইউরোপের দেশ ছাড়াও এশিয়াতে এর বিস্তৃতি ঘটছে। ইদানীং এশিয়ার কয়েকটি দেশ এসব জুয়া খেলায় এগিয়ে। এশিয়ার ক্যাসিনোগুলো চুটিয়ে ব্যবসা করছে। এসব জায়গায় হরহামেশাই চলে জুয়ার বড় বড় দান। এশিয়া মহাদেশের নেপাল, ভারত, চীন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এসব জুয়ার আসরে এগিয়ে। বালক থেকে বৃদ্ধ, সব বয়সীদের দেখা মিলে এসব ক্যাসিনোতে। কোটি কোটি টাকা ওড়াতে আর মনোরঞ্জন করতে তারা ক্যাসিনোগুলোতে  আসেন।অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি খেলার ছলে মনোরঞ্জনের জন্য এসব ক্যাসিনোতে এসে থাকেন।


খরিদ্দারেরা ক্যাসিনো গেমস দ্বারা জুয়া খেলে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা বা দক্ষতারও প্রয়োজন হয়। অধিকাংশ গেমস গাণিতিকভাবে এমনভাবে বিন্যাস করা থাকে যে প্রায়ই খেলোয়ারদের চেয়ে ক্যাসিনো সুবিধা পেয়ে থাকে। এই সুবিধাকে হাউজ এজ বলা হয়ে থাকে। পোকারের মতো খেলাগুলো যেখানে একজন খেলোয়াড় অপর খেলোয়ারের সাথে খেলে সেখানে ক্যাসিনোগুলো রেক নামে কমিশন নিয়ে থাকে। ভিডিও লটারি মেশিন ক্যাসিনোর অন্যতম জনপ্রিয় জুয়া খেলা। এখানে কিছু কিছু খেলায় গাণিতিকভাবে খেলোয়াড়ের পক্ষে কিছু যুক্তি দেখায় যে, তার জেতার সম্ভাবনা আছে। মূলত এটাই একজন খেলোয়াড়কে তার খেলার মধ্যে বেশি সময় ধরে রাখে। কারণ সে ধরে নেয় যে, তার জেতার সম্ভাবনা এখনও শেষ হয়ে যায়নি। কিছু কিছু খেলায় গ্রাহকরা সরাসরি একে অপরের বিপক্ষে বাজি ধরার সুযোগ পায় এবং ক্যাসিনো হাউজ এখান থেকে কিছু কমিশন নেয়। একে র‌্যাক বলা হয়ে থাকে। এছাড়া গ্রাহকদের আগ্রহী করতে ক্যাসিনোর পক্ষ থেকে নানা অফার দেওয়া হয়ে থাকে।


আমেরিকায় স্যালুন নামে প্রথম জুয়াবাড়ি বা ক্যাসিনো নির্মিত হয়। চার প্রধান শহর নিউ অরেলিন্স, সেন্ট লুইস, শিকাগো এবং স্যানফ্রান্সিস্কোয় স্যালুন নির্মিত হয়। এসব স্যালুনে আগতরা পান করতো, আড্ডা দিতো এবং  জুয়া খেলতো। ১৯৩১ সালে নেভাদায় জুয়া খেলাকে বৈধ করা হলে সেখানে প্রথম বৈধ আমেরিকান ক্যাসিনো নির্মিত হয়। ১৯৭৬ সালে নিউ জার্সি আটলান্টিক শহরে জুয় খেলা অনুমোদন করে। এটা বর্তমানে আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহৎ জুয়াড়ির শহর। বিশ্বব্যাপী সর্বনিম্ন জুয়াখেলার বয়স ১৬ থেকে ২১ এর মধ্যে। 


যুক্তরাষ্ট্রের কানেক্টিকাটের ফক্্রউডস রিসোর্ট ক্যাসিনোটি বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। বহু সেলিব্রেটি তাদের বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সেখানে যান। সারা রাত জুয়া খেলার পাশাপাশি এখানে চলে জমজমাট আড্ডা। কানেক্টিকাটের এই ফক্সউড রিসোর্ট ক্যাসিনো পৃথিবীজুড়ে জুয়াড়িদের অন্যতম পছন্দের জায়গা। হাজার হাজার জুয়াড়ির সমাগম ঘটে এই ক্যাসিনোতে এবং চলে কোটি কোটি টাকার জুয়ার আসর। 


লাসভেগাসে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম হোটেলে অবস্থিত  এমজিএম গ্রান্ড ক্যাসিনো। ১ লাখ ৭১ হাজার ৫০০ বর্গফুটের বিশাল এলাকাজুড়ে নির্মিত এই ক্যাসিনোর গেমিং জোন। এটিই সিন সিটি বা পাপের শহরের সবচেয়ে বড় ক্যাসিনো ফ্লোর। সারা পৃথিবী থেকে ধনকুবেররা আসেন এই ক্যাসিনোতে। 


লাসভেগাসের আরেকটি  ক্যাসিনো বেল্টাজিও। নান্দনিক লোকেশনে অবস্থিত এই ক্যাসিনোটি এমজিএম রিসোর্ট মালিকাধীন। এখানে রয়েছে একটি বিখ্যাত ফোয়ারা। যার আশপাশে ওশেইন ১১, দ্য হ্যাংওভার অ্যান্ড টোয়েন্টি ওয়ান, গ্লামারসের মতো আলোচিত মুভির শুটিং হয়েছে। লাসভেগাসের দ্য ভ্যালেন্তিনো রিসোর্ট হোটেল ক্যাসিনো দুনিয়াব্যাপী পরিচিত।  এই বিলাসবহুল হোটেল এবং ক্যাসিনোটি বিশ্বেজোড়া বিখ্যাত। পুরো হোটেলটির মালিক এবং পরিচালক লাসভেগাস করপোরেশন। রিও অল স্যুট হোটেল অ্যান্ড ক্যাসিনোর মালিক সিজার্স এন্টারটেইনমেন্ট করপোরেশন। এই ক্যাসিনোটি জুয়াড়িদের কাছে ‘দ্য রিও’ নামেই বেশি পরিচিত। এটি লাসভেগাসের অন্যমত আকর্ষণীয় হোটেল। ব্রাজিলের চমৎকার শহর রিও নামানুসারে এই হোটেলটির ক্যাসিনো নাম দেওয়া হয় রিও। পুরো হোটেলটির ডিজাইন আর নকশায় প্রাধান্য পেয়েছে ব্রাজিলের সংস্কৃতি।


এশীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় জুয়ার আসরগুলো বসে নেপালের কাঠমান্ডুতে। হিমালয়ের দেশটিতে ক্যাসিনোর জন্য বিশ্বজোড়া খ্যাতি রয়েছে। এসব জুয়ার আসরে সবচেয়ে বেশি জুয়ায় মাতে ভিনদেশি পর্যটকরা। এসব জুয়ার আসরে মজার খেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে- পোকার বা জুজু খেলা , বাক্কারাট বা বাজি ধরে তাস খেলা , রুলেট, পন্টুন, ফ্লাশ, বিট, ডিলার, ব্ল্যাকজ্যাক এবং কার্ডস্লট মেশিনের খেলা। যেসবের পিছনে ওড়ানো হয় কোটি কোটি ডলার। ২৪ ঘণ্টা ধরেই চলে এসব জুয়ার আসর। অনেকে এক রাতেই রাজ্যের রাজা বনে যান, আবার অনেকেই হয়ে যান রাস্তার ফকির। রাতভর জুয়া খেলার পাশাপাশি মদের নেশায় মেতে ওঠেন জুয়াড়িরা। বিশ্বে যত ক্যাসিনো রয়েছে দ্য ভ্যালেন্তিয়ান ম্যাকাও  তার মধ্যে অন্যতম। চীনের এই ক্যাসিনোটি জুয়াড়িদের প্রধান আকর্ষণ। এটি শুধু ক্যাসিনোই নয় বরং একটি পাঁচতারকা মানের হোটেলও। ক্যাসিনো পুরো হোটেলটির রূপ পাল্টে দিয়েছে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আরো ক্যাসিনোর বিস্তার ঘটছে দক্ষিন কোরিয়া, ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইন রয়েছে। 


এ কথা বিশ্লেষন করার দরকার হয় না যে, ক্যাসিনোতে কারা যায়। ধনী বা টাকাওয়ালারাই এর মূল গ্রাহক। বিশেষ করে, ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী গ্রাহক বেশি হয়ে থাকে। তবে উন্নত দেশগুলোর প্রেক্ষাপটে ক্যাসিনোতে যাওয়ার জন্য কোন বাধা নিষেধ থাকে না। এগুলো সরকার অনুমোদিত হয়ে থাকেন। আর সেখানে প্রায় সকল বারের সাথেই ছোট-খাটো ক্যাসিনো থাকে। ভয়ংকর হয়ে দাঁড়ায় তাদের জন্য, যারা নিয়মিত সেখানে যান এবং নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়েন। নিয়মিত ভরা পকেট নিয়ে ক্যাসিনোতে গিয়ে পকেট খালি করে বাসায় ফেরা লোকজনই হচ্ছে আসল জুয়াড়ি। 


বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ। আর ইসলামে জুয়া সম্পূর্ণ হারাম ও নিষিদ্ধ। তবে জুয়া বাংলাদেশের একটি অতিপরিচিত শব্দ। অলিতে গলিতে চোখ মেলে তাকালেই এর দেখা মিলে। তবে বেশ কয়েক বছর আগেও এতোটা খোলামেলা ছিলো না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে আনুষ্ঠানিক ক্যাসিনো-এর খোঁজ পাওয়া যায়। বিষয়টি জানতে পেরে সরকার প্রশাসনিক তৎপরতা চালানোর নির্দেশ দেন। 


ঢাকা নগরীতে ক্যাসিনোর ধারণা কলাবাগান ক্লাব থেকে শুরু হলেও এর নির্ভরযোগ্য আরেকটি জায়গা হয়ে দাড়ায় তেজগাঁওয়ের ফুওয়াং ক্লাব। মূলত তাইওয়ানিজদের একটি দল ২০০০ সালের দিকে এখানে পানশালা-কাম-রেস্তোরা চালু করে। পরে তাদের বিদায়ের পর বাংলাদেশীরা ক্যাসিনো চালাতে শুরু করে। বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার সাথে জড়িত ক্লাবগুলোতে চালু হয় ক্যাসিনো। এর ফলে ক্রিকেট বা ফুটবলের মতো খেলা ক্লাবগুলোর কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে ঢাকার কেসিনোগুলো পরিচালনার জন্য নেপাল থেকে প্রশিক্ষিত নারী ও নিরাপত্তা কর্মীও নিয়ে আসে কয়েকটি ক্যাসিনো।


পশ্চিমা হোক বা এশীয় হোক কোনো সমাজে জুয়া খেলাকে উৎসাহিত করা হয় না। ক্যাসিনোতে যেভাবে জুয়া খেলা হয় তাতে বহু মানুষ মুহুর্তের মধ্যে নি:স্ব হয়ে যায়। বিশে^র বহু দেশে ক্যাসিনো নিষিদ্ধ। এরমধ্যে পর্যটক নির্ভর অনেক দেশ আছে। যেমন ভুটান, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তানে ক্যাসিনো নিষিদ্ধ। আবার ইউরোপের দেশ আর্জেন্টিনা, লুক্্েরমবার্গে, মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান ও সৌদি আরবে ক্যাসিনো নিষিদ্ধ।  এ ধরনের খেলার মধ্যদিয়ে মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। জুয়া খেলাকে কেন্দ্র করে সংঘাত ও সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে থাকে। এ ধরনের ঝুকিপূর্ন ও সামাজিক বিপর্যয়কর কর্মকান্ড থেকে পারিবারিক সচেতনতা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।