পাঁচ মিনিটে এক লাখ শব্দ পড়া সম্ভব?

পাঁচ মিনিটে এক লাখ শব্দ পড়া সম্ভব?

ছবি: সংগৃহীত

ব্রিটেনের ড্যান হলোওয়ে হচ্ছেন ইউরোপের দ্রুততম পাঠক। ২০১৮ সালে ইউরোপে দ্রুত পঠনের যে প্রতিযোগিতা হয়েছে সেখানে তিনি প্রতি মিনিটে ১,৭০০ শব্দ পড়ে বিজয়ী হন।

তবে চীনের টিউশন সেন্টারগুলো বলছে, হলোওয়ের এই রেকর্ডটা চীনা ছেলেমেয়েদের কাছে কোন রেকর্ডই নয়, তারা এটা অনায়াসেই করতে পারে। এই টিউশন সেন্টারগুলো দাবি করছে তারা ছাত্র-ছাত্রীদের এমনভাবে তৈরি করতে পারে যে পাঁচ মিনিটেই পড়ে শেষ করতে পারে এক লাখ শব্দ।এসব টিউশন সেন্টারে যে কৌশল শেখানো হয় তার নাম 'কোয়ান্টাম স্পীড রিডিং।' এটি বেশ বিতর্কিত একটি পদ্ধতি। সম্প্রতি এই পদ্ধতিতে বই পড়ার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এতে দেখা যায় বই পড়ার প্রতিযোগিতায় ছেলে-মেয়েরা দ্রুত বইয়ের পাতা উল্টে যাচ্ছে।

স্পীড রিডিং নিয়ে প্রশ্নঃ

তাস খেলার সময় যেভাবে 'কার্ড শাফল' করা হয়, অনেকটা সেভাবেই দ্রুত বইয়ের পাতা উল্টে যেতে হয় এই প্রতিযোগিতায়। যারা এই কোয়ান্টাম স্পীড রিডিং শেখান, তারা মনে করেন, এভাবে দ্রুত বইয়ের পাতা উল্টে বইটির বিষয় সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয় পাঠকের মনে। তবে সমালোচকরা এই দ্রুত পঠন পদ্ধতিকে একটা 'জোচ্চুরি' বলে বর্ণনা করছেন। তারা বলছেন, এরকম 'দ্রুতপঠনে' যে আদৌ কিছু শেখা যায়, তার কোন ভিত্তি নেই।

এই দ্রুত পঠন প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে অনেক এলাকায় শিক্ষা কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থাও নিতে শুরু করেছেন। শেনঝেং এর শিক্ষা কর্তৃপক্ষ নির্দেশ জারি করেছেন যে, প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীরা 'কোয়ান্টাম স্পীড রিডিং' কোর্সে অংশ নিতে পারবে না। যারা এসব কোর্স চালায়, তাদের ব্যাপারেও তদন্ত শুরু হয়েছে।

দুশ্চিন্তা

কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, এ ধরনের 'দ্রুত পঠনের' প্রশিক্ষণ ভিত্তিহীন এবং বিভ্রান্তিকর। কিন্তু তারপরও কোয়ান্টাম স্পীড রিডিং এর কোর্স বেশ জনপ্রিয় হয়েছে কয়েকটি কারণে।লেখাপড়ায় ভালো ফল করার জন্য চীনের ছাত্র-ছাত্রীরা এবং তাদের বাবা-মারা খুবই উদগ্রীব। ভালো রেজাল্ট না করলে জীবনে অনেক ভালো সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন, এরকম একটা আশংকা তাদের মধ্যে খুব বেশি। একারণেই আসলে এ ধরনের একটি কোর্সে অনেকে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

জাপানি শিক্ষক ইউমিকো তোবিতানি প্রথম 'কোয়ান্টাস স্পীড রিডিং' পদ্ধতি চালু করেন। এই নিয়ে ২০০৬ সালে তিনি একটি বই প্রকাশ করেছিলেন চীনা গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, বেইজিং, শেনঝেং, গুয়াংজু এবং হাংজুর মতো শহরে অনেক টিউশন সেন্টার এখন স্পীড রিডিং কোর্স চালায়। চেংডুর একটি টিউশন সেন্টারের একজন প্রতিনিধি 'কভার নিউজ' বলে একটি ওয়েবসাইটকে জানিয়েছেন, এই কোর্সের ফি ৪,২০০ ডলার হতে ৮,৫০০ ডলার পর্যন্ত। তবে কোন কোন কোর্সের ফি প্রায় ১৪,০০০ ডলার পর্যন্ত।

তবে যে বাবা-মারা তাদের সন্তানদের এরকম কোর্সে ভর্তি করছেন, অনলাইনে তাদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ চলছে। বিশেষজ্ঞরাও এরকম স্পীড রিডিং এর কার্যকারিতা নিয়ে সন্দিহান।

বেইজিং এর 'টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের উপ-পরিচালক শিয়ং বিংকি বলেন, এই দ্রুত পঠন পদ্ধতির কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এটি শিক্ষা বিষয়ক সাধারণ বোধ-বুদ্ধিরও বিপক্ষে যায়।"কিন্তু তারপরও এই কোয়ান্টাম স্পীড রিডিং পদ্ধতি চীনে জনপ্রিয় হয়েছে, কারণ বাবা-মারা চান ছেলে-মেয়েরা যে কোন ভাবে সফল হোক। সেজন্যে তারা এখন সাফল্যের 'শর্টকাট' উপায় খুঁজছেন।"

২০১৮ সালে চীনের একটি পত্রিকা 'চায়না ইয়ুথ ডেইলি' এধরনেরই আরেকটি রিডিং কোর্সের নামে জোচ্চুরি চলছে বলে একটি খবর ফাঁস করেছিল। এই পদ্ধতির নাম ছিল 'ব্লাইন্ডফোল্ডেড রিডিং' বা চোখবেঁধে দ্রুত পঠন।টিউশন সেন্টারগুলো দাবি করতো, এই পদ্ধতিতে 'অডিও ব্রেইনওয়েভ রেজোনেন্স' বা শব্দ তরঙ্গ পাঠিয়ে মস্তিস্কের কিছু গ্ল্যান্ডকে সক্রিয় করা হয়। এর ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা যে কোন বিষয়, শব্দ বা প্যাটার্ন সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করতে পারে।

শিয়ং বিংকির মতে, চীনের বাবা -মায়েরা স্বপ্ন দেখেন তাদের ছেলেরা তাক লাগানো কোন সাফল্য দেখাবে। ছেলে-মেয়েরা রাতারাতি যাতে কোন ধরনের 'সুপারপাওয়ার' অর্জন করতে পারে, সেজন্যে তারা যা খুশি অর্থ খরচ করতেও রাজী।"বাবা-মাদের দুশ্চিন্তা হচ্ছে একবারও যদি ছেলে-মেয়েরা কোন সুযোগ হাতছাড়া করে, তাহলেই তারা পেছনে পড়ে যাবে।"

"যারা ছেলে-মেয়েদের কোয়ান্টাম স্পীড-রিডিং কোর্সে পাঠাচ্ছে, তাদের মনেও হয়তো সন্দেহ আছে। কিন্তু তারপরও এটি কাজ করতে পারে এমন চিন্তাও তাদের মধ্যে কাজ করে। অন্য সবাই যখন এই কোর্স করছে, তখন আমার সন্তান না করলে ও পিছিয়ে পড়বে, এটাই তাদের দুশ্চিন্তা।"

বিজ্ঞান সাক্ষরতার হার

বিজ্ঞান বিষয়ে মানুষের অজ্ঞতাও এটার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন চীনের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল সায়েন্সের গবেষক চু ঝাওহুই।চীনে বিজ্ঞান সাক্ষরতার হার নিয়ে ২০১৮ সালে যে জরিপ হয়, তাতে দেখা যায় জনসংখ্যার মাত্র ৮ দশমিক ৫ শতাংশের এরকম সাক্ষরতা আছে।বিজ্ঞান সাক্ষরতার মানে হচ্ছে বিজ্ঞান বিষয়ক বিষয়গুলো নিয়ে সচেতনভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে পারার ক্ষমতা।

"প্রতারিত হওয়া বাবা-মাদের অনেকেই এটা বিশ্বাস করেছেন যে বইয়ে ছাপানো তথ্য কোয়ান্টাম মেথডের মাধ্যমে মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দেয়া সম্ভব। কিন্তু এটা একেবারেই সম্ভব নয়।"কিন্তু শর্টকাট রাস্তায় জ্ঞান অর্জনের এই ফাঁদে যেন বাবা-মায়েরা পা না দেন, কিভাবে তা নিশ্চিত করা সম্ভব?

শিয়ং বিংকি মনে করেন, এজন্যে চীনের টিউশন সেন্টারগুলোকে নিয়ম-নীতির অধীনে এনে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। কারণ কোয়ান্টাম স্পীড-রিডিং প্রশিক্ষণ যারা দিচ্ছে, তাদের বেশিরভাগ শিক্ষা বিষয়ক কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধিত।আর চীনে শিক্ষার মূল্যায়ন যেভাবে করা হয়, সেটারও সংস্কার দরকার, বলছেন তিনি।-সূত্র:বিবিসি