শিশুদের ইসলাম পালন : পিতা-মাতার দায়িত্ব-কর্তব্য

শিশুদের ইসলাম পালন : পিতা-মাতার দায়িত্ব-কর্তব্য

ফাইল ছবি

ড. মো: হাবিবুর রহমান

আল্লাহ তাআলা হযরত আদম (আ.) হতে মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন। এরপরে তার মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে মানুষকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً

“হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক নফ্স  থেকে। আর তা থেকে সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে এবং তাদের থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী।” (সূরা আন-নিসা-১)

মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া প্রত্যেক শিশুই একজন মুসলিম হিসেবে জন্ম গ্রহণ করে। এর পরে তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদী, খৃষ্টান অথবা অগ্নি উপাসক বানায়। এ সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেন,

كُلُّ مَوْلُودٍ يُولَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ، أَوْ يُنَصِّرَانِهِ، أَوْ يُمَجِّسَانِهِ كَمَثَلِ الْبَهِيمَةِ تُنْتَجُ الْبَهِيمَةَ هَلْ تَرَى فِيهَا جَدْعَاءَ.

“প্রতিটি নবজাত শিশু ফিতরাত তথা ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করে, তারপর তার পিতা তাকে ইয়াহুদি বানায়, খ্রিষ্টান বানায়, অথবা অগ্নি-উপাসক বানায়। যেমন, চতুষ্পদ জন্তু সে একটি জন্তু জন্ম দেয়, কিন্তু তার মধ্যে কোনটিকেই তুমি কান কাটা দেখতে পাবে না।” (সহীহ আল-বুখারী) আলোচ্য প্রবন্ধে শিশুদের ইসলাম পালনের পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ

জন্মের সময় আল্লাহর একত্ববাদের আওয়াজ শুনানো:

একজন শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে সে পুত্রসন্তান হোক আর কন্যাসন্তান হোক সর্ব প্রথম তার কানে আল্লাহর একত্ববাদের ধ্বনি পৌঁছে দেওয়া বা কানে আজানের ধ্বনি শ্রবণ করিয়ে দেওয়া অভিভাবকের দায়িত্ব। এর পরে যখন কথা বলতে শিখবে তখন তাকে  لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ  مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللهِ “আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল” বাক্য দ্বারা কথা শিখানো। আর শিশুরা যখন বড় হবে তখন তাদের এই কালিমার অর্থ শেখাতে হবে। ইসলামের মুল বুনিয়াদ হলো কালেমা, এর মধ্যে ইসলামের মৌলিক আকিদা বিদ্যমান রয়েছে। একই সাথে জীবনের শুরুতেই শিশুর অন্তরে আল্লাহর মহাব্বত এবং আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানের বীজ বপন করে দিতে হবে। আল্লাহই আমাদের স্রষ্টা, রিযিকদাতা ও আমাদের সাহায্যকারী; তিনি একক তার কোন শরীক নেই এই বিশ্বাসটা বদ্ধমুল করে দিতে হবে।

শিশুদের এ কথা শিখিয়ে দেওয়া যে, তারা যেন সব সময় সবকিছু আল্লাহর নিকটই চায় এবং সাহায্যের প্রয়োজন হলে, আল্লাহর নিকটই চায়। কারণ রাসুল (সা.) তার চাচাতো ভাই আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসকে শিক্ষা দিতে গিয়ে বলেন,

إِذَا سَأَلْتَ فَاسْأَلِ اللَّهَ وَإِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ

 “যখন কোন কিছু চাইবে তখন তুমি আল্লাহর নিকট চাইবে, আর যখন কোন সাহায্য চাইবে তখনও আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইবে।” (সূনান আত-তিরমিযী)

সুন্দর অর্থবহ নাম রাখা:

শিশু জন্ম গ্রহনের পরে পিতা-মাতার দায়িত্ব হচ্ছে ইসলামের নির্দেশিত পন্থায় অর্থবহ সুন্দর একটা নাম রাখা। এ ব্যাপারে রাসূল (সা.) বলেছেন, سَمُّوا بِاسْمِي ، وَلاَ تَكْتَنُوا بِكُنْيَتِي “তোমরা আমার নামে নাম রাখো, আমার কুনিয়াতে (উপনামে) কুনিয়াত রেখো না।” (সহীহ আল-বুখারী)

যদি সম্ভব হয় আব্দুল্লাহ ও আবদুর রহমান নামের সাথে মিলিয়ে নাম রাখা। আল-হাদীসে এ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, 

عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم-  أَحَبُّ الأَسْمَاءِ إِلَى اللَّهِ تَعَالَى عَبْدُ اللَّهِ وَعَبْدُ الرَّحْمَنِ

“হযরত ইবনে ওমর (রা.) হতে বর্নিথ তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় নাম হচ্ছে আবদুল্লাহ ও আবদুর রহমান।” (সূনান আবু দাউদ ও তিরমিযি)

শিশুর আকিকা করা:

আকিকা হচ্ছে জানের সদকা হিসেবে জীব কুরবানী করা। ইসলামের পরিভাষায় আকিকার অর্থ: আল্লাহর শুকরিয়া আদায় ও আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আল্লাহর রাস্তায় পশু জবাই করা। এ প্রসংঙ্গে আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ « كُلُّ غُلاَمٍ رَهِينَةٌ بِعَقِيقَتِهِ تُذْبَحُ عَنْهُ يَوْمَ سَابِعِهِ وَيُحْلَقُ وَيُسَمَّى  “রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, নবজাতক শিশু ভুমিষ্ট হওয়ার পর সর্বপ্রথম জন্মের ৭ম দিনে আকিকার উদ্দেশ্যে তার পক্ষ থেকে পশু জবেহ্ করবে। তারপর মাথা মুন্ডাবে (নেড়া করবে) ও নাম রাখবে।” (সূনান আবু দাউদ ও নাসয়ী)

কয়টি পশু জবেহ্ করতে হবে এ সম্পর্কে আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

سُئِلَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- عَنِ الْعَقِيقَةِ َقَالَ « مَنْ وُلِدَ لَهُ وَلَدٌ فَأَحَبَّ أَنْ يَنْسُكَ عَنْهُ فَلْيَنْسُكْ عَنِ الْغُلاَمِ شَاتَانِ مُكَافِئَتَانِ وَعَنِ الْجَارِيَةِ شَاةٌ

“আকীকা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নিকট জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি বলেন, যার সন্তান জন্ম গ্রহণ করবে তার জন্য উত্তম হলো পশু জবেহ্ করা (আকীকা করা) পুত্র সন্তানের ক্ষেত্রে দুটি ছাগল ও কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে একটি ছাগল জবেহ্ করতে হবে।” (সূনান আবু দাউদ ও মুসনাদে আহমদ)

কুরবানীর গোশতের ন্যায় আকীকার গোশত্ তিন ভাগে ভাগ করা মুস্তাহাব, এক ভাগ নিজেদের জন্য ২য় ভাগ আত্মিয়-স্বজনের জন্য ৩য় ভাগ দরিদ্রদের জন্য। আকিকার গোশত্ মা-বাবাসহ সবাই খেতে পারবে।

পরকালীণ শাস্তি সম্পর্কে শিশুদের সতর্ক করা:

একজন শিশু জন্মগ্রহন করার সাথে সাথে পিতা-মাতার কিছু দায়িত্ব এসে যায়। এ দায়িত্বসমূহ সঠিকভাবে পালন করলেই কেবল একজন শিশু সত্যিকার মানুষ হিসেবে গোড়ে ওঠে। এই শিশুরাই পরিবারের সদস্য বা আহল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। এই আহলদেরকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করা পিতা-মাতার দায়িত্ব। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বলা হয়েছে, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا “হে ঈমানদারগণ তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে ও তোমাদের পরিবারদেরকে জাহান্নামের আগুন হতে রক্ষা কর।” (সূরা আত-তাহরীম-৬)

আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, পিতা-মাতা, অভিভাবকদের নতুন প্রজন্মের শিশু, কিশোর ও যুবকদের শিক্ষা-দীক্ষা বিষয়ে অবশ্যই আল্লাহর সম্মুখে জবাবদিহি করতে হবে। যদি তাদের ভালো শিক্ষা দেওয়া হয় তাহলে দুনিয়া ও আখিরাতে তারা সফল হবে এবং নতুন প্রজন্মও সফল হবে। আর যদি তাদের সঠিক শিক্ষা না দেওয়া হয় তাহলে নতুন প্রজন্ম তার পরিণতি ভোগ করবে এবং অভিভাবকদের জবাবদিহি করতে হবে। আল-হাদীসে বলা হয়েছে, كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ. “তামরা সবাই দায়িত্বশীল, আর তোমাদের সবাইকে তোমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।” (সহীহ আল-বুখারী)

তাই দায়িত্বের কারনেই নতুন প্রজন্মকে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আনার জন্য চেষ্টা করতে হবে। এর সুফল সম্পর্কে আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, فَوَاللَّهِ لأَنْ يَهْدِيَ اللَّهُ بِكَ رَجُلاً خَيْرٌ لَكَ مِنْ أَنْ يَكُونَ لَكَ حُمْرُ النَّعَمِ “তোমার দ্বারা যদি একজন মানুষকেও হেদায়েত দেয়া হয়, তা তোমার জন্য আরবের সবচেয়ে মূল্যবান উট লাল হতেও উত্তম।” (সহীহ আল-বুখারী)

শিশুদের র্শিক থেকে মুক্ত রাখতে হবে:

ছোট থেকেই শিশুদের শিরক থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে। শিরক সবচেয়ে বড় গুনাহ সেটা সম্পর্কে তাদের অবহিত করতে হবে। হযরত লুকমান (আ.) তাঁর পুত্রকে র্শিক থেকে মুক্ত থাকার পরামর্শ দিয়ে বলেন, আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,

وَإِذْ قَالَ لُقْمَانُ لِابْنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ

 “আর স্মরণ কর, যখন লুকমান তার পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিল, ‘প্রিয় বৎস, আল্লাহর সাথে র্শিক করো না; নিশ্চয় র্শিক হল বড় যুল্ম’।” (সূরা লুকমান-১৩)

আল্লাহর সাথে শিরক করা হতে শিশুদের বিরত রাখতে হবে। যেমন- মহান আল্লাহকে বাদ দিয়ে কোন মৃত ব্যক্তির নিকট প্রার্থনা করা, তাদের নিকট সাহায্য চাওয়া ও আরোগ্য লাভের জন্য তাদের নিকট সাহায্য চাওয়া। তারাও মহান আল্লাহরই সৃষ্ট বান্দা, তাদের কোন ক্ষতি বা উপকার করার ক্ষমতা নেই। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَلاَ تَدْعُ مِن دُونِ اللّهِ مَا لاَ يَنفَعُكَ وَلاَ يَضُرُّكَ فَإِن فَعَلْتَ فَإِنَّكَ إِذًا مِّنَ الظَّالِمِينَ

 “আর আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কোন বস্তুকে ডেকো না; যা তোমার উপকার ও ক্ষতি করতে পারে না। তারপরও যদি তুমি তাই কর, তখন অবশ্যই তুমি যালিমদের অন্তর্ভক্ত হবে।” (সূরা ইউনূচ-১০৬)

শিরক সবচেয়ে বড় অপরাধ এটা সম্পর্কে শিশুদের অবহিত করতে হবে। এ সম্পর্কে আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ ، قَالَ : سَأَلْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم أَيُّ الذَّنْبِ أَعْظَمُ عِنْدَ اللهِ قَالَ : أَنْ تَجْعَلَ لِلَّهِ نِدًّا وَهْوَ خَلَقَكَ قُلْتُ إِنَّ ذَلِكَ لَعَظِيمٌ قُلْتُ ثُمَّ أَىّ قَالَ ثُمَّ أَنْ تَقْتُلَ وَلَدَكَ تَخَافُ أَنْ يَطْعَمَ مَعَكَ قُلْتُ ثُمَّ أَىّ قَالَ ثُمَّ أَنْ تُزَانِيَ بِحَلِيلَةِ جَارِكَ.

 “হযরত আব্দুল্লাহ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী (সা.) কে বললাম, সবচেয়ে মারাত্মক অপরাধ কি? উত্তরে তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা, যে আল্লাহ তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।” আমি বললাম, তারপর মারাত্মক অপরাধ কোনটি? তিনি বললেন, ‘তোমার সন্তান তোমার সাথে খাবে এ ভয়ে তুমি তাকে হত্যা করলে।’ আমি বললাম, তারপর মারাত্মক অপরাধ কোনটি? তিনি বললেন, ‘তুমি তোমার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার করলে।” (সহীহ আল-বুখারী ও মুসলিম)

কুফর ও অনৈতিকতা থেকে শিশুদের বিরত রাখা:

পিতা-মাতার দায়িত্ব হচ্ছে শিশু যখন বড় হবে তখন তাদের কুফর, গালি দেওয়া, অভিশাপ দেওয়া ও অনৈতিক কথা-বার্তা বলা হতে বিরত থাকার শিক্ষা দেওয়া। তাদেরকে এসকল কাজের খারাপ পরিণাম সম্পর্কে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দেওয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন,

يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَكُمُ الرَّسُولُ بِالْحَقِّ مِنْ رَبِّكُمْ فَآمِنُوا خَيْرًا لَكُمْ وَإِنْ تَكْفُرُوا فَإِنَّ لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَكَانَ اللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا

 “হে মানুষ, অবশ্যই তোমাদের নিকট রাসূল এসেছে, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে সত্য নিয়ে। সুতরাং তোমরা ঈমান আন, তা তোমাদের জন্য উত্তম হবে। আর যদি কুফরী কর, তবে নিশ্চয় আসমানসমূহ ও যমীনে যা রয়েছে, তা আল্লাহর জন্যই এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।” (সূরা আন-নিসা-১৭০)

নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত রাখা:

মদ, জুয়া, লটারি, তাসখেলা ইত্যাদি হতে শিশুদের দূরে রাখতে হবে, কখনোই তাদের সামনে এগুলো পেশ করা যাবে না, যদিও এগুলো তাদের সান্তনা বা খুশি করার জন্য হয়। কারণ এগুলো নিয়ে খেলতে খেলতে একসময় এর প্রতি সে আসক্ত হয়ে যাবে। এসকল নিষিদ্ধ জিনিস মানুষকে খারাপের দিকে নিয়ে যায় এবং মানুষের মধ্যে রেষারেষি ও দুশমনি সৃষ্টি করে। এগুলো শিশুদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর, এগুলোর কারণে তাদের সময় নষ্ট, মালামাল অপচয়, পড়ালেখার ক্ষতির কারণ হয়। এ সকল কাজ থেকে দূরে থাকার জন্য আল্লাহ নির্দেশ দিয়ে বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

 “হে মুমিনগণ, নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।” (সূরা মায়েদা-৯০)

শিশুরা যাতে অশ্লীল সিনেমা, টেলিভিশন ও সিডি, ইউটিউব চ্যানেল না দেখে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। তাদেরকে অশ্লীল পত্র-পত্রিকা, উলঙ্গ ছবি সম্বলিত ম্যাগাজিন, মিথ্যা বানোয়াট গোয়েন্দা উপন্যাস বা গল্পের বই পড়া হতে অবশ্যই বিরত রাখতে হবে। কারণ এগুলো তাদের আখলাক-চরিত্র ও নীতি-নৈতিকতাকে নিঃশেষ করে দেবে।

পিতা-মাতার হক সম্পর্কে অবগত করানো:

শিশুরা যখন বুঝতে শিখবে তখন তাদেরকে পিতা-মাতার হক সম্পর্কে অবহিত করাতে হবে। আল্লাহ তাআলা তাঁর ইবাদতের পরেই পিতা-মাতার প্রতি সদাচার করার ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا

 “আর তোমার রব আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করবে না এবং পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করবে।” (সূরা বনি ইসরাইল-২৩)

শিশুকে শিক্ষা দিতে হবে, পিতা-মাতাকে গালি দেওয়া যাবে না। ইসলামে এটা হারাম এবং কবিরা গুনাহ। রাসূল (সা.) বলেন,

إِنَّ مِنْ أَكْبَرِ الْكَبَائِرِ أَنْ يَلْعَنَ الرَّجُلُ وَالِدَيْهِ قِيلَ يَا رَسُولَ اللهِ وَكَيْفَ يَلْعَنُ الرَّجُلُ وَالِدَيْهِ قَالَ يَسُبُّ الرَّجُلُ أَبَا الرَّجُلِ فَيَسُبُّ أَبَاهُ وَيَسُبُّ أَمَّهُ.

 “কবিরা গুনাহের একটি বড় ধরনের কবিরা গুনাহ হল, কোন লোক তার মাতা-পিতাকে গালি দেওয়া। প্রশ্ন করা হলো হে আল্লাহর রাসূল (সা.) একজন কিভাবে পিতা-মাতাকে গালি দেয়? রাসূল (সা.) জবাবে বলেন, যখন সে কোন লোকের পিতাকে গালি দিল, তখন লোকটিও তার পিতাকে গালি দিল অথবা সে অন্যের মাকে গালি দিল এবং সে লোকও তার মাকে গালি দিল।” (সহীহ আল-বুখারী ও মুসলিম)

পিতা-মাতার মধ্যে মায়ের অধিকার আল্লাহ তাআলা একটু বেশী দিয়েছেন এ সম্পর্কে অবহিত করা। এ সম্পর্কে আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ جَاءَ رَجُلٌ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- فَقَالَ مَنْ أَحَقُّ النَّاسِ بِحُسْنِ صَحَابَتِى قَالَ ª أُمُّكَ ». قَالَ ثُمَّ مَنْ قَالَ ª ثُمَّ أُمُّكَ ». قَالَ ثُمَّ مَنْ قَالَ ª ثُمَّ أُمُّكَ ». قَالَ ثُمَّ مَنْ قَالَ ª ثُمَّ أَبُوكَ »

 “হযরত আবু হুরাইয়রা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূল (সা.) এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি সর্বোত্তম ব্যবহার কার সাথে করব? তিনি বললেন, “তোমার মায়ের সাথে।” সে বলল, তারপর কার সাথে? তিনি বললেন, “তোমার মায়ের সাথে।” তারপর লোকটি বলল, তারপর কার সাথে? তিনি বললেন, “তোমার মায়ের সাথে।” সে বলল, তারপর কার সাথে? তিনি বললেন, “তোমার পিতার সাথে।” (সহীহ মুসলিম)

ইনসাফ প্রতিষ্ঠার শিক্ষা দেওয়া:

কারো একাধিক সন্তান থাকলে তাদের মধ্যে ইনসাফের শিক্ষা দেওয়া এবং নিজের জীবনে তাদের মাঝে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,

إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا وَإِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ أَنْ تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِ

 “নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিচ্ছেন আমানতসমূহ তার হকদারদের কাছে পৌঁছে দিতে। আর যখন মানুষের মধ্যে ফয়সালা করবে তখন ন্যায়ভিত্তিক ফয়সালা করবে।” (সূরা আন-নিসা-৫৮)

আল-কুরআনে আরো বর্ণিত হয়েছে,

اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى

“তোমরা ইনসাফ করো কারণ এটা তাকওয়ার নিকটবর্তী” (সূরা আল-মায়েদা-৮)

ইনসাফ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে রাসূল (সা.) বলেন,, اتقوا الله وأعدلوا في أولادكم “তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমাদের সন্তানদের বিষয়ে ইনসাফ কর।” (সহীহ আল-বুখারী ও মুসলিম)

সত্য কথা বলা ও সত্য পথে চলার শিক্ষা দেওয়া:

শিশুদের সত্য কথা বলা ও সত্য পথে চলার জন্য অভ্যস্ত করাতে হবে। ঠাট্টা-বিদ্রুপ, চালাকী করে হলেও তাদের সামনে মিথ্যা কথা বলা যাবে না। আর যখন তাদের কোন ওয়াদা দেবে তা পূরণ করতে হবে। সদা সত্য কথা বলা, সত্য পথে থাকার ব্যাপারে রাসূল (সা.) নসিহত করে বলেছেন,

  إِنَّ الصِّدْقَ يَهْدِي إِلَى الْبِرِّ وَإِنَّ الْبِرَّ يَهْدِي إِلَى الْجَنَّةِ

“নিশ্চয় সত্য ন্যায়পরায়ণ পথ দেখায়, আর ন্যায়পরায়ণতা জান্নাতের পথ দেখায়।” (সহীহ আল-বুখারী)

মুনাফিকের আলামত সম্পর্কে আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে ,

آيَةُ الْمُنَافِقِ ثَلاَثٌ إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ ، وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ ، وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ “মুনাফিকের আলামত তিনটি: যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, আর যখন ওয়াদা করে খেলাফ করে, আর যখন তার নিকট আমানত রাখা হয়, তখন সে তার খেয়ানত করে।” (সহীহ আল-বুখারী ও মুসলিম)

সালাত কীভাবে আদায় করতে হয় তা শিক্ষা দেওয়া:

শিশু ছেলে-মেয়েদের ছোট বেলাতেই সালাত কীভাবে আদায় করতে হয় তা শিক্ষা দিতে হবে, যাতে বড় হলে সালাত আদায় করতে অভ্যস্ত হয়। এ সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেন ,

علموا أولادكم الصلاة إذا بلغوا سبعاً ، واضربوهم عليها إذا بلغوا عشرا، وفرقوا بينهم في المضاجع

 “তোমরা তোমাদের শিশুদের সাত বছর বয়সে সালাতের তালীম দাও। আর যখন দশ বছর হয়, তখন তোমরা তাদের সালাত আদায় না করার কারণে প্রহার কর। আর তোমরা তাদের বিছানা আলাদা করে দাও।” (আল-জামে আস-সহীহ)

শিশুদের সালাত আদায়ের নিয়ম-কানূন শিখানো মাতা-পিতা ও অভিভাবকদের নৈতিক দায়িত্ব। তাদের ওজু করে দেখাতে হবে, তাদের সামনে সালাত আদায় করে শিখাতে হবে। তাদের নিয়ে মসজিদে যেতে হবে এবং নামাজের পাবন্দিতে মনোনিবেশ করাতে হবে। জুমআার সালাতে যাওয়ার সময় শিশুদের সাথে নিয়ে মসজিদে উপস্থিত হওয়া দরকার। শিশুদেরকে মসজিদে সালাতের জামায়াতে উপস্থিত হতে উৎসাহ প্রদান করা প্রয়োজন। তারা মসজিদে গিয়ে যদি কোন ভুল করে, তবে তাদের খুব যতœ সহকারে বুঝিয়ে বলতে হবে। তাদের কোন প্রকার ধমক দেওয়া যাবে না, তাদের সাথে চেঁচামেচি করে কথা বলা যাবেনা।

কুরআন শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করা:

শিশুদের কুরআন শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রথমে সূরা ফাতেহা শিক্ষা দিতে হবে। তারপর ছোট ছোট সূরা গুলো শিক্ষা দিতে হবে। সালাতে পড়ার জন্য আত্-তাহিয়্যাতু শেখাতে হবে। আর যদি মাতা-পিতা সময় না পায়, তবে তাদের জন্য বিশুদ্ধ কুরআন শিক্ষা, কুরআন হিফয করা ও হাদীস মুখস্থ করা ইত্যাদির জন্য একজন শিক্ষকের ব্যবস্থা করতে হবে। এ সম্পর্কে আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

يَا أَيُّهَا النَّاسُ : عَلِّمُوا أَوْلاَدَكُمْ وَأَهَالِيَكُمُ الْقُرْآنَ

 “হে মানব সকল তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে এবং আহলদেরকে কুরআন শিক্ষা দাও।” (সূনান সাইদ ইবনে মানসুর) 

রাসূল (সা.) আরো বলেন,

تَعَلَّمُوا الْقُرْآنَ وَالْفَرَائِضَ وَعَلِّمُوهُ النَّاسَ فَإِنِّي مَقْبُوضٌ

 “তোমরা কুরআন ও ফারায়েজ (উত্তারাধিকার আইন) জানো এবং মানুষকে শিক্ষা দাও। কারণ আমাকে উঠিয়ে নেওয়া হবে।” (সূনান আত-তিরমিযি)

ব্যবহারিক জীবনে পর্দা মেনে চলার জন্য উৎসাহ দেয়া:

ছাট ছেলে-মেয়েদের শিশুবেলা থেকেই পর্দা করার প্রতি উৎসাহ প্রদান করতে হবে, যাতে তারা বড় হলে পর্দার অপরিহার্যতা বুঝতে পারে। পর্দার বিধান সম্পর্কে আল-কুরআনে বলা হয়েছে,

قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكَى لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ

 “মু’মিন পুরুষদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয় তারা যা করে সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত।” (সূরা আন-নূর-৩০)

পোশাক পরিধানের ব্যাপারে তাদের কখনোই ছোট বা পাতলা কাপড় পরিধান করানো যাবে না এবং মেয়েদের পুরুষদের মত কাপড় পরিধান না করানো, কারণ এটা হলো কাফের-বেদ্বীনদের স্বভাব, যা ইসলামে হারাম।

মেয়েদের বয়স যখন সাত বছর হবে তখন থেকেই তাদের বাধ্য করতে হবে যাতে তারা মাথাকে ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখে। আর যখন সে প্রাপ্তবয়স্ক হবে তখন তাকে অবশ্যই চেহারাও ঢেকে রাখার শিক্ষা দিতে হবে। বোরকা পরার জন্য তাদের নির্দেশ দিতে হবে। আল-কুরআন সব নারীদের পর্দা করার প্রতি উদাত্ত আহ্বান করে বলেছে,

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُل لِّأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاء الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِن جَلَابِيبِهِنَّ ذَلِكَ أَدْنَى أَن يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَّحِيمًا

 “হে নবী, তুমি তোমার স্ত্রীদেরকে কন্যাদেরকে ও মুমিনদেরকে বল, তারা যেন তাদের জিল-বাবের কিছু অংশ নিজদের উপর ঝুলিয়ে দেয়, তাদেরকে চেনার ব্যাপারে এটাই সবচেয়ে কাছাকাছি পন্থা হবে। ফলে তাদেরকে কষ্ট দেয়া হবে না। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।” (সূরা আল-আহযাব-৫৯)

আল্লাহ তা‘আলা নারীদের জাহিলিয়্যাতের যুগের মত সাজ-সজ্জা অবলম্বন করতে এবং ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করেছেন। আল-কুরআনে বলা হয়েছে,

وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى  .

 “আর তোমরা তোমাদের নিজ গৃহে অবস্থান করবে এবং প্রাক-জাহেলী যুগের মত সৌন্দর্য প্রদর্শন করো না।” (সূরা আল-আহযাব: ৩২-৩৩)

আদব-আখলাক শিক্ষা দেয়া:

আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ কর্ণধর তাই শিশুদের উত্তম আচার-ব্যবহার ও চারিত্রিক গুনাবলী শিক্ষা দিতে হবে। রাসূল (সা.) ছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চরিত্রের অধিকারী। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ “আর নিশ্চয় তুমি মহান চরিত্রের উপর অধিষ্ঠিত।” (সূরা কলম-৪)

আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ : لَمْ يَكُنِ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم فَاحِشًا ، وَلاَ مُتَفَحِّشًا ، وَكَانَ يَقُولُ : إِنَّ مِنْ خِيَارِكُمْ أَحْسَنَكُمْ أَخْلاَقًا.

 “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সা.) কখনো কোনো নির্লজ্জ কথা মুখে আনতেন না, নির্লজ্জ কাজ-কর্মও করতেন না। তিনি বলতেন, তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে চরিত্রের দিক দিয়ে উত্তম।” (সহীহ আল-বুখারী ও মুসলিম)

রাসূল (সা.) বলেন, بُعِثْتُ لأُتَمِّمَ مَكَارِمَ الأَخْلاَقِ “আমি প্রেরিত হয়েছি সর্বোত্তম চরিত্রের পূর্ণতা সাধনের জন্য।” (মুয়াত্তা মালেক)

অন্য হাদীসে আরো বর্ণিত হয়েছে, إنما بعثت لأتمم صالح الأخلاق “আমি উত্তম চরিত্রের সৌন্দর্যকে নিঁখুত ও পরিপূর্ণতা বিধানের জন্য আবির্ভূত হয়েছি।” (মুসনাদ আহমদ)

রাসূল (সা.) এর উম্মত হিসেবে আমাদের সন্তানদেরকে সর্বোত্তম চারিত্রিক গুনাবলীতে ভুষিত করার জন্য ছোট থেকেই তাদের চরিত্রবান হওয়ার নৈতিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

পানাহারের নীতি শিক্ষা দেওয়া:

শিশু যখন বড় হবে তখন তাকে ইসলামী পানাহার পদ্ধতি শিক্ষা দিতে হবে। তাদের খানা-পিনা, দেওয়া-নেওয়া ইত্যাদিতে ডান হাত ব্যবহার করার অভ্যাস করাতে হবে। খাওয়া-দাওয়া দাঁড়িয়ে না করার শিক্ষা দিতে হবে। পানাহারের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ পড়া, আর শেষে ‘আলহামদু-লিল্লাহ’ বলতে শিক্ষা দিতে হবে। আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ أَبِى سَعِيدٍ الْخُدْرِىِّ أَنَّ النَّبِىَّ -صلى الله عليه وسلم- كَانَ إِذَا فَرَغَ مِنْ طَعَامِهِ قَالَ « الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِى أَطْعَمَنَا وَسَقَانَا وَجَعَلَنَا مُسْلِمِينَ ».

 “হযরত আবু সাঈদ খুদরী হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) যখন পানাহার শেষ করতেন তখন তিনি বলতেন, সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি আমাদের খাওয়ালেন এবং প্রশান্তি দিলেন, এবং মুসলমানদের মধ্যে শামিল করেছেন।” (সূনান আবু দাউদ)

শয়নের নিয়ম-কানুন শিক্ষা দেওয়া:

প্রতিটি শিশুর জন্য বিছানা আলাদা করে দেওয়ার জন্য যথা সম্ভব চেষ্টা করতে হবে। আর তা যদি সম্ভব না হয়, কমপক্ষে প্রত্যেকের জন্য আলাদা কাথা-কম্বল ও লেপের ব্যবস্থা করতে হবে। আর উত্তম হলো, মেয়েদের জন্য একটি কামরা আর ছেলেদের জন্য একটি কামরা নির্ধারণ করে দেওয়া, যাতে তাদের চরিত্র ভালো ও কলঙ্কমুক্ত থাকে। শয়নের দোয়া ও ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার দোয়া শিক্ষা দিতে হবে। আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ حُذَيْفَةَ قَالَ كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم إِذَا أَرَادَ أَنْ يَنَامَ قَالَ بِاسْمِكَ اللَّهُمَّ أَمُوتُ وَأَحْيَا ، وَإِذَا اسْتَيْقَظَ مِنْ مَنَامِهِ قَالَ الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَحْيَانَا بَعْدَ مَا أَمَاتَنَا وَإِلَيْهِ النُّشُور.

 “হযরত হুজায়ফা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা.) যখন ঘুমের ইচ্ছা করতেন তখন বলতেন, হে আল্লাহ আমি তোমর নামে মৃত্যু বরণ করি এবং তোমার নামে জীবিত হই। আবার যখন ঘুম থেকে জাগ্রত হতেন তখন বলতেন, সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি আমাকে মৃত্যুর পরে জীবিত করেছেন এবং তার কাছেই আমাদের প্রত্যাবর্তন।” (সহীহ আল-বুখারী)

শিশুদের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন করা:

শিশুদের মাঝে যে কোন জিনিস সমানভাবে বন্টন করে দেওয়া অভিভাবকের দায়িত্ব। এর মাধ্যমে তাদের মধ্যেও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার মানসিকতা তৈরী হবে। আল-হাদীসে বলা হয়েছে,

عَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيرٍ قَالَ تَصَدَّقَ عَلَىَّ أَبِى بِبَعْضِ مَالِهِ فَقَالَتْ أُمِّى عَمْرَةُ بِنْتُ رَوَاحَةَ لاَ أَرْضَى حَتَّى تُشْهِدَ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم-. فَانْطَلَقَ أَبِى إِلَى النَّبِىِّ -صلى الله عليه وسلم- لِيُشْهِدَهُ عَلَى صَدَقَتِى فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- « أَفَعَلْتَ هَذَا بِوَلَدِكَ كُلِّهِمْ ». قَالَ لاَ. قَالَ « اتَّقُوا اللَّهَ وَاعْدِلُوا فِى أَوْلاَدِكُمْ -

 “নোমান ইবনে বাশীর (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার পিতা তার সম্পত্তির কিছু অংশ আমাকে দান করে দেন, তখন আমার মা উমরা বিনতে রাওয়াহা বললেন, রাসূল (সা.)কে জানানো ছাড়া আমি আমার সদকার উপর রাজি হব না। তারপর বিষয়টি রাসূল (সা.)কে জানানো হলো। তিনি জানার পর বললেন, তুমি তোমার সব সন্তানদের কি এভাবে দান করেছ? সে বললো, না, তারপর তিনি বললেন, আল্লাহকে ভয় কর এবং সন্তানদের মাঝে ইনসাফ কর।” (সহীহ আল-বুখারী ও মুসলিম)

ইনসাফপূর্ণ ফয়সালা ও দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে রাসূল (সা.) বলেন,

كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ الإِمَامُ رَاعٍ وَمَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ وَالرَّجُلُ رَاعٍ فِي أَهْلِهِ وَهْوَ مَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ فِي بَيْتِ زَوْجِهَا وَمَسْؤُولَةٌ عَنْ رَعِيَّتِهَا وَالْخَادِمُ رَاعٍ فِي مَالِ سَيِّدِهِ وَمَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ-

 “তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল! তোমাদের সকলকে তোমাদের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। একজন ইমাম সে অবশ্যই একজন দায়িত্বশীল, তাকে অবশ্যই তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। একজন পরিবারের কর্তা সে তার পরিবারের দায়িত্বশীল। তাকে অবশ্যই তার পরিবারের যারা তার অধীনস্থ তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে। একজন মহিলা সে তার স্বামীর ঘরের দায়িত্বশীল, তাকে অবশ্যই তার অধীনস্থদের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে। আর একজন চাকর সে তার মালিকের ধন-সম্পদের দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্বের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে।”(সহীহ আল-বুখারী ও মুসলিম)

শিশুদের মধ্যে সালামের প্রচলন শিক্ষা দেওয়া:

শিশুদের সালাম দেয়ার বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া অভিভাবকের দায়িত্ব। ঘরে প্রবেশের সময়, রাস্তায় চলাচলের সময়, মানুষের সাথে দেখা হলে السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهُ  বলে সালাম দেওয়া শেখাতে হবে। এ সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন, أَفْشُوا السَّلاَمَ ، وَأَطْعِمُوا الطَّعَامَ ، وَكُونُوا إِخْوَانًا. “তোমরা সালামের প্রচলন করো, ক্ষুধার্তকে খাদ্য খাওয়াও এবং পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যাও।” (সূনান ইবনে মাজা)

সালামের ফজিলত সম্পর্কে আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ أَبِي أُمَامَةَ بْنِ سَهْلٍ ، عَنْ أَبِيهِ ، قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم : مَنْ قَالَ : السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ كُتِبَتْ لَهُ عَشْرُ حَسَنَاتٍ ، وَمَنْ قَالَ : السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ كُتِبَتْ لَهُ عِشْرُونَ حَسَنَةً ، وَمَنْ قَالَ : السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهُ كُتِبَتْ لَهُ ثَلاَثُونَ حَسَنَةً.

 “হযরত আবু উমামা ইবনে সাহল (রা.) তার পিতা হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি বলে, السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ তার আমলনামায় দশটি নেকী লেখা হয়। আর যে ব্যক্তি السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ বলে, তার আমলনামায় বিশটি নেকী লেখা হয়। আর যে ব্যক্তি السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهُ বলে, তার আমলনামায় ত্রিশটি নেকী লেখা হয়।” (সূনান আল-কুবরা লিন-নাসায়ী)

শিশুদের জিহাদ ও সাহসিকতা শিক্ষা দেওয়া:

শিশুদরেকে রাসূল (সা.) ও তাঁর সাহাবীদের জীবনী শিক্ষা দিতে হবে। যাতে তারা জানতে পারে যে, রাসূল (সা.) হলেন একজন সত্যিকার সাহসী নেতা আর তাঁর সাহাবী আবু বকর (রা.), ওমর (রা.), ওসমান (রা.), আলী (রা.)সহ অন্যান্য সাহাবীরা ছিলেন সীমাহীন সাহসের মূর্তপ্রতিক। তারা অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে জিহাদ-সংগ্রাম করে মানুষদেরকে ইসলামী আদর্শের পতাকাতলে নিয়ে আসেন। তাদের সেই দাওয়াতের ফলেই আমরা হিদায়াত ও মুক্তির পথ পেয়েছি। তারা তাদের ঈমান, উন্নত চরিত্র ও সাহসিকতার কারণে সারা দুনিয়াতে বিজয় লাভ করেন। আমাদের সন্তানদেরকেও জিহাদ ও সাহসিকতার সেই শিক্ষা দিতে হবে। মূলত এজন্যই আল্লাহ তাআলা আমাদের মনোনীত করেছেন। আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,

وَجَاهِدُوا فِي اللَّهِ حَقَّ جِهَادِهِ هُوَ اجْتَبَاكُمْ وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ مِلَّةَ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ هُوَ سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِينَ-

 “আর তোমরা আল্লাহর পথে জিহাদ কর যেভাবে জিহাদ করা উচিৎ। তিনি তোমাদেরকে মনোনীত করেছেন। দ্বীনের ব্যাপারে তিনি তোমাদের উপর কোন কঠোরতা আরোপ করেননি। এটা তোমাদের পিতা ইবরাহীমের দ্বীন। তিনিই তোমাদের নাম রেখেছেন ‘মুসলিম।” (সূরা হাজ্জ-৭৮)

ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধ শেখানো:

ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধের ব্যাপারে শিশুদের উৎসাহ দিতে হবে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,

كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ

 “তোমরা হলে সর্বোত্তম উম্মত, যাদেরকে মানুষের জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে, আর আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।” (সূরা আলে-ইমরান-১১০)

এ ছাড়াও শিশুদেরকে হারাম খাদ্য হতে বিরত রাখতে হবে। সুদ, ঘুষ ও চুরি-ডাকাতি ইত্যাদির কুফল সম্পর্কে অবহিত করতে হবে এবং এর মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ হারাম সেটা সম্পর্কে জানাতে হবে। প্রতিবেশীদের সাথে ভালো ব্যবহার করার প্রতি শিশুদের উপদেশ দিতে হবে, মেহমানদের মেহমানদারি করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলার ব্যাপারে উৎসাহ দিতে হবে এবং খারাপ বন্ধুদের মেলামেশা থেকে বিরত রাখতে হবে। এছাড়াও ছেলেদেরকে সূরা মায়েদা ও কন্যাদেরকে সূরা আন-নূর শিক্ষা দিতে হবে। রাসূল (সা.) বলেছেন, علموا رجالكم سورة المائدة  و علموا نساءكم سورة النور “তোমরা তোমাদের পুত্রদেরকে সূরা মায়েদা ও কন্যাদেরকে সূরা নূর শিক্ষা দাও।” (ইত্তেহাফ আল-জমহুর বি তাফসীরে সূরাতুন-নূর)

পরিশেষে বলা যায়, শিশুদের প্রকৃত মুসলিম হিসেবে গোড়ে তোলার জন্য এবং আলোকিত মানুষ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য উপরোক্ত বিষয়গুলো শিক্ষা দিতে হবে। এবং এটা যাতে মেনে চলে তার দিকে সর্বদা খেয়াল রাখতে হবে। এই শিশুরাই যখন বড় হয়ে সমাজের নেতৃত্বে আসবে তখনই পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তির সমীরণ প্রবাহিত হবে।