সিয়াম সাধনার আত্মিক, শারীরিক ও সামাজিক তাৎপর্য

সিয়াম সাধনার আত্মিক, শারীরিক ও সামাজিক তাৎপর্য

সিয়াম সাধনায় মানুষের স্বভাবে নম্রতা ও বিনয় সৃষ্টি হয়

চারিত্রিক মাহাত্ম্য, নৈতিক পরিচ্ছন্নতা, চিন্তার বিশুদ্ধতা, আত্মিক পবিত্রতা এবং আল্লার নৈকট্যলাভের অন্যতম মাধ্যম হলো রোজা। সিয়াম সাধনায় মানুষের ঈমান দৃঢ় হয়। তাকওয়া বা খোদাভীতি- যেমন গুনাহর কাজ করে রোজা নষ্ট করা থেকে রোজাদারের অন্তরকে পাহারা দিয়ে থাকে তেমনি রোজা পালনের মাধ্যমে তার চিন্তাচেতনায় যে উপলব্ধি আসে তা থেকে সে সন্ধান পায় তার জীবন বিধানের সেই রূপরেখা, ইসলাম যা মানবজীবনের জন্য প্রত্যাশা করে। রোজার আত্মিক, শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক তাৎপর্য সামগ্রিকভাবে পরিপূর্ণ ঈমান প্রতিষ্ঠার পটভূমি, প্রোপট ও প্রত্যয় জন্ম দিয়ে থাকে। আল্লামা আবদুল্লাহ ইউসুফ আলী তার তাফসিরে উল্লেখ করেছেন : 'it (fast) also provides alleviations for special circumstances. If it were merely a temporary abstention from food and drink, it would be salutary to many people, who habitually eat and drink to excess. The instincts for food, drink, and sex are strong in the animal nature, and temporary restraint from all these enables the attention to be directed to higher things.' (এই রোজা পালন বিশেষ পরিস্থিতিতে পরিত্রাণ লাভের সুযোগ এনে দেয়। এটা যদি শুধু সাময়িকভাবে খানাপিনা থেকে বিরত থাকার বিষয় সাব্যস্ত হয়ে থাকে তাহলে তা যারা অভ্যাসবশত বেশি খাওয়া দাওয়া করে তাদের জন্য মঙ্গলজনক। খানাপিনা আর জৈবিক তাড়নার প্রতি আসক্তি পশু স্বভাবের মধ্যেই বেশি বিদ্যমান। এ সব থেকে সাময়িক বিরত থাকার ফলে উচ্চমার্গের ধ্যানধারণার প্রতি মনোনিবেশের সুযোগ সৃষ্টি হয়।)

মহান রাব্বুল আলামিন মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, গোটা সৃষ্টির ঊৎপত্তিও হয়েছে তার থেকে। সুতরাং তার থেকে ঊৎসারিত সব স্ৃিষ্টজগতের সাথে, জগতগুলোকে পরিচালনাকারী ফেরেশতা ও আল্লাহর সাথে অনুগত অন্যান্য শক্তির সাথে সম্পর্ক ও সংযোগ স্থাপনে দৃঢ়চিত্ত হওয়া ঈমানের পূর্বশর্ত। নিজ সত্তার ুদ্র গণ্ডি থেকে, দুর্বল শক্তির সঙ্কীর্ণ সীমানার ভেতর থেকে বেরিয়ে জগতের বিশাল প্রান্তরে অনন্তকালীন জীবনের দিকে যাত্রা করা ঈমানদারের সঙ্কল্প। ঈমানের বৈশিষ্ট্যগুলো খোদ মানবতারই মর্যাদাবান ও সম্মানিত বৈশিষ্ট্য বলে ব্যাখ্যা করেছেন সাইয়েদ কুতুব শহীদ। তার মতে, এক আল্লার এবাদত হল ঈমানের প্রধান বৈশিষ্ট। যা মানুষকে আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য সত্তার দাসত্ব থেকে ঊর্ধ্বে উন্নীত করে। তাকে সব সৃষ্টির সাথে সমতা দান করে। কাজেই সে আল্লাহ ছাড়া কাউকে কুর্ণিশ করে না, মাথা নোয়ায় না। আল্লার প্রতিপালকত্বকে শর্তহীনভাবে অনুসরণ করে মানুষ নিজের মতাদর্শ, চিন্তাধারা, মূল্যবোধ, বিচার বিবেচনার মানদণ্ড, আইন ও বিধান এবং আল্লার সাথে, সৃষ্টির সাথে তার সম্পর্ক কি হবে তা গ্রহণ করে। ফলে জীবন থেকে স্বার্থপরতা, সুবিধাবাদ ও স্বেচ্ছাচারিতা ঊৎখাত হয়ে যায়। সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে সম্পর্কের স্বচ্ছতা ও স্পষ্টতা এবং প্রভুত্বের স্থান ও দাসত্বের স্থান যথাযথভাবে প্রকাশিত হওয়ার বদৌলতে নশ্বর সৃষ্টি মানুষ অমর ও অয় সত্যের সাথে সরাসরি সংযুক্ত হয়, যার কল্যাণে তার হৃদয় জ্যোর্তিময় হয়, আত্মা পরিতৃপ্ত হয়, প্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাসে সমৃদ্ধ হয়। সেই সাথে সন্দেহ ও সংশয়ের, ভীতি ও উদ্বেগের, উত্তেজনার ও অরাজকতার অবসান হয়।

আল্লার মনোনীত জীবনবিধানের ওপর অচল অটল থাকার কল্যাণে ঈমানদার ব্যক্তির জীবনে ণস্থায়ী পার্থিব জীবনের কোনো মোহ কিংবা দুর্গতি তাকে বিচলিত করতে পারে না। আল্লার কাছে মানুষ তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় তাকে এমন একটা প্রতিতি দান করে যে সে নিজেকে নিজের বিবেচনায়ও উন্নত রাখতে সচেষ্ট হয়। আল্লাহ তাকে যে উচ্চ মর্যাদায় আসীন করেছেন তা থেকে সে নিজেকে নিচে নামায় না। এ জন্য তার বিবেকে পর্যাপ্ত লজ্জা ও শালীনতাবোধ জন্মে। এহেন আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন মানুষ নিজের জন্য তো বটেই সমাজের ও দেশের জন্য সার্বিকভাবে এক মহা সম্পদ। সিয়াম সাধনা শুধু ব্যক্তির নয় দেশ, সমাজ ও সংসারে এনে দেয় আত্মশুদ্ধির সুমহান সুযোগ। 
রোজার দ্বারা মানুষের শারীরিক সুস্থতা হাসিল হয়। সিয়াম সাধনায় মানুষের যে শারীরিক কল্যাণ সাধিত হয় কায়রো হতে প্রকাশিত Science Calls for Fasting গ্রন্থে তার বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত চিকিৎসাবিদেরা এক বাক্যে স্বীকার করেছেন- The power and endurance of the body under fasting conditions are remarkable. After a proper day's fast, the body is literally born afresh. রোজা একই সাথে দেহে রোগ প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। রোজা পালনের ফলে দেহে রোগ জীবাণু জীর্ণ অন্ত্রগুলো ধ্বংস হয় এবং ইউরিক এসিড বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়। শরীরে ইউরিক এসিড বৃদ্ধি পেলে নানা প্রকার নার্ভসংক্রান্ত রোগ বৃদ্ধি পায়। দেহের বেশির ভাগ রোগের সৃষ্টির কারণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণ। সমীায় দেখা গেছে, গৃহীত খাদ্য দ্রব্যের শতকরা পঁচিশ ভাগ বা তার অধিক অংশ অপ্রয়োজনীয়। দেহযন্ত্রে খাদ্যদ্রব্যের মাধ্যমে টকসিন নামক এক প্রকার রস জাতীয় বিষ সঞ্চিত হয়ে থাকে। বাড়তি খাদ্যদ্রব্যাদি ত্রে বিশেষে স্বাস্থ্য রায় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনায় দেহের পরিপাকযন্ত্র এক প্রকার পরিশুদ্ধি লাভের অবকাশ পায়। এই সময় পরিপাকযন্ত্র যে অবসর পায় তার ফলে দেহের অপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের সারাংশ ও সঞ্চিত বিষাক্ত রস নিঃশেষ হয়ে যায়। দেহের বাড়তি ওজন, রস ও চর্বি ইত্যাদি হ্রাস পায়।

পাকস্থলীসংক্রান্ত রোগগুলো যেমন ুধামান্দ্য, পেটফাঁপা, টক ঢেঁকুর, লিভারের দুর্বলতা, বমি বমি ভাব সিয়াম সাধনার ফলে স্বাভাবিকভাবে উপস হওয়ার সুযোগ পায়। রোজাদারের শরীরে পানির পরিমাণ হ্রাস পাওয়ার ফলে চর্মরোগ বৃদ্ধি পায় না। আধুনিক যুগের চিকিৎসা বিজ্ঞানে সিয়াম সাধনার ব্যবহারিক তাৎপর্য উপলব্ধি করেই জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, স্পেন, হল্যান্ড প্রভৃতি দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্রে প্রতিবিধান হিসেবে উপবাসের উল্লেখ করা হয়েছে। সুফি সাধকদের মতে হৃদয়ের স্বচ্ছতা হাসিলে স্বল্প খাদ্যগ্রহণের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে।

কুরআন শরিফে উল্লেখিত হয়েছে, রোজা শেষ করো নিশাগমকালে। সূর্যাস্তের পর রাত শুরুর প্রাক্কালে গোধূলি লগ্নে রোজা শেষ করার মধ্যে মানসিক, আধ্যাত্মিক, এমনকি শারীরিক গূঢ় রহস্য ও তাৎপর্য রয়েছে। রোজা শেষ করা হয় ইফতার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে, এটা সুন্নত। ইফতারের উপকরণগুলোর মধ্যেও বিশেষ স্বাস্থ্যগত তাৎপর্য রয়েছে। এক ধরনের ঐতিহ্য হিসেবেই ছোলা ইফতারের একটি উপাদান। ছোলার মধ্যে আমিষ, ভিটামিন, শ্বেতসার ও খনিজ লবণের পরিমাণ আশ্চর্যজনকভাবে বেশি। ছোলাতে শতকরা ১৭.১ ভাগ আমিষ (তুলনায় গোশতে ১৮.৫ এবং মাছে ২২.৬); ভিটামিন-এ ৩.১৭ (গোশতে মাত্র ৩.১) খনিজ লবণ, ২.৭ ভাগ (গোশতে ১.৩ এবং মাছে ০.৯) এবং শ্বেতসার ৬১.২ ভাগ। চিনির শরবত ইফতারের আরেকটি উপাদান। সারা দিন রোজা রাখার পর শরীরের প্রয়োজনে এই শরবত সহজেই আত্মিকরণযোগ্য এবং তা টনিক হিসেবে কাজ করে। ইফতারের পর সামান্য আহার বিধেয় এ জন্য যে, তা তারাবিহ নামাজ পাঠে বিঘœ ঘটায় না এবং সেহরির আগেই হজম হয়ে যায়।
প্রখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী গধপ ঋধফফবহ মনের প্রসারতা ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশে সিয়াম সাধনার ভূমিকা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন- রোজার অভিজ্ঞতা হতে দেখা গেছে, কী পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করা হলো তার ওপর বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ও কর্মমতা নির্ভর করে না, বরং কিছু বাধ্যবাধকতার ওপরই তা নির্ভরশীল।
ইমাম গাজ্জালী তার আল মুশতাতরাফ গ্রন্থে বুদ্ধি বিকাশে রোজার ভূমিকা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন, রোজা পালনের ফলে রোজাদারের মন একাগ্রচিত্ত হয়। ফলে তার মানসিক উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পায়। চিন্তাশক্তির স্বচ্ছ বিকাশে প্রয়োজন মানসিক বিশ্রামের। রোজার সময় ষড়রিপু নিয়ন্ত্রণ থাকে, চিন্তাশক্তির একাগ্রতা বৃদ্ধি পায় এবং মানসিক বিশ্রাম সহজতর হয়। ফলে বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটে। আহার গ্রহণ এবং জৈবিক শ্রান্তি আনয়ন করে এমন অন্যান্য কাজকর্ম হতে বিরত থাকার ফলে মননশীলতা বিকাশের বিশেষ স্বচ্ছ ও মৌলিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। স্বচ্ছ চিন্তাশক্তি বিকশিত হয়। চিন্তা হতে কাজের উৎপত্তি। রোজাদারের সৎকর্মগুলো তার মুখমণ্ডল ও আচার-আচরণের যে সপ্রতিভ সজীবতা ল করা যায় তার মধ্যেও উন্নত মননশীলতার নিদর্শন নিহিত। মানবদেহে পরিপাক প্রক্রিয়ায় ও দেহের সুঠাম গঠনে সিয়াম সাধনা বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।

সচরাচর গৃহীত খাদ্যের মধ্য হতে আমিষ, শ্বেতসার ও স্নেহজাতীয় খাদ্যগুলো শরীরে সম্পূর্ণ জীর্ণ হয়ে ুদ্রান্ত্র থেকে শোষিত গ্লুকোজই দেহে তাপ ও শক্তি উৎপাদন করে। দেহে যতটা গ্লুকোজ উৎপন্ন হয় তার সবই প্রতিনিয়ত খরচ হয় না। যকৃৎ থেকে কিছু গ্লুকোজ রক্তে প্রবাহিত হয়ে দেহের চালিকাশক্তিকে কর্মম রাখে। বাকি অংশ গ্লাইকোজনরূপে যকৃৎ ও মাংসপেশিতে জমা হতে থাকে। কিছু অংশ অবশ্য চর্বি জাতীয় পদার্থে পরিণত হয়ে চর্মের নিচে ও দেহের অন্যান্য স্থানে সঞ্চিত হয়। এই সঞ্চিত গ্লাইকোজেন ও চর্বিজাতীয় পদার্থ উপবাসের সময় শরীরের প্রয়োজনীয় মুহূর্তে পুনরায় গ্লুকোজে রূপান্তরিত হয়ে রক্তের মধ্যে প্রবাহিত হয়। সেই রূপান্তরিত গ্লুকোজের দেহে তাপ ও শক্তি উৎপাদন মতা দ্বিগুণ। রোজা পালনের ফলে নিয়মিত উপবাস অবস্থায় গ্লাইকোজেন ও চর্বি প্রয়োজনানুযায়ী খরচ হতে থাকে। ফলে দেহের সবলতা ও শক্তি বৃদ্ধি পায়। চর্বি জমতে পারে না। মেদ কমে যায়। কর্মমতা বৃদ্ধি পায়। ল করা যায় রমজান মাসের প্রথম দুই-তিন দিন রোজাদার শারীরিক দুর্বল্যবোধ করলেও পরে সে বেশ স্বাভাবিক বোধ করে। এমনকি প্রতিদিন দুপুরের দিকে রোজাদার ব্যক্তি কিছুটা কাহিল হয়ে পড়লেও বিকেলের দিকে ততটা দুর্বলতা বোধ করে না। এর কারণ সঞ্চিত গ্লাইকোজেন ও স্নেহজাতীয় পদার্থের যথাসময়ে উপযুক্ত ভূমিকা পালন। রোজা পালনের ফলে শরীরের অভ্যন্তরে দহন ক্রিয়া বাড়ে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর তৎপরতা বাড়ে। ফলে দেহের অবসাদ কমে এবং কর্মমতা বাড়ে।

মাহে রমজানে সিয়াম সাধনায় ব্যক্তি রোজাদারের জন্য আত্মশুদ্ধির যে সুযোগ আসে তা তার পেশাগত কর্মধারা ও দায়িত্ব কর্তব্য পালনের েেত্রও নৈতিক মূল্যবোধ জাগৃতিতে অনুপ্রেরণা জোগায়। মাহে রমজান ইসলামি বিশ্বে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে ব্যবসায় বাণিজ্যের েেত্রও বিশেষ মওসুম বিবেচনা করা হয়। মাহে রমজানের পরে আসে অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। সে উপলে ব্যাপক কেনাবেচায় ব্যাপৃত হয়ে পড়ে সবাই এই মাহে রমজানেই। এই কেনাবেচা তথা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের েেত্র ইসলামের শিা ও বিধান অনুসরণ সিয়াম সাধনারই অনিবার্য অংশ। ব্যবসায় বাণিজ্য বিনিয়োগ প্রসঙ্গে ইসলামের বিধান অত্যন্ত স্পষ্ট। ইসলাম নির্ভেজাল এবং পারস্পরিক কল্যাণ ও সমঝোতার ভিত্তিতে পরিচালিত ব্যবসায় বাণিজ্যকে গুরুত্বসহকারে শুধু অনুমোদনই করে না, বরং সে ব্যবসায় বাণিজ্য পরিচালনাকে এবাদততুল্য কল্যাণকর আখ্যা দিয়েছে। এতদসংক্রান্ত আল কুরআনের ভাষ্য এই : ’আল্লাহ্ বেচাকেনাকে বৈধ ও সুদকে অবৈধ করেছেন’ (২ সংখ্যক সূরা বাকারা। আয়াত ২৭৫) ‘নগদ আদান প্রদান ব্যতীত যেকোনো লেনদেন তা ছোট হোক আর বড় হোক মেয়াদসহ লিখতে কোনো বিরক্ত না হওয়া’ (২ সংখ্যক সূরা বাকারা। আয়াতাংশ ২৮২) ‘পরস্পর রাজি হয়ে ব্যবসায় করা বৈধ’ (৪ সংখ্যক সূরা নিসা। আয়াত ২৯)’ সেসব লোক, যাদেরকে ব্যবসায় বাণিজ্য এবং ক্রয় বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে এবং সালাত কায়েম ও জাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না, তারা ভয় করে সে দিনকে যেদিন তাদের অন্তর ও দৃষ্টি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে’ (২৪ সংখ্যক সূরা নূর। আয়াত ৩৭) ’ সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে ও আল্লাহকে বেশি স্মরণ করবে যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (৬২ সংখ্যক সূরা জুমু’আ। আয়াত ১০)’

হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা: বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘সর্বাপো পবিত্র রোজগার হচ্ছে ব্যবসায়ীদের রোজগার। তবে শর্ত হচ্ছে, তারা যখন কথা বলবে তখন মিথ্যা বলবে না। কোনো আমানতের খেয়ানত করবে না। কোনো পণ্য ক্রয় করার সময় সেটাকে মন্দ সাব্যস্ত করে মূল্য কম দেয়ার চেষ্টা করবে না। নিজের মাল বিক্রয় করার সময় সে মালের অযথা তারিফ করে ক্রেতাকে বিভ্রান্ত করবে না। তার নিজের কাছে অন্যের ধার থাকলে পাওনাদারকে অযথা ঘুরাবে না। অপর প,ে সে কারো কাছে কিছু পাওনা হলে তাকে উত্ত্যক্ত করবে না।’ অন্য এক হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যারা আল্লাহকে ভয় করে, সৎভাবে লেনদেন করে এবং সত্য বলে সেসব লোক ছাড়া কেয়ামতের দিন ব্যবসায়ীরা গোনাহগারদের কাতারে উত্থিত হবে।’ বস্তুত যেসব েেত্র ব্যবসার নামে সুদ, জুয়া, ধোঁকা-প্রতারণা ইত্যাদির আশ্রয় নিয়ে অন্যের সম্পদ হস্তগত করা হয়, সেসব পন্থায় সম্পদ অর্জন করা বৈধ ব্যবসায়ের অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং হারাম ও বাতিল পন্থা। তেমনি যদি স্বাভাবিক ব্যবসায়ের েেত্রও লেনদেনের মধ্যে উভয়পরে আন্তরিক সন্তুষ্টি না থাকে, তবে সেরূপ ক্রয়-বিক্রয়ও বাতিল ও হারাম।

নামাজ শেষ হলে ‘আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে’ বেরিয়ে পড়ার নির্দেশনার মধ্যে ব্যবহারিক জীবনের বাস্তব প্রয়োজনীয়তার প্রতি মনোযোগ দেয়াকে কর্তব্য সাব্যস্ত করা হয়েছে। বস্তুত ইসলামে বৈরাগ্য সাধনার স্বীকৃতি নেই। ব্যবহারিক সংসারযাত্রার দাবিকে জীবনের জন্য অপরিহার্য বিবেচনা করা হয়। ইবাদত বন্দেগির পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনের দাবির প্রতিও দায়িত্বশীল হওয়ার আবশ্যকতা রয়েছে।

যে ব্যবসায় বাণিজ্য ও বিনিয়োগের দ্বারা কল্যাণকর পণ্য বা সামগ্রী উৎপন্ন তথা বিপণন হয়, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, দেশজ সম্পদ উৎপাদনে গঠনমূলক অবদান রাখতে সম হয় সে ব্যবসায় বাণিজ্যকে কল্যাণকর অভিধায় আখ্যায়িত করা চলে। এ জাতীয় বাণিজ্য-বিনিয়োগ-ব্যবসার দ্বারা মানুষের উপকারের সুফল যত দিন কায়েম থাকবে তত দিন বিশেষ সওয়াব হাসিল হতে থাকবে ওই বিনিয়োগকারীর।

সিয়াম সাধনায় মানুষের স্বভাবে নম্রতা ও বিনয় সৃষ্টি হয়। কৃচ্ছ্বতাসাধনের মাধমে আত্মশুদ্ধি সিয়াম সাধনার একটি অন্যতম তাৎপর্য। আর আত্মশুদ্ধি মানবচরিত্র সংশোধনও বিকাশের উৎকৃষ্টতম উপায়। আত্মশুদ্ধির দ্বারা ব্যক্তিতথা সমাজজীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে স্বচ্ছ সুদৃঢ় স্বকীয় সত্তার। রোজা পালনের দ্বারা মানুষের অন্তরে আল্লাহর ভয়ভীতি ও তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি হয়। রোজার দ্বারা মানুষের স্বভাবে নম্রতা ও বিনয় সৃষ্টি হয় এবং দুরদর্শিতা আরো প্রখর হয়। 
আল কুরআনের ৯১ সংখ্যক সূরা আশ শামসের ৯ ও ১০ আয়াতে ইরশাদ হয়েছেÑ ‘সেই সফলকাম হবে যে নিজেকে পবিত্র করবে এবং সেই ব্যর্থ হবে, যে নিজেকে কলুষাচ্ছন্ন করবে।’ নিজেকে পবিত্র করার অর্থ হলো যাবতীয় অন্যায় অপকর্মের অত্যাচারে জর্জরিত আত্মাকে কলুষমুক্ত করার জন্য আল্লার ভয়ে ভীত হয়ে তার প্রতি নিঃশর্ত ও পরিপূর্ণভাবে নিজেকে সমর্পণ করে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ পবিত্রতা অর্জন করা। পান্তরে আত্মাকে কলুষিত করার অর্থ নিজেকে পাপের পঙ্কিলে ডুিবয়ে দেয়া।

চিন্তা হতে কাজের উৎপত্তি। যাবতীয় কর্মকাণ্ডের পেছনে উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়ই মুখ্যÑ যা প্রণীত হয় বিবেক-বুদ্ধির আলোকে। আত্মাই মানুষের অন্যতম চালিকাশক্তি। আত্মা স্বচ্ছ পবিত্র ও কলুষমুক্ত না হলে ভালোমন্দ পাপপুণ্য উপলব্ধির মতা লোপ পায়। বেহেশতে আদম ও হাওয়াকে শয়তানের প্ররোচনা হতে দূরে থাকতে এবং একটি নির্দিষ্ট বৃরে নিকটবর্তী না হতে বলা হয়েছিল। তারা যখন শয়তানের প্ররোচনায় সেই নিষিদ্ধ বৃরে নিকটবর্তী হয় তখন তাদের এই অবাধ্যতার কারণে তাদের পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয়া হলো। এ সময় আদম আ: যে মুনাজাত করেন তা আত্মশুদ্ধিকামী মুসলমানের নিত্য মুনাজাত- ‘রাব্বানা জালামনা আনফুসিনা ওয়া ইল্লাম তাগফিরলানা ওয়া তারহামনা লানা কুনান্না মিনাল খাসিরিন’ (হে আমাদের প্রতিপালক। আমরা আমাদের আত্মার প্রতি জুলুম করেছি, তুমি আমাদের মা না করলে এবং আমাদের প্রতি দয়া না করলে অবশ্যই আমরা তিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ব)। (সূরা আরাফ, আয়াত ২৩)
সূরা আল লায়লে আত্মশুদ্ধির উপায় হিসেবে কারো প্রতি অনুগ্রহের প্রতিদান সাব্যস্ত না করে শুধু আল্লাহর সন্তষ্টির জন্য স্বীয় সম্পদ ব্যয় করাকে উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা আত তওবার ১০৩ নম্বর আয়াতে জাকাত প্রদানকেও আত্মশুদ্ধির উপায় বলা হয়েছে। মাহে রমজানে রোজা পালনের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি সাধিত হতে পারে।

অতিমাত্রায় ভোগবাদী ও বস্তুতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বৈধ অবৈধের ভেদরেখা উপলব্ধির মতা দুরস্ত হয়ে দাঁড়ায়। ভোগে উম্মত্ত হয়ে অবৈধ অর্জনের জন্য বিবেকের দংশনকেও উপো করে অসৎ পন্থা অবলম্বনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে অনেকেই। এরূপ পরিস্থিতিতেই অসহিঞ্চুতা হিংসাবিদ্বেষ বিসংবাদের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। প্রতিষ্ঠিত কল্যাণকর ও শুভ মূল্যবোধগুলো যেন হয়ে পড়ে দ্রুত অবয়ের শিকার।

আত্মশুদ্ধির ল্েয নিজের কৃতকর্মের বোধ বিশ্বাস এমনকি চিন্তাভাবনার েেত্র আত্মসমালোচনা ও বিশ্লেষণে ব্যাপৃত হওয়া প্রয়োজন। সূরা ফাতিরের ১৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেÑ ‘যেকেউ আত্মশুদ্ধি করে সে তো তা করে তার নিজের জন্যই।’

অপচয় অপব্যয় ব্যষ্টি ও সমষ্টির সামগ্রিক অবয়বে অনির্বচনীয় দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। স্থান কাল পাত্র নির্বিশেষে এ কথা সর্বজনবিদিত যে সময় সম্পদ ও সুযোগের সুষম ব্যবহারে সাফল্য সুনিশ্চিত হয়। আল কুরআনে অপচয়, অপব্যয় ও অমিতাচার থেকে দূরে থাকার জন্য বলা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে, ‘এবং যারা মানুষকে দেখাবার জন্য তাদের ধনসম্পদ ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস করে না আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন না আর শয়তান কারো সঙ্গী হলে সে সঙ্গী কত মন্দ।’ (৪ সংখ্যক সূরা নিসা। আয়াত ৩৮) ‘অপচয় করবে না, কারণ আল্লাহ অপচয়কারীদের পসন্দ করেন না।’ (৬ সংখ্যক সূরা আল আনাম। আয়াত ১৪১) হে বনি আদম! প্রত্যেক সালাতের সময় সুন্দর পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করবে। আহার করবে ও পান করবে কিন্তু অমিতাচার করবে না। তিনি অমিতাচারীকে পছন্দ করেন না।’ (৭ সংখ্যক সূরা আরা’ফ, আয়াত ৩১) ‘আত্মীয়স্বজনকে দিবে তার প্রাপ্য এবং অভাব গ্রস্ত ও পর্যটককেও এবং কিছুতেই অপব্যয় করো না। যারা অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই এবং শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।’ (১৭ সংখ্যক সূরা বনি ইসরাইল। আয়াত ২৬-২৭) ‘এবং যখন তারা ব্যয় করে তখন তারা অপব্যয় করে না, কার্পণ্যও করে না, বরং তারা আছে এতদুভয়ের মাঝে মধ্যম পন্থায়।’ (২৫ সংখ্যক সূরা ফুরকান। আয়াত ৬৭)

অপব্যয়ের ফলে স্বভাবত অন্যান্য ক্ষেত্রের ন্যায্য দায় পরিশোধে বিঘœ সৃষ্টি হয়ে থাকে বলেই ব্যয় ও ব্যবহারের েেত্র সুষম অবস্থা অবলম্বনের তাগিদ দেয়া হয়েছে। সম্পদ সসীম। চাহিদা অসীম। সসীম সম্পদের সুষম ব্যবহারের দ্বারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চাহিদা মেটানো যেখানে জরুরি সেখানে অপব্যয়ের অবকাশ নেই। ব্যাষ্টির অর্থনীতিতে অপব্যয় অভাব অনটনকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। জাতীয় অর্থনীতির ক্ষেত্রও একই কথা। অপব্যয় অপচয়ে জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হয়, বৈষম্য প্রকাশ্য হয়ে ওঠে ভোগ ও বণ্টনপ্রক্রিয়ায়।
পানাহারের েেত্রও মধ্যপন্থা অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। ক্ষুধা ও প্রয়োজনের চেয়ে অধিক খাদ্য গ্রহণ অনুচিত। ফিকাহবিদেরা উদরপূর্তি ও অস্বাভাবিক ভণ করাকে না জায়েজ লিখেছেন। হজরত ওমর রা: বলেন, ‘বেশি পানাহার থেকে বেঁচে থাক। কারণ অধিক পানাহার দেহকে নষ্ট করে, নানা রোগের জন্ম দেয় এবং কর্মে অলসতা সৃষ্টি করে। পানাহারের েেত্র মধ্যপন্থা অবলম্বন করো। এটা দৈহিক সুস্থতার পে উপকারী এবং অপব্যয় থেকে দূরবর্তী।’

কুরআনে তাদের শয়তানের দোসর সাব্যস্ত করা হয়েছে যারা আল্লার পথে নিজেরাও ব্যয় করে না এবং অন্যকেও ব্যয় না করার অনুপ্রেরণা জোগায়, অথচ তারা অপব্যয় করে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে। ওয়াজিব হকের েেত্র শৈথিল্য ও কার্পণ্য প্রদর্শন করা যেমন দোষণীয় তেমনিভাবে লোক দেখানোর জন্য ও উদ্দেশ্য বিহীনভাবে ব্যয় করাও নিতান্ত মন্দ কাজ। যারা একান্তভাবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ব্যয় না করে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ব্যয় করে তাদের আমল আল্লার দরবারে কবুল হয় না। হাদিসে এমন কাজকে শেরেকি বলেও অভিহিত করা হয়েছে। মুসনাদে আহমাদে সঙ্কলিত এবং শাদ্দাদ ইবনে আওস বর্ণিত হাদিসে আছে, আমি রাসূল সা:কে বলতে শুনেছি যে, ‘যে ব্যক্তি লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ল সে শেরেকি করল। যে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে রোজা রাখল সে শেরেকি করল এবং যে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে সদকা খয়রাত করল সে শেরেকি করল। (মুসনাদে আহমদ)