পাটশিল্প রক্ষায় আসছে ‘গোল্ডেন হ্যান্ডশেক’

পাটশিল্প রক্ষায় আসছে ‘গোল্ডেন হ্যান্ডশেক’

ফাইল ছবি

পাটকল শ্রমিকদের দাবির মুখে ২০১৫ সালের মজুরি কমিশন মেনেই বেতন দিতে যাচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন (বিজেএমসি)। তবে পাওনা পরিশোধের পাশাপাশি স্থায়ী শ্রমিকদের ‘বিদায়’ (গোল্ডেন হ্যান্ডশেক) দেয়ার চিন্তাভাবনা চলছে।

বিদায় হওয়া শ্রমিকরা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে দৈনিক, ঘণ্টা ও উৎপাদন ভিত্তিতে কাজ করতে পারবেন। পাটশিল্প বাঁচাতেই এই চিন্তাভাবনা বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

এদিকে গত ৮ বছরে সরকারের এ খাতে লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। পাটকলগুলোর কেন এত লোকসান তা খুঁজতে গিয়ে ৮টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গোল্ডেন হ্যান্ডশেক নিয়ে পাটকল শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে শ্রমিকদের বার্তাও দেয়া হচ্ছে যে, একজন শ্রমিককে ২০১৫ সালের মজুরি কমিশন অনুযায়ী চাকরি থেকে বিদায় জানানো হলে ওই শ্রমিক কমবেশি একসঙ্গে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত পাবেন। ওই টাকা সে বিভিন্ন কাজে বা ব্যবসায় বিনিয়োগ করে আয় করতে পারবেন। পাশাপাশি যোগ্যতা অনুযায়ী নিজ প্রতিষ্ঠানে দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করেও সংসার চালাতে পারবেন। তাদের বিনা বেতনে না খেয়ে আর আন্দোলন করতে হবে না। পক্ষান্তরে সরকারকেও আর লোকসান গুনতে হবে না।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব লোকমান হোসেন মিয়া স্পষ্ট করে কিছু বলতে রাজি হননি। তিনি নিজ দফতরে বলেন, ‘পাটকল শ্রমিকদের আন্দোলন চলছে। এ বিষয়ে পাট মন্ত্রণালয়সহ সরকারের একাধিক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী কাজ করছেন। বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ও। আমাদের পক্ষ থেকে পাটশিল্পের সমস্যা ও করণীয় সবই অবহিত করা হয়েছে। পাটশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে নিশ্চয় ভালো সিদ্ধান্ত আসবে বলে আমার বিশ্বাস।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, বর্তমানে বিজেএমসির অধীন রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫টি পাটকলে স্থায়ী শ্রমিক আছে ২৫ হাজার ৫১৯ জন। বদলি তালিকাভুক্ত শ্রমিক ২২ হাজার ৯৯৮ জন। দৈনিকভিত্তিক তালিকাভুক্ত শ্রমিক ৪ হাজার ৯১০ জন। সব মিলে বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে কাজ করে ২৭ হাজার ৯৫৭ জন শ্রমিক।

এসব শ্রমিকের জন্য ২০১৫ সালের মজুরি কমিশন গঠিত হলেও তা অদ্যাবধি বাস্তবায়ন করা হয়নি। এখনও তারা ২০১০ সালের বেতন কাঠামোতেই বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। এরপরও মাসের পর মাস বাকিই থাকছে। গত ৮ বছরে পাটকলগুলোর লোকসানের পরিমাণ চার হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

এর মধ্যে ২০১১-১২ অর্থবছরে বিজেএমসির লোকসান ছিল ৭৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৩৯৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকা, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫১৩ কোটি ৮ লাখ টাকা, পরের অর্থবছরে ৭২৯ কোটি টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬৬৯ কোটি ২০ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে।

এছাড়া ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪৮১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪৯৭ কোটি ১৮ লাখ টাকা এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫৭৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা লোকসান হয়।

এই লোকসানের ৮টি কারণ চিহ্নিত করেছে বিজেএমসি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ক. ২০০৯-২০১২ সাল পর্যন্ত তিন বছরে মিলগুলোর সেটআপের শূন্যপদের বিপরীতে ৩ ধাপে ৩০ শতাংশ করে মোট ৯০ শতাংশ শ্রমিক স্থায়ী করায় মজুরি বৃদ্ধি পায়। ফলে লোকসানের পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। খ. ওই সময় প্রয়োজন ছাড়াই ছাঁটাইকৃত সাড়ে ৪ হাজার শ্রমিককে পুনঃনিয়োগ দেয়া হলে মজুরি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। ফলে লোকসানের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পায়।

গ. ২০১০ সালের ১ জুলাই থেকে নতুন মজুরি কমিশন কার্যকর করা হলে মজুরি আগের তুলনায় ৬৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ঘ. মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন ও বন্ধ মিল চালু করতে বিজেএমসির নিজস্ব তহবিল থেকে ৪০৫ কোটি টাকা পরিশোধ করায় পাট কেনা সম্ভব হয়নি ওই বছর। ফলে লোকসানের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পায়।

ঙ. বেসরকারি মিলগুলোর সর্বনিম্ন মজুরি ৫ হাজার ১৫০ টাকা (বেসিক ২৭০০ টাকা), অন্যদিকে সরকারি পাটকলগুলোর শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি ১১ হাজার ৮৫ টাকা (বেসিক-৪১৫০ টাকা)। চ. বিশ্ববাজারে পাটজাত পণ্যের চাহিদা না বাড়া এবং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি হওয়ায় লোকসানের পরিমাণ বাড়তে থাকে।

ছ. ৫০ দশকের পুরনো মেশিনের কারণে উৎপাদন ক্ষমতা ৫০ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। ফলে লোকসান দিন দিন বাড়ছে। এবং জ. নিয়মিত শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধ না করতে পারার কারণে পাটকলগুলোর গেটে ঘন ঘন মিটিং, ধর্মঘট ও বিভিন্ন কর্মসূচির কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে বাড়ে লোকসানের পরিমাণ।

বিজেএমসির চেয়ারম্যান মো. আবদুর রউফ বলেন, ‘পাটকলগুলোর লোকসানের কারণ চিহ্নিত করে আমরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠিয়েছি। শ্রমিকদের দাবি অনুযায়ী ২০১৫ সালের মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন করতে হলে প্রয়োজন হবে ৫ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। আর ২০১০ সালের মজুরি কমিশন অনুযায়ী প্রয়োজন হবে এক হাজার ৮৪০ কোটি টাকা।

মিলগুলোকে লাভজনক করতে হলে কি করণীয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্থায়ী শ্রমিকদের নিয়ম অনুযায়ী পাওনা মিটিয়ে বিদায় দেয়া যেতে পারে। বেসরকারি মিলগুলোর মতো ‘কাজ আছে বেতন আছে’ ভিত্তিতে কাজ করাতে হবে। তাহলে লোকসানের পরিমাণ কমে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।’

এদিকে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, স্থায়ী শ্রমিকদের ২০১৫ সালের মজুরি কমিশন অনুযায়ী পাওনা পরিশোধ করে বিদায় দেয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। ইতিমধ্যে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে জানানো হয়েছে। এটি করা হলে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে কি ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে সে ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। তাছাড়া তারা বিভিন্ন মাধ্যমে পাটকল শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন।

ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন বাংলাদেশ পাটকল শ্রমিক লীগের সিনিয়র সহসভাপতি মাহবুব আলম।

তিনি বলেন, পাটকলগুলোর স্থায়ী শ্রমিকদের ২০১৫ সালের মজুরি অনুযায়ী পাওনা পরিশোধ করে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দেয়া হলে কি ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে তা জানতে চাওয়া হয়েছে। সরকারের একাধিক সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এ বিষয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। আমরা বলেছি, যথাযথভাবে পাওনা পরিশোধ ও নিজ নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের সুযোগ দিলে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। তারা এ টাকায় ছোটখাটো ব্যবসা করতে পারবেন। পাশাপাশি নিজ নিজ পাটকলে দৈনিকভিত্তিতে কাজ করে সংসার চালাতে পারবেন।

তবে মাহবুব আলমের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন-সিবিএ সংগ্রাম ঐক্য পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ও রাজশাহীর প্লাটিনাম জুট মিলের সিবিএ সভাপতি শাহানা শারমিন।

তিনি বলেন, ‘সরকার প্রস্তাব দিতেই পারে। তবে যদি বাধ্যতামূলকভাবে শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হয় তবে তা প্রতিহত করা হবে।’ গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের বিষয়ে কোনো প্রস্তাব পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রস্তাব পাইনি, তবে আকারে ইঙ্গিতে কোনো কোনো মহল থেকে এ বিষয়ে বলা হচ্ছে।’