রোহিঙ্গা শরনার্থীদের স্বাস্থ্য সেবা

রোহিঙ্গা শরনার্থীদের স্বাস্থ্য সেবা

রোহিঙ্গা শরনার্থীদের স্বাস্থ্য সেবা

ডা. মুহাম্মদ আব্দুস সবুর

মায়ানমারের রাখাইনে বসবাসরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বহু বছর ধরে সেখানে জাতিগত নিধন, গণহত্যা ও বৈষম্যের শিকার । অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে গেলে লাখে লাখে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে আগস্ট ২০১৭ তে । বর্তমানে প্রায় ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় বসবাস করছে । শরনার্থী শিবিরের অপর্যাপ্ত বাসস্থানে গাদাগাদি করে থাকা পানি ও পয়:নিস্কাষণের অপর্যাপ্ত  অবস্থা এসব শরনার্থীকে বিভিন্ন স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন করছে । শরনার্থীদের অর্ধেকের বেশি মহিলা ও শিশু, ফলে বছরে প্রায় ২৬ হাজার গর্ভবতী ও প্রায় ২ লক্ষ পাঁচ বছরের নিচে শিশু স্বাস্থ্য চাহিদার প্রয়োজনীতার কথা জানাচ্ছে। বাংলাদেশে আসার আগে রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ ছিল অত্যন্ত অপ্রতুল্, যেমন টীকা গ্রহণের হার ছিল মাত্র ৪%। পৃথিবীর অন্যতম বড় আকারের ডিপথেরিয়া সংক্রমণ দেখা দেয় নভেম্বর ২০১৭ তে যা ২০১৮‘র মাঝামাঝিতে বন্ধ করা সম্ভব হয়। শরনার্থীরা অপুষ্টি, ডায়রিয়া, শ্বাসনালীর সংক্রমণ, জ্বরসহ বিভিন্ন সমস্যাতে আক্রান্ত।

শরনার্থী শিবিরের ভৌত অবকাঠামোর উন্নতির পাশাপাশি সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবে অতিরিক্ত  মৃত্যু এড়ানো গেছে । সাফল্যের সাথে মোকাবিলা করা গেছে  প্রয়োজনীয় অধিকাংশ স্বাস্থ্য চাহিদা। ৯০,০০০ অধিক ডোজ রুটিন টীকা  প্রদান করা হয়েছে । মুখে খাবার, কলেরা টীকা দেওয়া হয়েছে ৪,৭৫,০০০ ব্যক্তিকে । মিজেল্স সংক্রমণের প্রেক্ষিতে ২,৯০,০০০ রোহিঙ্গা শিশুকে টীকা  দেওয়া হয়েছে । অবস্থার ক্রমান্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। টীকা গ্রহণের হার বেড়ে হয়েছে ৮৯%; স্বাস্থ্য  প্রতিষ্ঠানে সন্তান প্রসবের হার ২২% থেকে বেড়ে হয়েছে ৪০%; অপুষ্টির হার ১৯% থেকে কমে হয়েছে ১২% । তবে ৬-২৩ বছরের শিশুদের মাঝে রক্তশূন্যতা ৫০% এর বেশী। ৫ বছরের নীচের শিশুদের মাঝে খর্বাকৃতি চিন্তার কারণ।

 

শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের মাঝে মানসিক সমস্যাও প্রকট। বাংলাদেশে আসার আগে অত্যাচার ও হত্যার যে অভিজ্ঞতা তাদের হয়েছে, এমনকি বাংলাদেশে আসার পথে যে অবর্ণনীয় দুরাবস্থার মাঝ দিয়ে তারা গেছেন-এর সবই তাদের মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। শরণার্থী শিবিরের অনিশ্চিৎ ভবিষ্যৎ, বিচ্ছিন্ন পরিবার তাদের মানসিক সমস্যাকে প্রকট করে তুলছে। জুলাই ২০১৯-এর জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনারের তথ্য জানাচ্ছে ১৬% রোহিঙ্গা তাদের সন্তান পালন করছেন একক মা হিসাবে ও ১% একক পিতা হিসাবে; ১% রোহিঙ্গা শিশু এতিম। সামাজিকভাবে সাবালক হলে রোহিঙ্গা কন্যারা সাধারণত: ঘরের বাইরে বেরোয় না। ফলে তারা প্রায়শই গৃহকালীন সহিংসতার শিকার হয়। বাল্য বিবাহের হারও বেশী।

রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আগমনের দুই বছরে স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হওয়া সত্ত্বেও আরও অনেক করার বাকী রয়েছে। অনুপযুক্ত বাসস্থান, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, স্বাস্থ্য সেবায় অপ্রতুলতা রোহিঙ্গাদের, বিশেষ করে নারী ও শিশুরা যথেষ্ঠ স্বাস্থ্যঝুঁকির মাঝে রয়েছে। শরণার্থী জীবনের দুরাবস্থা আরও প্রকট হবার আগেই তাদের জন্য আরও পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা জরুরী। অত্যাবশ্যকীয় মাতৃ, নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্যসহ প্রজনন স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা  অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এর পাশাপাশি পরিবার পরিকল্পনা, পুষ্টি, সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে ব্যাপকভাবে সচেতণতা সৃষ্টির কোন বিকল্প নেই। মানসিক স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব উপলব্ধি করে এর ব্যবস্থা করতে হবে প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অংশ হিসেবে।

যেহেতু রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন সময় সাপেক্ষ, তাই তাদের বাংলাদেশে অবস্থানের সময়ে মানুষ হিসাবে তাদের প্রাপ্য স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা করা দায়িত্ব আমাদেরই। মনে রাখতে হবে ১৯৭১ সালে আমরাও এমনি দুরাবস্থায় ছিলাম। সেদিনের ভারতীয়দের অবদানের সঠিক প্রতিদান হবে রোহিঙ্গাদের প্রতি আমাদের মানবতা প্রদর্শন।

ডা. মুহাম্মদ আব্দুস সবুর : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ