ইন্টারনেট যখন বন্ধ করে দেয়া তখন কী ঘটে

ইন্টারনেট  যখন বন্ধ করে দেয়া তখন কী ঘটে

ছবি:সংগৃহীত

আদ্দিস আবাবার উঁচু অফিস ভবনে যে ডেস্কে বসে মারকোস লেমা কাজ করেন, সেখান থেকে পুরো নগরীর একটা চমৎকার দৃশ্য দেখা যায়। মারকোস লেমা একটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন কোম্পানি 'আইসএডিস' এর প্রতিষ্ঠাতা। তার এই কাজের জায়গাটি প্রতিদিন যাদের উপস্থিতিতে সরগম থাকে, তাদের অনেকের চোখেই বড় স্বপ্ন। কিন্তু যখন ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয়, তখন তাদের সবকিছু অংকুরেই যেন নষ্ট হয়ে যায়।

একটি ডিজিটাল অধিকার গোষ্ঠী 'একসেস নাউ' বিবিসির সঙ্গে যেসব তথ্য শেয়ার করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে গত বছর ৩৩টি দেশে অন্তত ২০০ বার ইচ্ছেকৃতভাবে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। "যখন এমনটা হয়, তখন এখানে গাড়ি চলাচলও যেন বন্ধ হয়ে যায়। এখানে কেউ আসে না। যদিও আসে, বেশিক্ষণ থাকে না। কারণ ইন্টারনেট ছাড়া তারা এখানে করবেটাই বা কী", বলছেন মারকোস।

"একটা সফ্টওয়্যার তৈরি করে দেয়ার জন্য আমরা একটা চু্ক্তি করেছিলাম, কিন্তু আমাদের সেটি বাতিল করে দিতে হয়েছিল, কারণ আমরা সময়মত কাজটা করতে পারতাম না.... এখানে কোন ইন্টারনেট সংযোগ ছিল না। আমাদের আন্তর্জাতিক কাস্টমাররা মনে করতো, আমরা তাদের উপেক্ষা করছি। আসলে ব্যাপারটা তা নয়, আমাদের কিছু করার ছিল না।"

"মোটরবাইক চালকরা খাবার পৌঁছে দেয়ার বদলে বসে থাকে। ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়া মানুষ তো অনলাইনে বা অ্যাপের মাধ্যমে অর্ডার দিতে পারে না", বলছেন মারকোস। "যখন ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়, তখন ব্যবসা-বাণিজ্য আর মানুষের ওপর এর একটা বড় ধাক্কা এসে পড়ে।"

বিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ

এঘটনা শুধু ইথিওপিয়ায় নয়, আর এর প্রতিক্রিয়া কেবল অর্থনৈতিক নয়। 'একসেস নাউ' তাদের গবেষণায় দেখতে পেয়েছে এভাবে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার কারণে সারা বিশ্ব জুড়ে লাখ লাখ মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।

বিভিন্ন দেশে সরকারি কর্মকর্তারা চাইলেই ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দিতে পারে। তারা অনেক সময় ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার বা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দেয় একটি নির্দিষ্ট এলাকায় ইন্টারনেট সিগন্যাল বন্ধ করে দিতে। অথবা অনেক সময় একটি নির্দিষ্ট ওয়েব ঠিকানা বা সার্ভিস তারা ব্লক করে দেয়। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, বিশ্বের অনেক দেশের সরকার এখন এটিকে দমননীতির একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।

বিবিসি নতুন কিছু তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখতে পাচ্ছে, এভাবে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার সঙ্গে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের সময়ের একটা সম্পর্ক আছে। কেবল ২০১৯ সালেই ৬০টি প্রতিবাদ-বিক্ষোভের সময় ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনের সময় ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে ১২ বার।

বিভিন্ন দেশের সরকার অবশ্য যুক্তি দেখায় যে জননিরাপত্তার স্বার্থে বা ভুয়া খবর ছড়ানো বন্ধ করতে তাদের এরকম ব্যবস্থা নিতে হয়। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, ব্যাপারটা মোটেই তা নয়, এটা করা হয় অনলাইনে তথ্য সরবরাহ বন্ধ করতে এবং রাস্তায় যে কোন ধরণের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দমনের লক্ষ্যে।

২০১৬ সালে জাতিসংঘ ইন্টারনেটের সংযোগকে মানবাধিকার বলে ঘোষণা করেছিল। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) ইন্টারনেটে সবার যুক্ত হওয়ার সুযোগকে অন্যতম লক্ষ্য বলে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশের নেতারা এই ধারণাটি মেনে নিতে রাজী নন।

২০১৯ সালের অগাষ্টে ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যাবি আহমেদ ঘোষণা করেন যে ইন্টারনেট 'পানি' বা 'বাতাস' নয়। কাজেই জাতীয় স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে ইন্টারনেট বন্ধ করার বিষয়টি সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেই যাবে। তবে মিস্টার অ্যাবির এই ঘোষণায় মারকোস লেমা এখনো ক্ষুব্ধ।

"সরকার ইন্টারনেটকে এখনো অতি জরুরী জিনিস বলে ভাবে না। তারা মনে করে ইন্টারনেট মানে কেবল সোশ্যাল মিডিয়া, কাজেই এটার যে একটা অর্থনৈতিক গুরুত্ব আছে, অর্থনীতির ওপর এর কী প্রভাব পড়ে, সেগুলো তারা বুঝতে পারে না।"

ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের শীর্ষে ভারত

২০১৯ সালের যে নতুন তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায় গত বছর ভারতেই সবচেয়ে বেশি ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় গত বছর ১২১ বার মোবাইল ডাটা বা ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৬৭ শতাংশ ক্ষেত্রে এই ইন্টারনেট বন্ধ করার ঘটনা ঘটেছে ভারত শাসিত বিতর্কিত অঞ্চল কাশ্মীরে।

মধ্য আফ্রিকার দেশ শাডে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়েছিল। ২০১৮ সালে এই ইন্টারনেট শাটডাউন শুরু হয়, চলে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১৫ মাস ধরে। সুদান এবং ইরাকেও ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়েছিল। তখন লোকজনকে 'অফলাইনে' তাদের সব কাজ সারতে হয়েছে।

তবে এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইন্টারনেট বন্ধ করার প্রভাব-প্রতিক্রিয়া ছিল ভিন্ন। কোন দেশে হয়তো পুরো দেশেই ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, কোথাও কোন সুনির্দিষ্ট অঞ্চলে, আবার কোন দেশে হয়তো কেবল সোশ্যাল মিডিয়া সাইট ব্লক করে দেয়া হয়েছিল।

অনেক দেশের সরকার ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের জন্য 'থ্রটলিং' বা 'শ্বাসরোধে'র পথ বেছে নেয়, এধরণের ব্ল্যাকআউট মনিটর করা কঠিন। এতে আসলে ইন্টারনেট ডাটা সার্ভিসের গতি খুব ধীর করে দেয়া হয়। যেমন কোন দেশে হয়তো ফোর-জি মোবাইল ডাটা সার্ভিস আছে, কিন্তু সেটিকে টু-জি'তে নামিয়ে আনা হলো যাতে কেউ ভিডিও শেয়ার করতে না পারে বা লাইভস্ট্রীম করতে না পারে।

২০১৯ সালের মে মাসে তাজিকিস্তানে এরকম ঘটনা ঘটেছিল। সেদেশের প্রেসিডেন্ট তখন স্বীকার করেছিলেন সব ধরণের সোশ্যাল নেটওয়ার্ক বন্ধের জন্য এটা করা হয়েছিল। কারণ তার ভাষায় 'ফেসবুক, টুইটার এবং ইনস্টাগ্রামের মতো সাইটে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা চলার ঝুঁকি আছে।'

কিছু কিছু দেশ, যেমন রাশিয়া এবং চীন, এমন এক ধরণের ব্যবস্থা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে যেখানে পুরো দেশের ইন্টারনেটকে বাকী বিশ্ব থেকে একদম বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যাবে। ইন্টারনেটের ওপর আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা এটি।

ডিজিটাল অধিকার গোষ্ঠী 'একসেস নাউ' বলছে, "মনে হচ্ছে যেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পরস্পরের কাছ থেকে শিখছে কিভাবে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং ইন্টারনেট একেবারে বন্ধ করে দেয়ার চরম পদক্ষেপটি কীভাবে নেয়া যায়। তাদের লক্ষ্য সমালোচকদের মুখ বন্ধ করা এবং কোন নজরদারি ছাড়াই মানবাধিকার লঙ্ঘন চালিয়ে যাওয়া।"-সূত্র:বিবিসি