ভারতকে বিদায় করে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালে নিউজিল্যান্ড

ভারতকে বিদায় করে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালে নিউজিল্যান্ড

ফাইল ছবি

ইটের জবাব পাটকেলে দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়াই ছিল নিউজিল্যান্ডের। তার ওপর আগের দিন বৃষ্টিতে খেলা থেমে যাওয়ার পর থেকে ঢেকে রাখা উইকেট এবং কালও গোমড়ামুখো ওল্ড ট্রাফোর্ডের আকাশ পরিস্থিতি অনুকূলেই রেখেছিল তাদের। তাই ভারতের আগুনে পেস বোলিংয়ের জবাব বারুদেই দিতে পারল কিউইরা। তাতেই ২৪০ রানের লক্ষ্য তাড়ায় ভারত গিয়ে দাঁড়াল খাদের কিনারায়।

এত দিন টপ অর্ডার এমন রানপ্রসবা ছিল যে ভারতের মিডল অর্ডারের পরীক্ষাটি সেভাবে হয়ইনি। সেই পরীক্ষায় যখন বসতে হলো, তখন সেমিফাইনালের স্নায়ুচাপও পরীক্ষাকে কঠিন থেকে কঠিনতর করল আরো। তাই একপর্যায়ে ৯২ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ভারতের ফাইনাল স্বপ্ন যেন সেখানেই শেষ।

কিন্তু প্রায় শেষ হয়েও তারা আবার ঘুরে দাঁড়াল। এমনভাবে যে কখনো কখনো ভারতের জয়কেই মনে হতে শুরু করল ভবিতব্য। টপ ও মিডল অর্ডারের ব্যর্থতার দিনে অবিশ্বাস্য সেই ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পের দুই নায়ক হওয়ার পথেও ছিলেন রবীন্দ্র জাদেজা এবং মহেন্দ্র সিং ধোনি। পরেরজন ২০১১ সালে ভারতের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর আগে দলকে আরেকটি বিশ্বকাপ ফাইনালের পথ দেখানো আলো ছড়াচ্ছিল যাঁর ব্যাটে। তবে সেই আলোটা আরো বেশি ঝিলিক দিয়ে উঠছিল জাদেজার ব্যাটে। যাঁকে খুব কার্যকর ক্রিকেটার নন বলে টুইট করেছিলেন সাবেক ক্রিকেটার সঞ্জয় মাঞ্জরেকার। এরই জবাব ব্যাট হাতে দিতে থাকা জাদেজা খেললেন অবিশ্বাস্য এক ইনিংস।

ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে তিনি নিজের ব্যাটে লিখতে শুরু করলেন পুনর্জাগরণের মহাকাব্য। তাঁর সঙ্গে অন্য প্রান্ত দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও সামর্থ্য দিয়ে আগলে রাখা ব্যাটিংয়ে ধোনিও এমন সহযোগী হয়ে গেলেন যে ওল্ড ট্রাফোর্ডে নতুন এক রূপকথা লেখাই হয়ে গিয়েছিল প্রায়। আট নম্বরে নামা জাদেজা সপ্তম উইকেটে ধোনিকে নিয়ে ১১৬ রানের পার্টনারশিপে যখন ১৪ বলে ৩২ রানের প্রয়োজনও সম্ভব বানিয়ে ফেলতে চলেছেন, তখনই গড়বড়। ট্রেন্ট বোল্টকে হাঁকাতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দিলেন বিপর্যয়ের মধ্যেও মাত্র ৫৯ বলে ৪টি করে ছক্কা ও বাউন্ডারিতে ৭৭ রানের বিস্ফোরক ইনিংস খেলা জাদেজা এবং সেটি কিউই অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনও ধরলেন ঠিকঠাক, তখনো ধোনির ব্যাটে আশা সমুজ্জ্বল। ছক্কাও মারলেন। তাতে আশাও জাগল আরো। কিন্তু এরপর ডাবল নিতে গেলেন, কিন্তু তখনই ভারতের হৃদয় ভাঙা থ্রো এই বিশ্বকাপে রান করতে ভুলে যাওয়া মার্টিন গাপটিলের। ফিফটি করে রানআউট ধোনি এবং হারতে বসা ম্যাচে জিততে জিততেও ১৮ রানে হারের নিয়তি ভারতের। গতবার অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে সেমিফাইনাল থেকেই বিদায় নেওয়া ভারতকে এবার থামাল সেবারের ফাইনালিস্ট নিউজিল্যান্ড। টানা দ্বিতীয়বারের মতো ফাইনালে যাওয়া কিউইদের তাই পুড়তে হলো না ২৭ বছর আগের হতাশায়ও। ১৯৯২ সালে একই ফরম্যাটে হওয়া বিশ্বকাপে প্রবল প্রতাপে শেষ চারে পৌঁছে যাওয়া কিউইরা সেমিফাইনালে বিলীন হয়েছিল পাকিস্তানের কাছে হারের বেদনায়।

এবার ভারতকে টানা দ্বিতীয়বারের মতো সেমিফাইনাল থেকে ছিটকে দেওয়ার বেদনায় নীল করা কিউইরা আগের দিন বৃষ্টিতে খেলা বন্ধ হওয়ার সময় ৪৬.১ ওভারে ৫ উইকেট হারিয়ে তুলেছিল ২১১ রান। কাল বাকি ২৩ বলে ৩ উইকেট হারিয়ে যোগ করল আরো ২৮ রান। তবে লক্ষ্যটা ভারতের মতো শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনের জন্য বড় কোনো ব্যাপার ছিল না। কিন্তু স্যাঁতস্যাঁতে উইকেটে কিউই পেস অ্যাটাকও কম চ্যালেঞ্জের ছিল না। রান তাড়ার শুরুতে সেই চ্যালেঞ্জে হার দিয়েই ধাক্কা ভারতের ব্যাটিংয়ে। তৃতীয় ওভারেই বিরাট কোহলিকে (১) এলবিডাব্লিউর ফাঁদে ফেলেন ট্রেন্ট বোল্ট। এর আগে-পরে ভারত মূলত লণ্ডভণ্ড হয় আরেক পেসার ম্যাট হেনরিতে। উইকেটের পেছনে ক্যাচ বানান দুই ওপেনার লোকেশ রাহুল (১) এবং এই বিশ্বকাপেই পাঁচ-পাঁচটি সেঞ্চুরি করা রোহিত শর্মাকে (১)। তাতেই ৩.১ ওভারে ৫ রানে ৩ উইকেট খুঁইয়ে বসে ভারত। দ্রুত উইকেট হারানোর চাপে আরো চিড়ে-চ্যাপ্টা হওয়ার মতো অবস্থা হয়, যখন ২৪ রানে থাকার সময় হেনরি তুলে নেন দীনেশ কার্তিককেও (৬)। প্রথম ১০ ওভারের মধ্যে ৪৫টি ডট বল তো আর ভারত এমনি এমনি খেলেনি!

বিপর্যয়ের মধ্যে তবু কেউ কেউ হাল ধরে রাখতে চাইলেন। ১৮ রানে একবার জীবন পাওয়া ঋষভ পান্ট (৩২) কিংবা হার্দিক পান্ডেরা (৩২) টিকে থাকার চেষ্টা করলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভরসা হতে পারলেন না। দুজনেই শিকার বাঁহাতি স্পিনার মিচেল স্যান্টনারের। তাঁদের বিদায়ে জয়ের প্রদীপ যখন আরো নিভু নিভু, তখন থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পের শুরু। কিন্তু নায়ক হওয়ার পথে থাকা জাদেজা কিংবা ধোনি শেষ পর্যন্ত অসমাপ্ত সেই গল্পের করুণ পরিণতিই দেখেছেন!