করোনাও আমাদের মানুষ করতে পারেনি!

করোনাও আমাদের মানুষ করতে পারেনি!

এমদাদুল হক সরকার

এমদাদুল হক সরকার

এক, করোনা মহামারির প্রভাবে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত যখন পর্যটকশূন্য তখনই দেখা মিললো বিরল গোলাপি ডলফিনের। সৈকতের কাছে সমুদ্রের নীল পানিতে ঝাঁকে ঝাঁকে ভেসে বেড়াচ্ছে ডলফিনের দল, খেলছে মনের আনন্দে। দুটি দলে প্রায় ২৫ টির মত ডলফিন দেখা যায়। একটি দলে বড় আকারের একটি গোলাপি ডলফিনেরও দেখা মিলে।

গত কয়েক দশকেও এমন বিরল দৃশ্য দেখা যায়নি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে। স্থানীয় একজনের ধারন করা ডলফিনের খেলা করা সেই ভিডিওটি মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। জনমনে খুশির ঢেউ বয়ে যায়, কক্সবাজারের প্রকৃতি বুঝি আবার পুরোনো রূপে ফিরেছে। দুই, করোনার কারণে পর্যটকশূন্য কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে খেলা করা ডলফিনের পুরো দলটিকে হত্যা করা হয়েছে। সাগরে মাছ ধরার সময় জেলেদের ফাঁদে আটকা পড়ায় ডলফিনগুলো হত্যা করা হয়। মৃত ডলফিনগুলো কক্সবাজারের সৈকতে ভেসে আসছে। প্রত্যেক ডলফিনের শরীরে আঘাতের চিহ্ন ও জালের আঘাত রয়েছে। এমনকি জালে আটকানো মৃত ডলফিনও ভেসে আসছে। কতটা অমানবিক হলে এমন কাজ করা যায়! তিন, গত মার্চে হালদা নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণার প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়। সেই হালদাতে এবার ডলফিনের মৃত্যুর তালিকায় যুক্ত হয়েছে নতুন ধরনের নৃশংসতা।

গত ৯ মে সকালে রাউজানের উরকিরচর ইউনিয়নে হালদা সংলগ্ন এলাকায় একটি ডলফিনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ডলফিনের চর্বি থেকে তৈরি তেল নারীদের রোগমুক্তি ঘটে— এমন কুসংস্কারের বশে এ ডলফিনকে হত্যা করা হয়েছে বলে স্থানীয়দের অভিমত। চার, নজিরবিহীন দাবানলে গত বছরের শেষের দিকে ছারখার হয়ে গেছে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল ও পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত আমাজন বনের বিরাট একটি অংশ। সেখানকার বিলিয়ন বিলিয়ন প্রাণী মারা গেছে। প্রকৃতিবিদদের মতে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন ও গ্রীনহাউজ গ্যাস বৃদ্ধির কারনে জলবায়ু পরিবর্তনে প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারাচ্ছে, বিলুপ্ত হচ্ছে বন্যপ্রাণী, পাখি ও কীট-পতঙ্গ। একই সাথে পরিবেশেরও বিপর্যয় ঘটছে। ফলে দাবানলের মত প্রাকৃতিক দৃর্যোগ দেখা দিচ্ছে। যার জন্য মানবজাতি দায়ী। এভাবে প্রকৃতির প্রতি নিষ্ঠুরতা চলতে থাকলে মানবজাতির অস্তিত্ব সংকটে পড়বে বলে হুশিয়ার করেছেন প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা। তবুও প্রাণির প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ, বন উজার থেমে নেই। পাচ, এই মহামারিতে প্রকৃতি যখন আপন রূপে ফিরছে ঠিক তখনই জুম চাষের নামে রাঙামাটির দুর্গম সাজেক এলাকায় শত শত একর সংরক্ষিত পাহাড়ি বনাঞ্চল ও আশপাশের নানা প্রজাতির গাছপালা ও লতাগুল্ম আগুনে পুড়িয়ে ফেলার অভিযোগ উঠেছে। ডেইলিস্টারে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আগুনের লাগামহীন লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড় থেকে পাহাড়ে। আর ধ্বংস হচ্ছে শত শত একর সংরক্ষিত পাহাড়ি বনাঞ্চল।

অনেক সময় আগুনের শিখা থেকে বাদ পড়ছে না বসত ঘরগুলোও। এতে করে হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য। মনে হচ্ছে করোনাও যেন আমাদের মানুষ করতে পারেনি। করোনা পরিস্থিতিতে ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে মানুষ, তখন প্রকৃতি ফিরেছে তার আপন রূপে। মানুষের অত্যাচারে কোণঠাসা পশু পাখি ও বিভিন্ন শ্রেনির বিরল প্রাণীরা এখন অবাধে বিচরণ করছে। আমাদের বাস্তুসংস্থান ও পরিবেশের জন্য এটা আশির্বাদ। বহু আন্দোলন করেও প্রকৃতিপ্রেমীরা যেটা করতে পারছেনা এই মহামারিতে আপনা আপনি সেটা সম্ভব হচ্ছে। এমন পরিস্থিতেও ডলফিন হত্যা, বৃক্ষনিধন নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মত। যার যার অবস্থান থেকে প্রাণীদের প্রতি মানবিক হওয়ার সময় এসেছে। সময় এসেছে প্রাণিকুলের ঋণ শোধ করার। রাস্তায় মানুষ চলবে, গাড়ির চাকায় সভ্যতা এগিয়ে যাবে। প্রকৃতি নিজের মতন স্থান করে নেবে পৃথিবীর বুকে। প্রাণিকুল অরণ্যে, সমুদ্রে, পাহাড়ে নির্ভয়ে যার যার নিজের জায়গায় থাকবে। অর্থাৎ ‘বন্যরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’। করোনা থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত, প্রকৃতির ওপর মানুষ নিষ্ঠুর আচরণ করলে প্রকৃতিও প্রতিশোধ পরায়ন হবে। কাজেই আমাদের অস্তিত্বের জন্য প্রকৃতির প্রতিটি উদ্ভিদ ও প্রাণির প্রতি আমাদের সদয় হতে হবে। আগামী ২২ই মে বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবস। এবারের জীববৈচিত্র্য দিবসের শ্লোগান হোক, "প্রকৃতি বাচলে বাচবে মানুষ রেখো একথা স্মরণ, জীবের প্রতি আর নয় নিষ্ঠুর আচরণ"।

শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।