বাঘ যখন ধূর্ত শিয়াল

বাঘ যখন ধূর্ত শিয়াল

"রাজনীতিতে সততার স্থান নেই, আর সততা দেখাতে গেলে লোটাকম্বল নিয়ে বনে যেতে হবে।"

 ১৯৩৭ সালে বংগীয় বিধানসভার নির্বাচন। সেই নির্বাচনে খাজা নাজিমুদ্দীন (১৮৯৪-১৯৬৪) পটুয়াখালী থেকে ইউনাইটেড পার্টির টিকিটে নির্বাচনে দাঁড়ায়েছেন। তাঁর বিপক্ষে কনটেস্ট করছেন কৃষক-প্রজা পার্টি থেকে এ. কে. ফজলুল হক (১৮৭৩-১৯৬২)। জমজমাট নির্বাচন, একেবারে বাঘে-সিংহে লড়াই। একদিকে বিলেতি ব্যারিস্টার ও জমিদার স্যার নাজিমুদ্দীন অপরদিকে ঝানু উকিল ও বাংলার বাঘ “শের-এ-বাংলা”।

পটুয়াখালীতে স্যার নাজিমের জমিদারী, কাজেই তিনি মনে করেছিলেন যে, প্রজাকুল তাঁকে ছাড়া আর কাউকে ভোট দিতে পারেন না। কিন্তু হক সাহেবের প্রচার কৌশালের কাছে তাঁর সব চেষ্টা ব্যর্থ হল।

নির্বাচনের ডামাডোলের মাঝে একদিন পটুয়াখালীর কাছে একটা দ্বীপরে মত ছোট গ্রামে হক সাহেবের লঞ্চ  ভিড়ল। খবর এসেছিল যে, এই গ্রামের মাতব্বর নাজিমুদ্দিনের গোড়া সমর্থক। তারা হক সাহেবকে এই গ্রামের মাটিতে নামতে দেবে না। হক সাহেবও নাছোড়বান্দা। তিনি বললেন, দেখো এই গ্রামের সব ভোট আমি পাব। তিনি এজেন্ট মারফত গ্রামের মাতব্বর নাম ও তার মৃত বাপের নাম জেনে নিলেন। তারপর গ্রামের ঘাটে লঞ্চ  ভিড়িয়ে একটা লুংগি ও ছেঁড়া পিরহান পরে এবং গলায় জুজদানের মধ্যে একটা ডয়েরী নিয়ে তীরে নামলেন।

 ডাইরীটা ঠিক কোরান শরিফের মত দেখাচ্ছিল। তিনি ধীর পদক্ষেপে মাতব্বরের বাপের নাম ধরে ডাকতে লাগলেন, ফজলু মিয়া বাড়ি আছ? ও ফজলু মিয়া।বাড়ির ভিতর থেকে এক বৃদ্ধ বেরিয়ে এসে বললেন, উনি তো নেই। দু’বছর হল ইন্তেকাল করেছেন।

হক সাহেব যেন শোকে মুষড়ে পড়লেন। তিনি হাওমাও করে কাঁদতে লাগলেন। রুমালে চোখ মুছে বললেন, উনি ইন্তেকাল করেছেন জানাননি কেন? ফজলু মিয়া আমার কত জানের দোস্ত ছিলেন, তা আপনারা জানবেন কি করে? তা ওনার ছেলে বজলু কোথায়?  বৃদ্ধ বললেন, সে বাজারে গেছে; এখুনিই আসবে। তা বাবা আপনাকে তো চিনতে পারলাম না। -তা চিনবেন কি করে? যে চিনতো সে নেই। বজলুও আমাকে চিনবে না। তা বজলু ফিরে এলে বলবেন যে কলকাতা থেকে ফজলুল হক এসেছিল। যাক ফজলু ভাই এর কবরটা কোথায় একটু দেখিয়ে দিন।একটা ছোট ছেলে কবরটা দেখিয়ে দিতে হক সাহেব কবরের পাশে দাঁড়িয়ে মোনাজাত শুরু করলেন। তাঁর সংগে শত শত লোক মোনাজাতে শামিল হল।

মোনাজাত শেষে হক সাহেব লঞ্চের উদ্দেশ্যে ফিরে চললেন। এই সময় বজলু ছুটতে ছুটতে এসে হক সাহেবের কদমবুছি করে বলল, আমি ফজলু মিয়ার ছেলে বজলু। মায়ের মুখে আপনার আসার কথা শুনে ছুটে এলাম। আপনি হুজুর আমার বাড়িতে কিছু মুখে না দিয়ে ফিরতে পারবেন না।

হক সাহেব ওজরআপত্তি করলেন, কিন্তু বজলুও নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত রফা হল যে, বজলু কিছু মুড়ি ও গুড় লে  নিয়ে আসবে। হক সাহেব মুড়ি চিবাতে চিবাতে বললেন, তোমার বাপ বেঁচে থাকলে আমার আর কি এই বুড়ো বয়সে এখানে আসতে হত। কিন্তু সে নেই। আমারও সাহায্য করার কেউ নেই। বজলু বলল, আপনার জন্য জান দিতে রাজী।  বলুন কি করতে হবে।

হক সাহেব বুঝলেন বরফ গলেছে। তিনি পাকা খেলোয়াড়। বললেন, আচ্ছা ভোট হয়ে যাক, তারপর বলব। তোমরা নাজিমুদ্দীনের জমিদারীর প্রজা, কাজেই এখন আমার পক্ষে কাজ করলে তোমরা বিপদে পড়বে। আমার দোস্তের ছেলে বিপদে পড়ুক, এ আমি চাই না।

বজলু তখন বেপরোয়া । সে বলল, হুজুর আপনার মত গরীবের মা-বাপকে যদি আমরা ভোট না দেই, তাহলে আমাদের দুঃখে-কষ্টে আর কে দেখবে? আমার চোখ খুলেছে হুজুর। এ অঞ্চলে একটা ভোটও নাজিমুদ্দীন সাহেব পাবেন না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।

হক সাহেব বজলুর কথায় যেন গলে গেলেন । তিনি তাকে অনেক দোয়া করলেন, বেঁচে থাক বাবা। খোদা তোমাদের তরক্কি করুন। তোমার বাপের রূহ যেন শান্তিতে থাকে।লঞ্চ  ছাড়ল। হক সাহেবের সাথে থাকা সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বের জিজ্ঞাসা করলেন, কান্ডটা কি রকম হল? হক সাহেব হো হো করে হেসে বললেন, রাজনীতিতে সততার স্থান নেই, আর সততা দেখাতে গেলে লোটাকম্বল নিয়ে বনে যেতে হবে।