ঈদ-উল-আযহাতে পালনীয় স্বাস্থ্যবিধি

ঈদ-উল-আযহাতে পালনীয় স্বাস্থ্যবিধি

ফাইল ছবি

ডাঃ মুহাম্মদ আব্দুস সবুর

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
আগামী ০১ আগস্ট বাংলাদেশে পবিত্র ঈদু-উল-আযহা উদযাপিত হবে। মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব এমন সময়ে পালিত হতে চলেছে যখন সারা পৃথিবীর সাথে বাংলাদেশেও মহামারি করোনা হানা দিয়েছে, বিপর্যস্ত করেছে সবাইকে। দেশে করোনা সংক্রমণের শনাক্তের ১৪২ দিন ২৭ জুলাইতে মোট ২৯৬৫ জনের মৃত্যু তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে এর বাইরে প্রতিদিন করোনার উপসর্গ নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের প্রতিবেদন জানাচ্ছে  এখন পর্যন্ত দেশে এরকম অন্তত ১৮৭৪জনের মৃত্যু হয়েছে। দেশে মোট শনাক্তের সংখ্যা ২,২৬,২২৫ জন। আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের ১৬ তম আর মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে ২৭ তম। বেশ কিছুদনি ধরে পরীক্ষা কম হওয়ার ফলে শনাক্তের সংখ্যা কমলেও মৃত্যুর সংখ্যা কমছে না। গত সপ্তাহ থেকে মৃত্যুর হার কিছুটা বেড়েছে। গত সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে ৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২১ তম সপ্তাহের প্রথম দিন ২৬ জুলাই ৫৪ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। পরীক্ষার তুলনায় সংক্রমণ শনাক্তের হার ২০% বেশী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্বিবিদ্যালয় বলেছে, এটি নির্দেশ করে বাংলাদেশে পরীক্ষা কমানোর কারনে নতুন রোগী কমেছে, সংক্রমন কমেনি। সব মিলিয়ে এটি আতঙ্কিত হবার মতো অবস্থা। যেহেতু করোনার কোনো প্রতিষোধক টিকা নেই, জানা নেই সুনির্দিষ্ট চিকিৎসাও; তাই একে প্রতিরোধ করাটাই একমাত্র উপায়। যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে করোনাকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজেকে নিরাপদ রাখার পাশাপাশি  পরিবার ও দেশকে নিরাপদ রাখুন। ঈদের আনন্দ যেন করোনার আক্রমনে বিপর্যস্থ না হয়।


ঈদ-উল-আজহাতে অন্যতম প্রধান করনীয় কোরবানী। সামর্থবানেরা তাদের পছন্দমত গরু বা ছাগল কোরবানী করে থাকেন। সাধারণত পশুর হাটে গিয়েই পশু ক্রয় করা হয়ে থাকে। হাট মানেই অনেক মানুষের সমাবেশ। যেহেতু করোনা মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়, তাই করোনা প্রতিরোধে অন্যতম প্রধান স্বাস্থ্যবিধি, জনসমাবেশ এড়াতে বাড়িতে অবস্থান। যেহেতু বয়স্ক ও শিশুরা করোনাতে আক্রান্ত হলে অবস্থা খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা বেশী তাই তাদের পশু হাটে যাওয়া একেবারেই পরিত্যাজ্য।অনেকে মিলে দল বেধে পশুর হাটে যাওয়ার একটি রেওয়াজ প্রচলিত আছে। সবাই যদি দল বেধে যায় তাহলে পশুর হাটে  জন সমাগম বৃদ্ধি পাবে। ফলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ৩-৬ ফুট নিরাপদ দূরত্ব মানা দুষ্কর হয়ে পড়বে। তাতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়বে। তাই যত কম সংখ্যক লোক পশুর হাটে যাবেন তাতে সবারই মঙ্গল। অনেক ঘোরাঘুরি করে অনেক দেখে-শুনে পশু কেনাটাও আরেকটি রেওয়াজ। হাটে জনসমাগমে যত বেশী সময় কাটাবেন ঘোরাঘুরি করতে ততো সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। তাই হাটে অবস্থান যত কম সময়ের জন্য করা যায় ততই স্বাস্থ্যঝুঁকি কম হবে। পশুর গায়ে হাত দিয়ে দেখে-শুনে কেনাটাও আরেকটি প্রচলিত নিয়ম। মনে রাখতে হবে পশুর গায়ে অসংখ্য লোম রয়েছে। যার মাঝে করোনাভাইরাস থাকতে পারে। তাই প্রতিবার পশু স্পর্শ করে সাবান পানি দিয়ে কম পক্ষে ৩০ সেকেন্ড ধরে হাত ধুতে হবে।  কমপক্ষে স্যানিটাইজার ব্যবহার করে অবশ্যই জীবনুমুক্ত করতে হবে। অনেকে হাতে গ্লাভস পরছেন। তবে খেয়াল রাখতে হবে গ্লাভস পরা অবস্থায় স্পর্শের মাধ্যমে গ্লাভসে জীবানু জমা হতে থাকে। আর এ অবস্থায় গ্লাভস পরা হাত দিয়ে মুখ স্পর্শ করলে কিংবা নাক চুলকালে ভাইরাস সংক্রমণ করতে পারে।


বাড়ি থেকে বেরুনোর আগে মুখে মাস্ক এবং চোখে চশমা পরে নিতে হবে। বাড়ির বাইরে অবস্থানের সময় মুখে মাস্ক রাখা বাধ্যতামূলক। মাস্ক যথাযথভাবে পরে থাকতে হবে। কথা বলার সময় মাস্ক খুলে বা নামিয়ে নিলে কিংবা নিঃশ্বাস নেবার সুবিধার জন্য মাস্ক নাকের নিচে নামিয়ে রাখলে মাস্ক পরার উদ্দেশ্য অর্জন হয় না। তাই এ ব্যাপারে যথাযথভাবে খেয়াল রাখতে হবে।  অনকে সময় চোখের চশমা ঘোলা হয়ে যায় মাস্কের ভিতরের নিঃশ্বাসের কারনে। সেক্ষেত্রে সতর্কতার সাথে  চশমার কাঁচ পরিষ্কার করতে হবে। হাতের বা গ্লাভসের জীবানু যেন চশমার কাঁচে সংক্রমিত না হয় সেটাই বিবেচ্য।


পশু বিক্রেতা, হাসিল সংগ্রহকারী বা অন্য কাজে নিয়োজিত পশুর হাটে সকলকে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে- যেমন ৩-৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখা, মুখে মাস্ক পরা, চোখে চশমা পরা ও কিছুক্ষণ পরপর ত্রিশ সেকেন্ড ধরে সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়া, কমপক্ষে স্যানিটাইজার দিয়ে হাতের জীবানুমুক্ত করা। যেহেতু পশুর হাটের বাইরেও মহল্লাতে, রাস্তা-ঘাটে পশু বেচা কেনা হতে পারে, তাই সেখানে যারা যাবেন তাদেরও যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। যদি সম্ভব হয় এরকম জনসমাগম এড়িয়ে বাড়ীতে অবস্থান করা নিরাপদ।

পশু কিনে আনা ও পরে রক্ষণাবেক্ষণে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কোরবানীর পশু পরিবারের সকলের আকর্ষণ। সবাই এটা দেখতে ও গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করতে চায়। তবে খেয়াল রাখতে হবে যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে মুখে মাস্ক পরে পরস্পরের মধ্যে ৩-৬ ফুট দুরত্ব রেখে ও পশু স্পর্শের পর সাবন পানি দিয়ে কমপক্ষে ত্রিশ সেকেন্ড হাত ধুতে হবে। যিনি কোরবানীর আগ পর্যন্ত পশুর রক্ষণাবেক্ষণ করবেন- যেমন খাবার দেওয়া,  গোসল করানো ইত্যদি তাকে প্রত্যেকবার পশুর সংস্পর্শে আসার আগে ও পরে যথাযথ স্বাস্থ্য বিধি মানতে হবে। মুখে মাস্ক ব্যবহার ও সাবান পানি দিয়ে ত্রিশ সেকেন্ড ধরে হাত ধোয়া পালনীয়।


পশু জবাই করার সময় কয়েকজন মিলে পশুকে শোয়ানো এবং ধরে রাখতে হয়। এ সমস্ত কাজে যথাযথ দুরত্ব (৩-৬ ফুট) মানা সম্ভব হবে না। তবে প্রত্যেকে যেন মুখে মাস্ক পরে থাকে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। জবাইয়ের পর চামড়া ছাড়ানো ও গোশত তৈরীর সময় যথা সম্ভব দুরত্ব বজায় রাখতে হবে। সব সময়ের জন্য মুখে মাস্ক এবং চোখে চশমা ও কিছুক্ষণ পরপর সাবান পানি দিয়ে ত্রিশ সেকেন্ড ধরে হাত ধুতে হবে এ কাজে নিয়োজিত সকলকে।


বাড়িতে গোশত আনার পর ভাগ, বিতরণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য কিংবা রান্নার জন্য যারাই কাঁচা গোশত স্পর্শ করবেন তাদের সবাইকে কিছুক্ষণ পরপর সাবান পানি দিয়ে কমপক্ষে ত্রিশ সেকেন্ড ধরে হাত ধুয় অবশ্য পালনীয়। গোশত নাড়ার সময় কোনোভাবেই হাত ভালোভাবে না ধুয়ে মুখ, নাক বা চোখ স্পর্শ করা যাবে না। গোশত গোছানোর কাজ হয়ে গেলে ভালোভাবে জীবানুনাশক দিয়ে মেঝে মুছে ফেলতে হবে। একইভাবে জীবানুমুক্ত করতে হবে গোশতের জন্য ব্যবহৃত বালতি হাঁড়ি বা অন্য বাসনসমূহ।


রান্না করার সময় অবশ্যই ভালোভাবে ফুটিয়ে রান্না করতে হবে যাতে গোশতে জীবানু থাকলেও তা ধ্বংস হয়ে যায়। একসাথে অনেক গোশত খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। বিশেষ করে বয়স্কদের মনে রাখতে হবে গরুর গোশত, বিশেষত: চর্বি উচ্চ রক্তচাপসহ অনেক সমস্যার কারণ বা এসব সমস্যাকে বাড়িয়ে দেয়।


কারোনাকালে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে পালন করলে নিজেদের সুরক্ষিত রাখা সম্ভব। আপনার নিরাপত্তা আপনার হাতে। স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে না মানলে মৃত্যু ঝুকির সম্ভাবনা বিদ্যমান। নিজেকে সুরক্ষিত রেখে ঈদ উদ্যাপন করুন। ঈদের আনন্দকে সমুন্নত রাখতে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বিকল্প নাই।