কুরবাণীর পশুর সাথে কেমন আচরণ করা উচিত

কুরবাণীর পশুর সাথে কেমন আচরণ করা উচিত

জরিপে দেখা গেছে, আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার গরু কুরবাণী করা হয়ে থাকে।

আমরা অনেকে বাজার থেকে পশু আনার সময় এবং কুরবাণীর করার সময় পশুর সাথে অনেকে বেশি অমানবিক আচরণ করি। এতে করে কিন্তু আপনার পুরো কুরবাণীটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যেতে পারে। কুরবাণী পশুর সাথে এমন আচরণ যেন না করি যাতে করে পশুটির কোন কষ্ট না হয়।

বিশেষ করে জবাই করার আগে পশুটি ভালভাবে বেঁধে নেয়া এবং যে ছুরি দিয়ে জবাই করা হবে সেই ছুরিটি অতি ধারালো অবস্থায় ব্যবহার করা। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আমাদেরকে এই দিক নির্দেশনাই দিয়েছেন। ইসলাম যে কতটা চেকিং ব্যালেন্স অর্থাৎ ভারসাম্যপূর্ণ জীবন বিধান। সহী মুসলিম শরীফে রাসূল (সাঃ) বর্ণনা করেছেন, তোমরা যখন পশুকে জবাই করবে সেখানে এহসান করো। কেননা আল্লাহ্ তা’য়ালা সব জায়গায় এহসানকে অবধারণ করেছেন।

তাই আমাদের জীবনে আমরা যাই করবোনা না কেন; সেটা এহসানের সাথে করতে হবে। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, তোমরা যখন পশু জবাই করবে; তখন সেটার প্রতি এহসান করে জবাই করো। সাহাবীরা প্রশ্ন করলেন কী ভাবে জবাই করবো? রাসূল (সাঃ) বললেন, ছুরিটাকে অতি মাত্রায় ধাঁরালো করে নাও তাতে করে খুব সহজভাবে জবাই কাজটা সম্পন্ন হয়ে যায়। এর ফলে প্রাণীর কষ্ট কম হয়।

আমরা প্রায়ই বেখেয়ালী বা অবহেলাবশত: কুরবাণীর পশু হাট থেকে টেনে নিয়ে আসা বা ট্রাকে ওঠানো এবং ট্রাক থেকে নামানোর সময় পশুর সাথে যেভাবে ব্যবহার করি তাতে পশু অনেকটা ব্যথা পায়। এতে কিন্তু অনেক অমানবিক আচরণ আমাদের দ্বারা প্রকাশ পেয়ে যায়। যদিও আমরা পশুটাকে জবাই করবো সেই ক্ষেত্রে আমরা যেন এহসানের সাথে জবাই করি এবিষয়টি আমরা যেন খেয়াল রাখি।

দ্বিতীয় হলো-আমাদের দেশের অনেক জায়গায় আমাদের কসাইরা বড় ছুরি দিয়ে পশু জবাই করার সময় পশুটির প্রাণ বের হওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করে ছোট ছুরি দিয়ে খুঁচাতে থাকেন। এটা কিন্তু মোটেও ঠিক নয়। জবাই করার পরেও ছুরি দিয়ে খোঁচা দিলে সেটা কিন্তু অপমৃত্যু হতে পারে। অর্থাৎ এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। স্বাভাবিক মৃত্যু হল জবাই করে দেয়া। ইসলাম এটাকে আমাদের জন্য বৈধ করেছে।

আমরা জানি, পাশ্চাত্য গরুর মাথায় বুলেট মারা হয়,ইল্কেট্রিক্যাল শর্ট দিয়ে হত্যা করা হয় আবার ভারী লোহার হাতুড়ি দিয়ে গরুর মাথায় আঘাত করে মারা হয়। কিন্তু ইসলামে এগুলোকে সম্পূর্ণরূপে নিষেধ ঘোষণা করা হয়েছে। বিধান হল জবাই করে দেয়া। সেক্ষেত্রে আমরা যদি ১০ থেকে ১৫ মিনিট একটু অপেক্ষা করি; তাহলে কিন্তু গরুর দেহ থেকে সম্পূর্ণ রক্ত বের হয়ে যাবে। ফলে সেটির গোশত আমাদের জন্য ভাল হবে। 

কিন্তু আমরা যদি তাড়াহুড়ো করে মারতে চাই; বিশেষ করে আমাদের দেশের অনেক কসাই ভাইরা জবাই করার পরে ছোট ছুরি দিয়ে খোঁচা মারতে থাকে। আমরা যখন কুরবাণী করি তখন পশুর শ্বাসনালী এবং কন্ঠনালী কেটে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, রক্তনালী কেটে যাওয়ার পর প্রাণী আর ব্যথা পায় না। যদিও আমরা গরুটির ছটফট করতে দেখি; আসলে আর ব্যথা পায় না। রক্তনালী যখন কেটে ফেলা হয় তখন ব্রেন তার হার্টে সিগনাল দেয় আরো বেশি পাম করার জন্য আরো বেশি রক্ত পাঠানোর জন্য।

ফলে সবগুলো রক্ত গলার ওই কাটা স্থান দিয়ে রক্ত বের হয়ে যায়। কিন্তু যখন ওই কাটা স্থানে খোঁচা দেন তখন কিন্তু স্ট্রোক করে গরুর মৃত্যু হতে পারে। এছাড়াও এসময় হার্ট এটাকে গরু মারা যেতে পারে। তাহলে কিন্তু সেটা স্বাভাবিক জবাইয়ের ফলে মৃত্যু হবে না; সেটা হবে অপমৃত্যু। তখন কিন্তু আপনার কুরবাণীটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যেতে পারে। অনেক ফিকাহবিদরা বলছেন, “যে ভাবে আমরা কুরবাণী করছি; তাতে  আমাদের কুরবাণী কিন্তু ত্রুটিযুক্ত করছি। এজন্য তাড়াহুড়ো না করে ১০ থেকে ১৫ মিনিট একটু অপেক্ষা করুন  এবং প্রাকৃতিকভাবে পশুর রুহ বের হতে দিন। তা না হলে আমাদের কুরবাণী কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যেতে পারে।”

  আর হ্যাঁ কয়েক বছরের জরিপে দেখা গেছে, আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার গরু কুরবাণী করা হয়ে থাকে। সেখানে প্রচুর বর্জ্য হয়। এসব বর্জ্য নিজ নিজ দায়িত্বে পরিষ্কার করতে হবে। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যার যার কাজের জন্য দায়িত্বশীল হও। এব্যাপারে কিয়ামতের দিন জিঙ্গাসাবাদ করা হবে। মনে রাখা দরকার- পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঈমানের অঙ্গ।

আর একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। সেটা হলো-কুরবাণীর গোশত খাওয়ার ব্যাপারে অনেকে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগেন। কুরবাণীর গোশত কয় ভাগ হবে। এব্যাপারে ইসলামে কী বলে। ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর মত অনুযায়ী কুরবাণীর গোশত তিন ভাগ করা উত্তম। তবে এটা আবশ্যক নয়। এক ভাগ নিজে খাবেন, এক ভাগ আত্বীয়স্বজন-প্রতিবেশির খাওয়াবেন এবং এক ভাগ গরীব-দুঃখী মানুষের জন্য দিবেন।  গরীব-দুঃখী মানুষের এটা উপহারের দিন।

সুরাতুল হাজ্ব এর ২৮নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘কুরবাণীর গোশত নিজেরা খাও এবং অভাব-দুর্দশগ্রস্তদেরকে দাও।’ বোখারী শরীফে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, নিজেরা খাও, অন্যকে খাওয়াও এবং এটিকে জমা করে রাখতেও পারো। তবে উত্তম তিন ভাগ করা। (এক) নিজে খাও, (দুই) আত্বীয়স্বজন-প্রতিবেশির খাও এবং (তিন) গরীব দুঃখীদের দাও। তবে মনে রাখতে হবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠি সুবিধা বি ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর উপযুক্ত সময় হলো কুরবাণীর সময়।

এম মাহফুজ আলম : সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক ।