করোনাকালের গল্প

করোনাকালের  গল্প

করোনাভাইরাস। প্রতীকী ছবি।

অধ্যাপক ডা. শামছুন নাহার

শমসের মিয়া তার বাড়ির পাশে পুকুর ঘাটে বসে কি যেন ভাবছে। তখন আকাশে  শুক্লাপক্ষের পঞ্চমী চাঁদ হেসে মেঘের কোলে উঁকিঝুঁকি মারছে। এমন সময় পরশ উল্লাহ, নুরুল সরকার, হারান মোল্লা এসে বসলো। নুরুল জিজ্ঞাসা করলো জ্যাঠামশায় একা বসে কি ভাবছেন এত? শরীরডা কি বালা?

শরীর ঠিক আছে বাপু হে, মনটাই খারাপ।

কেন কি হইছে?

শোন নাই গত কাল আমাদের বাড়ির  ঘটনা?

খানিক চেঁচামেচি শুনলাম রাতে ব্যাপার কি জ্যাঠা মিয়া।

আমার মাইয়াডা মাহি এতদিন পর আসলো, আর বৌমা তার সাথে এমন করলো। ঢাকা থেকে কেউ আসলেই সে নাকি করোনা নিয়ে আসে? তাই বাড়িতে থাকতে দেবেনা, তার শশুর বাড়ি যাইতে কয়। আমি বেঁচে থাকতেই তাদের সাথে এমন ব্যাবহার? মরার পর কি হবে তা তো বোঝাই যায়! মানুষ দিন দিন এত স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে। করোনা আইসে আরো বেশি হয়েছে মনে হয়? মেয়েটা সকালেই চলে গেল, তারপর থেকে মন ভার হয়ে আছে।

এসব কিয়ামতের লক্ষণ, জেঠা! সবাই নিজেরটা ভাল বোঝে। আপনি শোনেন নাই, এই করোনা অসুখে নিজের বাবা, ভাই, মা, স্বামী, এসব আত্বীয়দের হাসপাতালে রেখে আসছে। মারা যাবার পরও দাফন করার জন্যও তাদের খোঁজ নিতে যায় নাই। সেই রকমই দেখছি। এখন আমার যদি করোনা হয় ভাগ্যে তেমনি জুটবে যা বুঝতে পারছি।

আমার জামাই রমজান, সে কাল সন্ধায়, আমার মেয়ে ও নাতনিকে নিয়ে ঢাকা থেকে আইছে তার শাশুড়ী কে দেখতে।

রমজান ঢাকায় ছোটখাটো  ব্যবসা করে। তাই বউ ও বাচ্চা নিয়ে মিরপুরের মীরেরবাগ ছোট একটি দুই রুমের বাসা নিয়ে থাকে। রমজানের গাঁয়ের নাম হারোপাড়া। তার একটাই মেয়ে। ঢাকায় তার বাসার কাছে কিন্টার গার্ডেনে পড়ে। রমজান ফলের ব্যাবসা করে। সাথে কাটা কাপড়ের ব্যবসাও আছে। তাদের সংসার  বেশ ভালোই  চলে। রমজানের বউ মাহি টেকনিক্যাল লাইনে মেট্রিক পাশ করার পর ভর্তি হয়েছিল। তিন বছরের কোর্স শেষ করেছিল। তাই পাশেই একটি ক্লিনিকে টেকনিশিয়ান হিসেবে যোগ দিয়েছে। তাই তাদের সংসার ভালোমতই চলে।

হঠাৎ বাড়ি থেকে মাহির মায়ের ফোন, তার শরীর ভাল যাচ্ছেনা। কয়দিন থেকে জ্বর, পারলে একবার দেখে যাস। কখন  বাঁচি কখন মরি, এটা ছিল মাহির মায়ের কথা।

রমজান ঠিক করলো দেশে যাবে। তার বউ-এর সাথে পরামর্শ করলো। বউ তো মনে মনে খুশি। মায়ের অসুখ দেখে আসতে পারবে। করোনা আসার পর থেকে কোথাও যাওয়া হয় নাই। এবার অনেকদিন পর সুযোগ হলো। তারা বাড়ির লোকজনের জন্য সাধ্যমত কেনাকাটা করলো। মার জন্য একটি শাড়ি, বাবার জন্য পাঞ্জাবি, ভাই এর জন্য শার্ট, ভাবির জন্য একটি তাঁতের শাড়ি এবং ভাই এর ছেলের জন্য জামা কাপড়  খেলনা কিনল।

তারা দুপুরের ট্রেনে রওনা দিল। ট্রেন খানিকটা লেট ছিল। সিল্ক সিটি রেলগাড়ী। নেমেই একটা ভ্যানে চেপে বাড়ির দিকে চললো।

বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে মাহির ভাবি চেঁচিয়ে বাড়িসুদ্ধ লোক জমা করলো। এবার আর বাঁচার পথ নাই। ঢাহার মানুষজন করোনা নিয়ে বাড়িতে ঢুকিছে। আমরা কেমনে বাঁচমু কও দেহি? বউ এর সাথে তাল মিলিয়ে মাহির ভাই ও তাই বলছে। মাহি শশুর বাড়ি না যেয়ে আমাগোরে বাড়ি আসলো কেন? আমাগরে কি মাইরা ফেলানোর ইচ্ছা।

মাহির বাপ বললো তোদের এ কেমন ধারার কথাবার্তা নিজের বোন তার বাবার বাড়ি আসবেনা? তোর মায়ের অসুখ শুনেই তো তারা দেখতে আইছে।

মইন মাহির ভাই এর নাম। সে আবারো বাবাকে জানালো, বাবা ঢাকা থোনে লোক আসলে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকতে লাগে আপনি জানেনা আব্বা?

আমি সবই জানি, তাই বলে মেয়েকে নিষেধ  করবো? তোদের  অসুবিধা  হলে তোরা চলে যা। মঈন বাবার কথা শুনে রাগ করে বউ বাচ্চা নিয়ে বের হয়ে গেল।

তখন আবার বাবার মন খারাপ হলো। রাতের বেলা বউ বাচ্চা নিয়ে কোথায় গেল। মাহি আর তার স্বামী রমজান তাদেরও খারাপ লাগলো। বললো আমরা এসে বাড়িতে এত অশান্তি হলো। রমজান বললো চলো আমাদের বাড়ি  যাই। মাহি বললো কালকে সকালে যাবো। এসেই যখন পরেছি রাতটা থাকি, বিয়ান বেলা যামুনি। অবশেষে  রমজান  আর মাহি যেয়ে তার ভাই-ভাবিকে খুজে নিয়ে আসলো এই বলে, কালকেই চলে যাবো তোমরা বাড়ি আসো।

বাড়িতে এসো মাহি বললো, আমরা টেষ্ট করিয়েছি, আমরা করোনা নেগেটিভ। সে কাগজ আমাদের  সাথেই আছে। দেখতে চাইলে দেখাবো।

মাহির কথায় ভাই ভাবি বাড়িতে ফিরে আসলো। মাহি পরের দিন তার শশুর বাড়ি হারোপাড়ায় চলে গেল।

শমসের মিয়া বললো, একটু  আগে শুনলাম আমার বিয়াই মোশায়ের করনা হইছে, এইবার দেখি বৌমা তার বাপের লগে কেমুন ব্যবহার করে? এইটাই এখন আমার দেখার ব্যপার।