আমার বন্ধু জামিলুর রেজা চৌধুরী

আমার বন্ধু জামিলুর রেজা চৌধুরী

আমার বন্ধু জামিলুর রেজা চৌধুরী

অনেক ব্যস্ততার মধ্যে দিন শুরু হয়েছিল। আগামীকাল আমাদের নির্মাণসংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির মিটিং। দেশের নামকরা অনেক স্থপতি ও প্রকৌশলী এ কমিটির সদস্য। তাদের সবাইকে একত্রে পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী এদের সবার শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তিনি কমিটির চেয়ারম্যান। মিটিংয়ের সব নথিপত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। এটি তার অভ্যাস। খুঁটিনাটি কোনো বিষয়ই তার চোখ এড়ানোর উপায় নেই। গতকাল আশরাফকে (আশরাফুল হাসান), যিনি আমাদের সব নির্মাণ প্রকল্পের কেন্দ্রীয় ব্যক্তি, তিনি ডেকে নিয়েছিলেন নথিপত্রের আরো কিছু ব্যাখ্যা নেয়ার জন্য।

সব ব্যস্ততা হঠাৎ থেমে গেল। অবিশ্বাস্য এক খবর এসে সবাইকে চুরমার করে দিলো। জামিলুর রেজা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আমাদের কর্মকাণ্ডে তিনি এমন ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, তাকে ছাড়া আমরা আমাদের ভাবতেই পারছিলাম না। এরকম একটা সংবাদ কিভাবে সম্ভব! এটি আমরা কিভাবে গ্রহণ করব। মাথায় কিছুই কাজ করছিল না।

তার সম্পর্কে অনেক কথাই শুনেছিলাম ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি আমেরিকায় শিক্ষকতার পেশায় ইস্তফা দিয়ে দেশে ফিরে আসছিলাম। ১৯৭২ সালের জুন মাস। ফেরার পথে আমার ভাই ইব্রাহিমের সাথে দেখা করে যাবো বলে সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে সবার কাছে জামিলুর রেজার নানা গল্প শুনেছিলাম। কয়েক বছর আগে তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে দেশে ফিরে গেছেন। কে জানত এই ব্যক্তির প্রতি আমার অনুভূতি একদিন গভীর বন্ধুত্বে পরিণত হবে সারা জীবন এ বন্ধুত্ব গভীরতর হবে।

গ্রামীণ ব্যাংকের ১৬ সিদ্ধান্তের একটি সিদ্ধান্ত ছিল ‘ভাঙা ঘরে থাকব না, ভাঙা ঘর তাড়াতাড়ি মেরামত করব। যত শিগগিরই সম্ভব নতুন ঘর তুলব।’ বিরাট সিদ্ধান্ত। ১৯৮৭ সালে প্রথমে চারটি খুঁটি তৈরি করতে ঋণ দিলাম। আমরা ছোট প্রতিষ্ঠান। সদ্য পাস করা একজন ইঞ্জিনিয়ার নিয়েছিলাম আমাদের প্রযুক্তিগত বিষয়ের দিকে নজর রাখতে। সেই হলো আশরাফ। প্রথমে নানা রকম খুঁটিনাটি কাজে তাকে ব্যস্ত রাখা হতো। খুঁটি বানানোর কাজে তার ডাক পড়ল। আমাদের সব শর্ত পূরণ করে একটি মজবুত সস্তা খুঁটি বানাতে সোৎসাহে আশরাফ কাজে লেগে গেল। এ কাজে জামিলুর রেজার দৃষ্টি আকর্ষণ করল আশরাফ। ক্রমে ক্রমে আশরাফেরও কাজ বাড়ল আর জামিলুর রেজাও আমাদের সব কর্মে জড়িয়ে গেলেন। খুঁটি থেকে আমরা পূর্ণাঙ্গ গৃহঋণ দেয়ার কাজে অগ্রসর হলাম। ১২ হাজার টাকার গৃহঋণ। ১৯৮৯ সালে আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার পেল গ্রামীণ ব্যাংক এ গৃহঋণ কর্মসূচি ও গৃহঋণের ডিজাইনের জন্য। আমরা মহাখুশি।

জামিলুর রেজার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ল ১৯৯৩ সালে বুয়েটের সমাবর্তন বক্তৃতা ঘিরে। সে বছর বুয়েট আমাকে আমন্ত্রণ জানাল তাদের সমাবর্তন বক্তৃতা দেয়ার জন্য। সেই সমাবর্তন বক্তৃতায় আমাদের গৃহঋণ কর্মসূচির কথাও বললাম। সেখানে এবং অন্যান্য অনেক কাজে প্রকৌশলীদের ভূমিকার কথা বললাম। বক্তৃতার শিরোনাম দিলাম‘পথের বাধা সরিয়ে দিন, মানুষকে এগোতে দিন’। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সরকারের সমালোচনা করায় কেউ কেউ উষ্মা প্রকাশ করলেন। কিন্তু শিক্ষক-ছাত্ররা আমার বক্তব্য পছন্দ করল। জামিলুর রেজা আমার বক্তব্য গভীরভাবে সমর্থন করলেন।

গ্রামীণ ব্যাংকের শুরু থেকে এতে কম্পিউটার ব্যবহারের চেষ্টা চালাচ্ছিলাম। জামিলুর রেজার কাছে সবসময় পরামর্শ নিচ্ছিলাম কি করা যায়। ইন্টারনেট চালু করার ব্যাপারে প্রযুক্তিগত কাঠামো ছিল না। ঢাকা থেকে কোথাও ই-মেইল করতে হলে তখন সেগুলো একত্র করে সিঙ্গাপুরে পাঠাতে হতো। তাৎক্ষণিকভাবে পাঠানোর ব্যবস্থা তখনো সৃষ্টি হয়নি। সব মেইল একত্র করে এক এক দফায় সিঙ্গাপুরে পাঠাতাম। সারা দিনে দু’বার পাঠানো যেত। কম্পিউটার কিনতে হলে সরকারের অনুমতি নিতে হতো।

অনুমতি নেয়াটাও একটা জটিল ব্যাপার ছিল। ফ্যাক্স মেশিন কিনতে হলে সরকারের অনুমতি নেয়া বাধ্যতামূলক ছিল। আমরা সরকারের অনুমতি নেয়ার ব্যাপারটাতে ঘোরতর আপত্তি জানিয়ে আসছিলাম। জামিলুর রেজা সরকারের সব ব্যাখাকে যুক্তিহীন প্রমাণ করলেন। সরকার নিয়ম পাল্টাল না, তবে নিয়মগুলো পালনের ব্যাপারে কড়াকড়ি করা থেকে বিরত হলো।
১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলো। আমি ও জামিলুর রেজা একই সাথে এই সরকারে কাজ করার সুযোগ পেলাম। আমরা ভাবলাম যে, এ সুযোগে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট বাবদ যত প্রতিবন্ধকতা সরকার সৃষ্টি করে রেখেছে সেগুলো বাতিল করে তার জায়গায় কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের ব্যবহার সহজ করার আইনি কাঠামো তৈরি করে ফেলতে হবে।


১৯৯৭ সালে গ্রামীণ কমিউনিকেশন্স প্রতিষ্ঠা করলাম কম্পিউটারাইজেশন, ইন্টারনেটকে বহুলভাবে সম্প্রসারিত করতে। শুরু থেকেই জামিলুর রেজা এর বোর্ডের সদস্য থাকলেন। ধরে নিয়েছিলাম যে, তার হাজারো ব্যস্ততার মাঝে তাকে হয়তো কখনো সখনো বোর্ড মিটিংয়ে উপস্থিত পাবো। আশ্চর্য হলাম তিনি প্রতিটি মিটিংয়ে শুধু উপস্থিত থাকলেন-ই না, প্রতিটি বিষয়ের খুঁটিনাটি বিষয়ে তার মতামত ও পরামর্শ দিচ্ছেন। আমাদের ছোট ছোট কর্মসূচির সাথে তিনি বিশেষ আগ্রহ নিয়ে যুক্ত হয়ে যাচ্ছেন। একটা উদাহরণ দেই আমরা ঢাকার সাথে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ইন্টারনেট সংযোগ করতে পারলেও দেশের ভেতর কোথাও ইন্টারনেট সংযোগ করতে পারছিলাম না। গ্রামীণ কমিউনিকেশন্সের এমডি নাজনীন প্রস্তাব দিলো আমরা পরীক্ষামূলক একটা প্রকল্প নিতে পারি। জামিলুর রেজা সোৎসাহে এতে মেতে গেলেন।

১৯৯৮ সালে আমাদের এই উদ্যোগ শুরু হলো। ঢাকার সাথে কানেকটিভিটি স্থাপন করতেই হবে। জামিলুর রেজা বিভিন্ন পরিকল্পনা দিতে থাকলেন। সিদ্ধান্ত হলো টাঙ্গাইলের মির্জাপুর ও মধুপুরে ভিলেজ ইন্টারনেট ও কম্পিউটার সেন্টার স্থাপন করা হবে। এই সেন্টারগুলোর সাথে ঢাকার ইন্টারনেট সংযোগ থাকবে। এই প্রকল্পের কাজ নিয়ে তিনি ব্যস্ত হয়ে গেলেন। এর অগ্রগতি দেখতে তিনি মির্জাপুর ও মধুপুর গেলেন। শেষ পর্যন্ত ইন্টারনেট সংযোগ সফল হলো। স্থানীয় লোক এ সেন্টারে এসে ঢাকার সাথে যোগাযোগ করা আরম্ভ করল। তিনি রাড্ডা বারননের বোর্ডে ছিলেন। তাদের পরামর্শ দিলেন আউটডোর রোগী ব্যবস্থাপনার উন্নতিতে একটা সফটওয়্যার তৈরি করতে। পরামর্শ দিয়েই তার কাজ শেষ করেননি। গ্রামীণ কমিউনিকেশন্সকে দায়িত্ব দিলেন সেই সফটওয়্যার তৈরি করতে। তার সাথে পরামর্শ দিলেন এই সফটওয়্যার কিভাবে তৈরি করতে হবে। শেষ পর্যন্ত একটি চমৎকার সফটওয়্যার তৈরি করিয়ে দিয়েছেন।

প্রযুক্তির ব্যাপারে তার আগ্রহের কোনো সীমা ছিল না। ১৯৯৭ সালে গ্রামীণফোন কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে মোবাইল ফোনের সম্ভাবনা নিয়ে অত্যন্ত উৎসাহী হয়ে পড়লেন। প্রতিনিয়ত আমাদের পরামর্শ দিচ্ছিলেন এর সাম্প্রতিক ব্যবহার কী হতে পারে। আমরা যখন তাকে গ্রামীণফোনের বোর্ড মেম্বার হতে অনুরোধ করলাম তিনি সোৎসাহে রাজি হয়ে গেলেন। বরাবরের মতো এই বিশাল প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় নথি অতি সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা না করে তিনি কোনো দিন বোর্ড মিটিংয়ে উপস্থিত হননি। গ্রামীণফোনের মতো প্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় তিনি তার মেধার অসামান্য পরিচয় রেখে গেছেন। শুধু মৃত্যু এসে তার এই একনিষ্ঠ ভূমিকায় ছেদ টেনে দিয়েছে।

ক্রমে ক্রমে আশরাফের কাজের পরিধি বাড়ল। আশরাফকে ঘিরে প্রকৌশল বিভাগ সৃষ্টি হলো। গ্রামীণ ব্যাংক খুঁটি নির্মাণ থেকে টয়লেট নির্মাণ, শাখা অফিস নির্মাণের কর্মকাণ্ড থেকে আরো বড় রকমের নির্মাণকাজে নেমে গেল। অন্য দিকে জামিলুর রেজাও দেশব্যাপী জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের মধ্যমণি হয়ে পড়লেন। কিন্তু সব কিছু সত্ত্বেও তিনি আমাদের থেকে দূরে সরে তো যানই নি, বরং সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ করেছেন।

আমাদের অবকাঠামো নির্মাণ ক্রমেই বড় হতে থাকল। গাইড করতে জামিলুর রেজা সবসময় সাথে থাকলেন। অবকাঠামো নির্মাণকে সঠিকভাবে পরিচালনায় তাকে নিয়ে আমরা কমিটি করলাম। নাম দিলাম ‘উচ্চপর্যায়ের কমিটি’। সে কমিটি অবকাঠামো নির্মাণের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কমিটি হিসেবে কাজ করতে থাকল।

প্রথমে শাখা অফিস ও এরিয়া অফিস নির্মাণের কাজ দিয়ে শুরু হলো এর কর্মকাণ্ড। পরে এলো প্রধান কার্যালয় নির্মাণের কাজ। প্রথম পর্বে তিনটি পাঁচতলা ভবন নির্মাণের কাজ। দ্বিতীয় পর্বে একটি ২২তলা ভবন নির্মাণ। ২২তলা ভবন নির্মাণে তিনি গভীরভাবে যুক্ত হয়ে গেলেনÑ বহুতল ভবন নির্মাণের ব্যাপারে তার ব্যক্তিগত ইন্টেলেকচুয়াল আগ্রহের কারণে। সেটি আরো গভীরতর হলো একটা প্রযুক্তিগত বিতর্ককে কেন্দ্র করে। ২২তলা ভবনের ডিজাইনকে নিয়ে। কনসালট্যান্ট কোনোভাবেই ভবনটি পাইল ফাউন্ডেশন ছাড়া নির্মাণ করতে দেবেন না। আর আমাদের প্রকৌশল বিভাগের তরুণ প্রকৌশলীরা মত দিচ্ছে, এটি ম্যাট ফাউন্ডেশনের ওপর অবশ্যই করা যায় এবং এতে নির্মাণব্যয় অনেক কম হবে।

এ দ্বন্দ্ব গড়াল দুই বছর ধরে। নানা যুক্তি, পাল্টা যুক্তি এলো। জামিলুর রেজার নেতৃত্বে নানাভাবে সয়েল টেস্ট করা হলো। অবশেষে তার দৃঢ় সমর্থনে সিদ্ধান্ত হলো এটি ম্যাট ফাউন্ডেশনের ওপর নির্মাণ করা হবে। এর জন্য ম্যাট ফাউন্ডেশনের নতুন একটি প্রযুক্তি ব্যবহার হলো; যেটা এর আগে বাংলাদেশে কেউ ব্যবহার করে দেখেনি। জামিলুর রেজা প্রতিনিয়ত এই নির্মাণের তদারক করেছেন যেন কোথাও এর কোনো ত্রুটি না থাকে। এই ভবন নির্মাণে প্রতিষ্ঠানের বিপুল অঙ্কের অর্থ সাশ্রয় হয়েছে। এই ভবন নির্মাণে প্রতি বর্গফুটে নির্মাণব্যয় হয়েছে মাত্র ৮০০ টাকা! এত কম খরচে এ পর্যন্ত কেউ বহুতল ভবন বাংলাদেশে নির্মাণ করতে পারেনি।

আমাদের কর্মসূচি বিস্তৃত হয়েছে। বহু রকমের নির্মাণকাজ আমরা হাতে নিয়েছি। জামিলুর রেজার সমর্থন ও পরামর্শের আওতা তার সাথে বিস্তৃত হয়েছে। তার মৃত্যুর আগের দিনও তিনি আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন এবং পরদিন মিটিংয়ে থাকা নিশ্চিত করেছেন। এগুলোর মধ্যে ছিল ১৩তলা টেলিকম ভবন নির্মাণ। চিড়িয়াখানা রোডে অবস্থিত এটি একটি অত্যাধুনিক ভবন। তিনি এ ভবনের স্থপতি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত জুরি বোর্ডের সভাপতি ছিলেন। ভবন নির্মাণের সব পর্যায়ে উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে প্রতিনিয়ত এর নির্মাণকাজে পরামর্শ দিয়ে গেছেন।

আমাদের সর্ববৃহৎ নির্মাণকাজটি তার হাতে শুরু হয়েছে। প্রথম পর্বে এক হাজার ছাত্রছাত্রীর জন্য একটি আধুনিক নার্সিং কলেজ নির্মাণ (গ্রামীণ ক্যালিডোনিয়ান কলেজ অব নার্সিং)। অ্যাকাডেমিক ভবনের সাথে ৭০০ ছাত্রীর জন্য ডরমিটরি নির্মাণ। প্রথম পর্বের সমগ্র প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ মাস্টার প্ল্যান ও ভবনের ডিজাইনডিজাইন কম্পিটিশন ওআইয়ের মাধ্যমে আয়োজন করা হয়। যথারীতি জামিলুর রেজা নিষ্ঠা নিয়ে, অনেক সময় দিয়ে, সবার পূর্ণ আস্থা নিয়ে জুরি বোর্ডের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রথম পর্বের কাজ শেষ হয়েছে। নার্সিং কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। অন্যান্য স্থানে নির্মিত সব ভবনে আমরা তাকে নিয়ে প্রবেশ করেছি। আমাদের দুর্ভাগ্য নার্সিং কলেজে আমরা তাকে নিয়ে ঢুকতে পারলাম না।

নার্সিং কলেজের পাশে দ্বিতীয় পর্বের কাজটিও অগ্রসর হচ্ছে। এই পর্বে থাকছে ৫০০ বেডের হাসপাতাল, ৫০০ সিটের মেডিক্যাল কলেজ এবং হেলথ টেকনোলজি ইনস্টিটিউট। এ পর্বের ডিজাইনে দেশী-বিদেশীদের মধ্য থেকে কনসালট্যান্ট বাছাই চূড়ান্ত ও নিয়োগ করার প্রক্রিয়ায় তিনি তার মেধা ও ধৈর্যের অপূর্ব পরিচয় দিয়েছেন। ডিজাইন ডেভেলপমেন্টের খুঁটিনাটি নিয়ে তার সভাপতিত্বে উপদেষ্টা কমিটি নিয়মিত বৈঠক করে যাচ্ছিল। এ কমিটির মিটিং যে তারিখে অনুষ্ঠিত হওয়ার জন্য সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছিল তার আগের দিন তিনি আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেলেন আমাদের না জানিয়ে?২০১৬ সালে আশুলিয়ার জিরাবোতে ঢাকার সর্ববৃহৎ কনভেনশন সেন্টার নির্মাণের সব পর্যায়ে জামিলুর রেজা পরামর্শ দিয়ে গেছেন। এরপর এলো আরেকটি বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ। চিড়িয়াখানা রোডে ১৩তলাবিশিষ্ট অত্যাধুনিক টেলিকম ভবন নির্মাণ।

আমাদের কাজের সাথে কত গভীরভাবে তিনি জড়িত ছিলেন সেটি সবার জানার কথা নয়। তেমনি আরো কত প্রতিষ্ঠানের সাথে তিনি একই রকম গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করেছেন সেটি তারা ছাড়া হয়তো আর কেউ কোনো দিন জানতে পারবে না। আমাদের নির্মাণকাজে তার যে অবদান সেটি আমারও পুরোপুরি জানার কথা নয়। আমাদের প্রকৌশল বিভাগই ভালো করে জানবে। আমি জানি আমাদের প্রকৌশল বিভাগ তারই হাতে তৈরি। তারই আদর্শে উজ্জীবিত।

আমার মজা লাগত যখন দেখতাম কিছুক্ষণ আগে যে জামিলুর রেজা আন্তর্জাতিক পরামর্শক বেষ্টিত হয়ে তাদের জন্য রচিত আলোচ্যসূচির মধ্যে ডুবে ছিলেন তিনি সে মিটিং সেরে এসে অবলীলাক্রমে আমাদের সাথে ভিন্ন ভঙ্গির আলোচনায় বসে গেছেন। যমুনা সেতু অথরিটি কিংবা পদ্মা সেতুর কনসাল্ট্যান্ট বা কন্ট্রাক্টরদের সাথে বাদানুবাদ করে সেই মিটিং থেকে তিনি সোজা আমাদের কাছে চলে আসছেন গ্রামীণ কমিউনিকেশন্সের বোর্ড মিটিংয়ে যোগ দিতে, খুঁটিনাটি বিষয়ে পরামর্শ দিতে। কোনো দিন বলেননি তার ওপর কাজের চাপ বেড়ে গেছে, এখন তিনি আমাদের জন্য আগের মতো সময় দিতে পারবেন না। বরং তিনিই উদ্যোগী হয়ে আমাদের কর্মকর্তাদের ডাকাডাকি করে জানতে চেয়েছেন, পরামর্শ দিয়েছেন।

পদ্মা সেতু, যমুনা সেতু বাংলার মানুষের এই দুই স্বপ্নের সেতুর সাথে তার নাম যুক্ত হতে দেখে দেশের সব মানুষ স্বস্তি পেয়েছে। তিনি সারা জীবন জাতির কাছে নির্ভাবনার প্রতীক হয়ে থেকেছেন। দেশের মধ্যে শত মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তার কোনো কাজে বা কোনো মন্তব্যে জাতি তার ওপর আস্থা কখনো হারায়নি।

জামিলুর রেজা বিশ্বমাপের মানুষ। আমরা সৌভাগ্যবান যে তাকে আমাদের মধ্যে পেয়েছি। তিনি শুধু আমাদের প্রযুক্তি এবং অবকাঠামোর জগতকে সমৃদ্ধ করেননি তিনি তার প্রতিভার ছোঁয়ায় স্থায়ীভাবে এ দেশকে এবং এ দেশের মানুষকে সমৃদ্ধ করেছেন, এ দেশের তরুণদের উদ্বুদ্ধ করেছেন।ধন্যবাদ, জামিলুর রেজা চৌধুরী। আমরা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ রইলাম। তোমাকে আমাদের স্মৃতিতে স্থায়ীভাবে ধরে রেখে তোমার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে যাবো।