ঈমান ভঙ্গের মৌলিক কারণ!

ঈমান ভঙ্গের মৌলিক কারণ!

ঈমান ভঙ্গের মৌলিক কারণ!

নামাজ শুরু করা বা অজু করার পর কিছু কাজ করলে যেমন নামাজ বা অজুু নষ্ট হয়ে যায়, ঠিক তেমনি ঈমান আনার পর কিছু কথা, কাজ ও বিশ্বাস আছে, যা সম্পাদন করলে বা পোষণ করলে ঈমান নষ্ট হয়ে যায়। ঈমান ভঙের কারণগুলো মূলত তিন প্রকার। বিশ্বাসগত, কর্মগত এবং উক্তিগত। প্রত্যেক মুমিনের জন্য অবশ্যই ঈমান ভঙের মৌলিক কারণগুলো জানা অতীব জরুরি। আলেমরা এ ব্যাপারে অনেক লম্বা আলোচনা করেছেন। এখানে উল্লেখযোগ্য ১০টি কারণ আলোচনা করা হলো-

১. আল্লাহর ইবাদতের ক্ষেত্রে কাউকে শরিক করা। যেমন- আল্লাহ ব্যতীত কাউকে সেজদা করা, মাজারে গিয়ে মাজারওয়ালার কাছে কিছু চাওয়া।

আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সঙ্গে অংশীদার করা ক্ষমা করেন না। তা ব্যতীত অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন এবং যে কেউ আল্লাহর সাথে শিরক করে সে এক মহাপাপ করে (সূরা নিসা ৪ : ৪৮)।কেউ আল্লাহর সাথে শিরক করলে অবশ্যই আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করবেন এবং তার আবাস জাহান্নাম। আর জালিমদের জন্য কোনো সাহায্যকারী নেই (সূরা মায়িদা ৫:৭২)।

২. আল্লাহ এবং বান্দার মধ্যে কাউকে মাধ্যম স্থির করলে ঈমান নষ্ট হয়। যেমন- নিজে সরাসরি কোনো কিছু আল্লাহর দরবারে না চেয়ে পীরের মাধ্যম ধরে চাওয়া। এ কথা মনে করা যে, নিজে চাইলে পাওয়া যাবে না, পীর চেয়ে দিলে পাওয়া যাবে। এমন চিন্তা করলে অথবা এমন কথা বললে ঈমান নষ্ট হবে। তাকে আবার খাস দিলে তওবা করে ঈমান আনতে হবে।

আল্লাহ বলেন, ‘তারা আল্লাহকে ব্যতীত যার ইবাদত করে তা তাদের ক্ষতিও করতে পারে না, উপকার করতে পারে না। তারা বলে, এরা আল্লাহর কাছে আমাদের সুপারিশকারী। বলো, তোমরা কি আল্লাহকে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর এমন কিছুর সংবাদ দিচ্ছ, যা তিনি জানেন না? তিনি মহান, পবিত্র এবং তারা যাকে শরিক করে তা হতে তিনি ঊর্ধ্বে’ (সূরা ইউনুস ১০ : ১৮)। জেনে রাখো, অবিমিশ্র আনুগত্য আল্লাহরই প্রাপ্য। যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে তারা বলে, ‘আমরা তো এদের পূজা এ জন্যই করি যে, এরা আমাদের আল্লাহর সান্নিধ্যে নিয়ে যাবে। তারা যে বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতভেদ করছে আল্লাহ তার ফায়সালা করে দেবেন। যে মিথ্যাবাদী ও কাফির আল্লাহ তাকে সৎপথে পরিচালিত করেন না’ (সূরা জুমার ৩৯ : ৩)।

৩. মুশরিক-কাফিরদের কাফির মনে না করলে ঈমান নষ্ট হবে। হালজামানায় এর প্রসার কল্পনাতীত। স্বয়ং তথাকথিত আলেমদেরও এ ব্যাপারে শৈথিল্য ব্যাপক। আল্লাহ হেফাজত করুন। এমন কাফির, যার কুফরির ব্যাপারে আহলুস সুন্নাহ একমত। সেটা আসলি কাফির হতে পারে, যেমন- ইহুদি, খ্রিষ্টান ও হিন্দু সম্প্রদায় আবার মুরতাদ, যিনদিকও হতে পারে, যেমন প্রকাশ্যে আল্লাহ, রাসূল বা দ্বীনের কোনো অকাট্য ব্যাপার নিয়ে কটূক্তিকারী; যাদের কুফরির ব্যাপারে হকপন্থী আলেমরা একমত।

৪. নবী সা:-এর আনীত সংবিধানের চেয়ে অন্য কোনো সংবিধানকে পূর্ণাঙ্গ মনে করা কিংবা অন্য কোনো সংবিধানকে ইসলামের সংবিধান থেকে উত্তম মনে করলে ঈমান নষ্ট হয়। যেমন- বর্তমান যুগে ইসলামের বিধানকে অচল মনে করা। ইসলামের বিধানকে বর্বর বলে আখ্যায়িত করা, আর মানব রচিত সংবিধানকে উত্তম ও যুগোপযোগী মনে করা। অথচ ইসলাম সবসময় সব যুগের জন্য পারফেক্ট। দ্যাটস রাইট।

আল্লাহ বলেন, ‘আপনি কি তাদের দেখেননি, যারা দাবি করে যে, যা আপনার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং আপনার আগে যা অবর্তীণ হয়েছে, আমরা তার ওপর ঈমান এনেছি। তারা বিচার-ফায়সালা নিয়ে যেতে চায় তাগুতের কাছে, অথচ তাদের প্রতি নির্দেশ হয়েছে, যাতে তারা তাকে মান্য না করে। পক্ষান্তরে শয়তান তাদের প্রতারিত করে পথভ্রষ্ট করে ফেলতে চায়’ (সূরা নিসা ৪ : ৬০)।

৫. ইসলামের কোনো বিধানকে আন্তরিকভাবে অপছন্দ করে বাহ্যিকভাবে ইসলামের ওপর আমল করলেও এতে ঈমান নষ্ট হয়। যেমন- পর্দার হুকুমকে অপছন্দ করা কিংবা উপযুক্ত ব্যক্তির একাধিক বিয়েকে অপছন্দ করা। এমনিভাবে জিহাদকে অপছন্দ করা। জিহাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা বা তার অপব্যাখা করা।

আল্লাহ বলেন, ‘অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে বিচারক বলে মনে না করে। এরপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোনোরকম সঙ্কীর্ণতা পাবে না এবং তা সন্তুষ্টচিত্তে কবুল করে নেবে’ (সূরা নিসা ৪ : ৬৫)।

৬. দ্বীনের কোনো বিধান নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করলে ঈমান নষ্ট হয়।আল্লাহ বলেন, ‘তুমি তাদের প্রশ্ন করলে তারা নিশ্চয়ই বলবে, আমরা তো আলাপ-আলোচনা ও ক্রীড়া-কৌতুক করছিলাম। বলো, তোমরা কি আল্লাহ, তাঁর আয়াত ও তাঁর রাসূলকে বিদ্রুপ করছিলে? তোমরা অজুুহাত দেয়ার চেষ্টা করো না। তোমরা তো ঈমান আনার পর কুফরি করেছ’ (তাওবা ৯ : ৬৫-৬৬)।

৭. জাদু করলে বা কুফুরি কালাম করলে ঈমান নষ্ট হয়। আল্লাহ বলেন, ‘সুলাইমান কুফরি করেনি, কুফরি তো করেছিল শয়তানরাই। তারা মানুষকে জাদু শিক্ষা দিত’ (সূরা বাকারা ২ : ১০২)।

৮. ইসলামের বিপক্ষে বা মুজাহিদদের বিপক্ষে কাফিরদেরকে সাহায্য করা। যেটা আজ আমাদের সমাজে প্রবল আকারে ধারণ করেছে। অতএব যে বা যারা মুজাহিদদের বিপক্ষে কাফেরদেরকে সাহায্য করবে তারা কাফের হয়ে যাবে। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের পিতা ও ভাইও যদি ঈমানের বিপরীতে কুফরিকে বেছে নেয়, তবে তাদের অন্তরঙ্গরূপে গ্রহণ করো না। তোমাদের মধ্যে যারা তাদের অন্তরঙ্গরূপে গ্রহণ করে, তারাই সীমালঙ্ঘনকারী’ (সূরা তাওবা ৯ : ২৩)। ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা পরস্পরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে কেউ তাদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে সে তাদেরই একজন বলে গণ্য হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না’ (সূরা মায়িদা ৫ : ৫১)।

৯. কাউকে দ্বীন-শরিয়তের ঊর্ধ্বে মনে করলে ঈমান নষ্ট হয়। যেমন- মারেফতের ধোঁয়া তুলে নিজেকে ইসলামের হুকুম আহকামের ঊর্ধ্বে মনে করা। বাতেনিভাবে নামাজ-রোজা আদায়ের কথা বলা। আল্লাহ বলেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম’ (সূরা মায়িদা ৫ : ৩)।

১০. দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া। দ্বীনের হুকুম আহকামকে বোঝা মনে করা। মৌলিকভাবে দ্বীনকে অপছন্দ করলে ঈমান নষ্ট হয়। আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের নিদর্শনাবলি দ্বারা উপবিষ্ট হয়েও তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তার অপেক্ষা অধিক অপরাধী আর কে? আমি অবশ্যই অপরাধীদের শাস্তি দিয়ে থাকি’ (সূরা সাজদা ৩২ : ২২)।

উপরোল্লিখিত প্রত্যেকটি কারণ এমন, যার একটি যদি কারো মধ্যে পাওয়া যায়, তাহলে তার ঈমান ভেঙে যাবে। এগুলোর ওপর অটল থাকলে সে কাফের-মুরতাদ হয়ে যাবে। ওই অবস্থায় তার কোনো ইবাদত কবুল হবে না। তার জানাজাও অনুষ্ঠিত হবে না। ওই হালতে মৃত্যু হলে চিরকাল জাহান্নামে থাকতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের হিফাজত করুন। আমীন।
লেখক : প্রাবন্ধিক