কে এই ইবরাহিম রইসি?

কে এই ইবরাহিম রইসি?

এক সমর্থকের হাতে ইবরাহিম রইসির পোস্টার - ছবি : এএফপি

ইরানের বর্তমান প্রধান বিচারপতি সাইয়েদ ইবরাহিম রইসি দেশটির অষ্টম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। শুক্রবার ইরানে অনুষ্ঠিত ত্রয়োদশতম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৬০ ভাগের বেশি ভোট পেয়ে হাসান রুহানি পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।

৬০ বছর বয়সী ইবরাহিম রইসি ইরানের রক্ষণশীল শিবির থেকে আসা। প্রধান বিচারপতির পদে থেকেই তিনি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। আগস্টের শুরুতেই তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহ সাইয়েদ আলী খামেনির মতোই তিনি কালো পাগড়ি পরেন। ইসলামের শিয়া ধারার আলেমদের মধ্যে নবী মুহাম্মদ (সা.) এর বংশধরেরা নিজেদের বিশেষভাবে চিহ্নিত করতে কালো পাগড়ি পরেন।

ধারণা করা হচ্ছে, ৮২ বছর বয়সী খামেনির মৃত্যুর পর তিনিই সর্বোচ্চ নেতার আসনে স্থলাভিষিক্ত হবেন।

উত্তর-পূর্ব ইরানের মাশাহাদ শহরে ১৯৬০ সালের ডিসেম্বরে এক শিয়া আলেম পরিবারে ইবরাহিম রইসি জন্ম গ্রহণ করেন। ১৫ বছর বয়সে তিনি ধর্মীয় শিক্ষার জন্য ইরানের সুপরিচিত কেন্দ্র কোমের মাদরাসায় ভর্তি হন। সেখানে তিনি আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিসহ অন্য খ্যাতনামা আলেমদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন। 

১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ইরানের রাজতন্ত্রের পতন হয়ে দেশটিতে ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

বিপ্লবের পর দক্ষিণ-পশ্চিম ইরানের মসজিদ সুলাইমান শহরে সরকারি কৌসুলির দফতরে যোগ দেন ইবরাহিম রইসি। পরে ছয় বছর ইরানের বিভিন্ন স্থানে সরকারি কৌসুলি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

১৯৮৫ সালে রাজধানী তেহরানের কৌসুলি দফতরে উপ-কৌসুলি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি।

ইরাক-ইরান যুদ্ধ পরবর্তী ১৯৮৮ সালে কথিত 'ডেথ কমিশনের' সদস্য হিসেবে ইরানে কয়েক হাজার রাজনৈতিক বন্দীকে বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিষয়ে ইবরাহিম রইসিকে অভিযুক্ত করা হয়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র তার ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইবরাহিম রইসিই প্রথম ব্যক্তি হতে যাচ্ছেন, যার ওপর যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

১৯৮৯ সালে ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহ সাইয়েদ রুহুল্লাহ খোমেনির মৃত্যুর পর নতুন সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে দায়িত্ব নেন সাইয়েদ আলী খামেনি। ওই সময় থেকে বিচার বিভাগে ইবরাহিম রইসি ক্রমেই উপরে উঠতে থাকেন। তেহরানের কৌসুলি,
বিচারপতি, ইরানের জেনারেল ইন্সপেকশন অর্গানাইজেশনের প্রধান থেকে উপ প্রধান বিচারপতির পদে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।

উপ প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালনকালেই ২০০৬ সালে দক্ষিণ খোরাসান প্রদেশ থেকে তিনি শিয়া আলেমদের প্রতিনিধি সভা 'বিশেষজ্ঞ পরিষদে' (মজলিসে খবরগানে রাহবরি) সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে পরামর্শ দান ও ওই পদে নির্বাচন-রদবদলের
বিষয়ে 'বিশেষজ্ঞ পরিষদ' কাজ করে। রইসি বর্তমানেও এই সভার সদস্য রয়েছেন।

অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় রইসিকে ২০১৬ সালে মাশহাদের ইমাম রেজার মাজার ও সংশ্লিষ্ট স্থাপনা ও সংস্থা নিয়ন্ত্রণ করা প্রতিষ্ঠান অস্তান-ই-কুদুস রাজাভি ট্রাস্টের তত্ত্বাবধায়ক পদে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি নিয়োগ দেন।

ট্রাস্টের তত্ত্বাবধায়কের পদে থেকে রইসি মাশহাদের প্রভাবশালী ধর্মীয় ও ব্যবসায়ী ব্যক্তিত্বের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেন তিনি।

ব্যক্তিগত জীবনে রইসি দুই মেয়ের বাবা। তার শ্বশুর সাইয়েদ আহমদ আলামুলহুদা মাশহাদের জুমার নামাজের খতিব হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করে আসছেন এবং 'বিশেষজ্ঞ পরিষদে' তিনি মাশহাদ শহরের প্রতিনিধিত্ব করছেন।

২০১৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইবরাহিম রইসি প্রথম প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য দাঁড়ান। ওই নির্বাচনে দ্বিতীয়বার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আসা বর্তমান প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির কাছে তিনি পরাজিত হন। ৭৩ ভাগ ভোটারের উপস্থিতির ওই নির্বাচনে ইবরাহিম রইসি এক কোটি ৬০ লাখ ভোট লাভ করেন। মোট ভোটের হিসাবে ওই নির্বাচনে রইসির প্রাপ্ত ভোট ৩৮ ভাগ। 

এই দায়িত্বে থেকেই তিনি ২০২১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন।

নির্বাচনী প্রচারণার শুরুতেই ইরানের ৩২ প্রদেশ সফর করেন তিনি। নিজেকে পরিশ্রমী ইরানি জাতির প্রতিনিধি হিসেবে প্রচার করে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই স্থানীয় বাণিজ্যের প্রসারের মাধ্যমে ইরানের অর্থনীতিকে সামনে এগিয়ে নেয়ার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেন দেন।

যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয় দেশের সাথে পরমাণু সমঝোতায় ২০১৫ সালে স্বাক্ষর করা জয়েন্ট কম্প্রেহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) চুক্তির বিষয়ে শুরুতে বিরোধিতা করলেও নির্বাচনী প্রচারণাকালে তিনি জানান, রাষ্ট্রের অন্য চুক্তির মতোই তিনি এই চুক্তি সংরক্ষণ করবেন। তবে 'শক্তিশালী সরকার' গঠনের মাধ্যমে এই চুক্তিকে সঠিক গতিপথে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে মত প্রকাশ করেন তিনি।

শুক্রবার ইসলামী বিপ্লব পরব্তী ইরানে অনুষ্ঠিত ত্রয়োদশতম নির্বাচনে ৬১.৯৫ ভাগ ভোট পেয়ে দেশটির অষ্টম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন সাইয়েদ ইবরাহিম রইসি।

সূত্র : আলজাজিরা