পাবনার তিন উপজেলার সাড়ে সাত হাজার খামারিরা দুশ্চিন্তায়

পাবনার তিন উপজেলার সাড়ে সাত হাজার খামারিরা দুশ্চিন্তায়

পাবনার তিন উপজেলার সাড়ে সাত হাজার খামারিরা দুশ্চিন্তায়

দেশে করোনা সংক্রমণের কারণে কঠোর লকডাউনে আসন্ন ঈদ উল আযহাকে সামনে রেখে গরু পালন এলাকা হিসেবে বিখ্যাত পাবনা জেলার চাটমোহর, বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলার সাড়ে সাত হাজার গরু পালনকারীরা বিক্রি ও দাম নিয়ে এবার চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। অবিক্রীত থেকে যাওয়ার আশংকা রয়েছে হাজার হাজার খামারির গরু।

করোনা পরিস্থিতির কারণে বিশেষ করে এই তিন উপজেলার প্রায় সাড়ে সাত হাজার খামারী ও কৃষকরা এবার কোরবানির হাটে ও বাড়ি থেকে গরু বিক্রির ভরসা করতে পারছেন না।

এমতাবস্থায় এখন থেকেই অনেক যত্ন ও ধারদেনা করে বড় করা গরুগুলোকে বিক্রির চেষ্টা করছেন তারা। কিন্তু অন্যান্য বছরের মত এবার বাড়ি বাড়ি ঘুরে গরু কেনায় আগ্রহী ব্যাপারীদের দেখা নেই। এ ছাড়া ক্রেতার অভাবে হাটে নিয়েও গরু বিক্রি করা যাচ্ছে না বলে জানান খামারিরা।

তিন উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় ও খামারিদের সূত্রে জানা যায়, চাটমোহর, বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলা দেশের অন্যতম গরু লালন-পালনকারী হিসেবে ব্যাপক পরিচিত রয়েছে সারা দেশে। তিন উপজেলার প্রায় সাড়ে সাত হাজার খামারে প্রায় আটাশ থেকে ত্রিশ হাজারেরও বেশি গরু কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।

প্রতিবছর কোরবানির হাট শুরুর মাস দেড়েক আগে থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকার গরুর ব্যাপারীরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে গরু কেনা শুরু করেন। এ ছাড়া তিন উপজেলার পশুর হাটগুলো থেকেও ব্যাপারীরা গরু কিনে দেশের বিভিন্ন জেলার হাটে বিক্রি করে থাকেন।

আরেকদিকে বেড়েছে গো খাদ্যের দাম। আগাম বর্ষার পানি ও বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে ঘাসের জমি। জানা যায়, গত তিন মাসে ভূষির বস্তা প্রতি দাম বেড়েছে তিন শ’ টাকা। অন্যান্য গো খাদ্যের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন অবস্থায় গরু পালন ও বিক্রি নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছে খামারি ও সাধারন কৃষকেরা।

বেড়া উপজেলার চাকলা গ্রমের খামারি আবদুল মান্নান মাষ্টার জানান, করোনার পরিস্থিতির কারণে এবার গরু কেনায় আগ্রহী ব্যাপারীদের দেখাই নেই। এমন পরিস্থিতিতে আমার মত বহু খামারি চিন্তায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তাদের আশঙ্কা এবারের কোরবানির হাটে ক্রেতার অভাবে কম দামে গরু বিক্রি করতে হতে পারে। কোরবানির হাট শুরু হলেও কঠোর লকডাউনের কারণে হাটে ব্যাপারী না আসায় হাটে নিচ্ছেন না গরু। বহু গরু অবিক্রীত থেকে যাবে।

বেড়া-সাঁথিয়ার অন্যতম গরু ব্যবসায়ী হলেন বেড়া পৌর এলাকার বৃশালিখা মহল্লার আব্দুল মমিন। তিনি জানান, অন্যান্য বছরে গরুর ব্যাপারীরা এত দিনে ঢাকার কোরবানির হাটকে সামনে রেখে গরু খামারীদের কাছ থেকে গরু কেনা শুরু করে দেন। কিন্তু এবার ব্যাপারীরা গরু কিনতে আসতে পারছেন না। গত বছরে তিনি এত দিনে ৬০টির মতো গরু কিনেছিলেন বলে জানান। কিন্তু এবার কেনেননি। তিনি আরও বলেন, করোনার কারনে হাটে গরুর দাম কেমন হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণেই তিনি গরু কিনছেন না।

সাঁথিয়া উপজেলার আফড়া গ্রামের খামারি শাজাহান আলী জানান,‘এবার কপালে যে কি আছে তা বুঝবার পারতিচিনা। এহন পর্যন্ত একজন ব্যাপারিও গরু দেখবার আসে নাই হাটেও গরুর দাম নাই। গরু বেচবার পারবোনে কি না হেই চিন্তায় ঘুম আসে না। আমার মনে করোনা ভাইরাসের আতঙ্কের চেয়ে গরু বিক্রি না হওয়ার আতঙ্ক বেশি। গরুকে তো না খাইয়ে রাহা যায় না। ২৫ টি গরু পালতে কয়েক লাখ টাহা খরচ হচ্ছে। গরু বেচবার না পারলি খুব মুসকিলে পরে যাবো নে এবারও’।

সাঁথিয়ার করমজা চতুর হাটে গিয়ে দেখা যায়, হাটে অল্প কিছু গরু উঠেছে। জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে গরু আসেনি শুধু আশপাশের এলাকা থেকে কিছু খামারী ও কৃষককেরা বিক্রির জন্য গরু এনেছে। হাটের ইজারাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, হাটে চার ভাগের একভাগ গরু উঠেছে। কঠোর লকডাউনেরর জন্য যানবাহন বন্ধ থাকায় দুর দুরান্তের ব্যাপারীরা আসেনি। যে কারনে গরু বিক্রি হয়নি খুব একটা। কিন্তু ক্রেতা নেই বললেই চলে।

হাটে গরু বিক্রি করতে আসা বেড়া উপজেলার কুশিয়ারা গ্রামের আবদুস ছাত্তার আলী জানান,‘সকাল দশটায় তিনটি গরু আনছি এহন বাজে ১টা কোন ব্যাপারী দামই কয় নাই। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে গরু কিনেছি। দোকান বাঁকি করে গরু পালন করেছি, দোকানদারদের হালখাতা করতে হবে। এহন গরুর বিক্রি করতে না পারলি বিপদে পড়তে হবে। অন্য বছর এই সময়ে বাড়ি থেকেই গরু বিক্রি হয়ে যায়। কিন্তু এবার হাটে এনেও বিক্রি করা যাচ্ছে না।’ সামনের কোরবানির হাটে গরুর দাম নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা।

ছাগলের হাট ঘুরে একই চিত্র দেখা যায়, ব্যাপারীর সংখ্যা নেই বললেই চলে। অনেক ছাগল বিক্রেতাকে হাট থেকে ছাগল ফিরিয়ে আনতে দেখা গেছে।

করমজা চতুর হাটের পশুর হাট পরিচালনাকারীদের অন্যতম মিজানুর রহমান (উকিল) বলেন,‘আমাদের হাটে ক্রেতা বিক্রেতাসহ সর্বসাধারণের জন্য মাস্ক ছাড়া প্রবেশ নিষেধ ঘোষণা করেছি। আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে হাট বসানোর উদ্যোগ নিয়েছি। আমাদের হাটে আজ আমরা প্রায় সাত হাজার মাস্ক বিনা পয়সায় বিতরণ করেছি। এ ছাড়া স্যানিটাইজার ও হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। হাটে বেচাকেনা একেবারেই নেই বললেই চলে। অন্য বছরের মত ঢাকা, মানিকগঞ্জ, চিটাগং এর ব্যাপারীরা আসছে না। কমবেশি যা বিক্রি হচ্ছে তা স্থানীয় ব্যাপারী ও কৃষকদের কাছে।’ তাই এ বছর অন্তত: খামারিদের অর্ধেক গরু অবিক্রীত থেকে যাবে বলে আশংকা করা হচ্ছে।