আমাদের জন্য কুরবানীর শিক্ষা

আমাদের জন্য কুরবানীর শিক্ষা

ফাইল ফটো

আমরা পৃথিবীতে প্রেরিত হয়েছি মূলত: মহান আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করার জ্ন্য। আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের জন্য ইবাদত গুলোর মধ্যে কুরবানী হলো অন্যতম। 

কুরবানী বলা হয় আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য অর্জন ও তার এবাদতের জন্য পশু জবেহ করা। আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু জবেহ করা তিন প্রকার হতে পারে : ১. হাদী ২. কুরবানী ৩. আকীকাহ ॥

তাই কুরবানী বলা হয় ঈদুল আজহার দিনগুলোতে নির্দিষ্ট প্রকারের গৃহপালিত পশু আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য জবেহ করা।

 ইসলামি শরিয়তে এটি ইবাদত হিসেবে সিদ্ধ, যা কুরআন, হাদীস ও মুসলিম উম্মাহর ঐক্যমত দ্বারা প্রমাণিত। কুরআন মজীদে যেমন এসেছে :

 فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ

“তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও পশু কুরবানী কর।’

অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন:

قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ. لَاشَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ

‘বল,আমার সালাত,আমার কুরবানী,আমার জীবন ও আমার মরণ জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে। তার কোন শরিক নাই এবং আমি এর জন্য আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলিম।’(সূরা আনয়াম: ১৬২-১৬৩)

رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِينَ فَبَشَّرْنَاهُ بِغُلامٍ حَلِيمٍ فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانظُرْ مَاذَا تَرَى قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِن شَاء اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيمُ قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلاء الْمُبِينُ وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الآخِرِينَ

প্রকৃত পক্ষে কুরবানীর থেকে কি শিক্ষা নেয়া উচিত তা আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন যে

 وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الآخِرِينَ

  “পরবর্তী কালের লোকদের জন্য এটাকে দৃষ্টান্ত স্বরূপ স্থাপন করলাম।” [সুরা-সাফফাত ৩৭: ১০৮]।

এখানে কুরবানীর ঘটনার দ্বারা এ দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো যে, ইব্রাহীম (আঃ) দুনিয়ার সকল কিছুর উপর অর্থাৎ নিজের সন্তানের জীবনের চেয়েও আল্লাহর হুকুমকে প্রাধান্য দিলেন। আল্লাহ তায়ালার হুকুমের কাছে নিজের এবং তার সন্তানের জীবন তুচ্ছ করে দিলেন। তিনি নিজের সন্তানকে কুরবানী দিতে গিয়ে কোন দ্বিধা দ্বন্দ্ব বা ইতস্ততা বোধ করেন নি, কিংবা কোন অজুহাত ও তুলে ধরেননি। তিনি ইচ্ছে করলে বলতে পারতেন যে,

. হে আল্লাহ! আমার বার্ধক্য বয়সের একমাত্র সন্তানকে তুমি এরকম কঠিন আদেশ থেকে আমাকে ক্ষমা কর, কিংবা

২. হে আল্লাহ! তোমার দ্বীন প্রচারের জন্য ছেলে চেয়েছিলাম, তোমার দ্বীনের কাজের জন্য এ ছেলেটাকে বেঁচে থাকতে দাও, কিংবা

. যেহেতু তিনি বিষয়টি স্বপ্নে দেখেছেন, তাই স্বপ্নের উপর ভিত্তি করেই সন্তান কুরবানী করা উচিত হবে কিনা, কিংবা স্বপ্নের ব্যাখ্যা ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে সন্তান কুরবানী করা থেকে বিরত থাকার পথ খুঁজতে পারতেন। তিনি এরকম কোন অজুহাত না তুলে আল্লাহ তায়ালার হুকুমের কাছে সন্তানের জীবনকে উৎসর্গ করে দিলেন।

কারণ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,

إِنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ ۚ وَاللَّهُ عِنْدَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ ﴿١٥﴾

“তোমাদের ধন সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি তো কেবল পরীক্ষাস্বরূপ।” (সূরা তাগাবুন: ১৫)

হযরত ইব্রাহিম (আঃ) সে পরীক্ষাই দিলেন। মূলতঃ মুসলমানদের জন্য এটাই আল্লাহ তায়ালা নিদর্শন হিসেবে স্থাপন করেছেন যে, তারা সকল অবস্থায় নিজেদের জান-মাল, সন্তান-সন্ততিসহ সকল কিছুর উপর আল্লাহর হুকুম পালন করাকে প্রধান্য দিবে। এজন্যই আল্লাহ তায়ালা ঘটনাটিকে মুসলমানদের দৃষ্টান্ত হিসেবে বর্ননা করেছেন।

ইব্রাহীম (আঃ)-এর জীবনে এরকম আর একটি ঘটনা। তৎকালীন দেশের বাদশাকে বলা হতো নমরুদ। তিনি যখন বললেন যে, আল্লাহ তায়ালার শাসন ছাড়া আর কারো শাসন মানবো না,নমরুদের শাসন মানা যাবে না। তখনই নমরুদ বাদশা সভাষদদের নিয়ে পরামর্শে বসলো এবং হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে রাষ্ট্রদ্রোহী সাব্যস্ত করা হলো। বর্তমানে যে রকম রাষ্ট্রদ্রোহীদের ফাঁসি দেয়ার ব্যবস্থা আছে, তখনও রাষ্ট্রদ্রোহীদের মৃত্যুদণ্ড দেয়ার জন্য আগুনে পুড়িয়ে মারা হতো। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে  রাষ্ট্রদ্রোহীতার অপরাধে আগুনে পুড়িয়ে মারার জন্য বিচার করা হলো। ইব্রাহীম (আঃ) আগুনে পুড়ে মরার ভয়ে কিংবা জীবন বাঁচানোর জন্য তিনি নমরুদের শাসন মেনে নেননি। কারণ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,

    إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَىٰ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ (111)  التوبة

 “আল্লাহ মুসলমানদের থেকে তাদের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে।” [আত তাওবাহ-৯:১১১]।

তাই ইব্রাহীম (আঃ) আল্লাহ তায়ালার হুকুমকে প্রাধান্য দিয়ে প্রয়োজনে জীবন বিষর্জন দিতে তৈরি হলেন। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তায়ালার হুকুম মানতে গিয়ে জীবন চলে যেতে পারে তবুও বাতিলের সাথে আপোষ করা যাবে না। হয় বাতিলকে অস্বীকার করতে হবে অন্যথায় বাতিলকে মেনে নিতে হবে। এ দুয়ের মাঝামাঝি কোন অবস্থান নেই, যেখান থেকে বলা যাবে যে আমি হকের উপর আছি আবার বাতিলের সাথেও ভাল সম্পর্ক আছে। এ দুটি ঘটনার দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, কোন প্রকার ওজর আপত্তি বা অজুহাত ছাড়াই জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার আদেশ পালনের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। মূলতঃ এটাই হচ্ছে কুরবানীর শিক্ষা।

মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের কুরবানীর শিক্ষা বাস্তব জীবনে পালন করার তৌফিক দান করুন। আমিন