মার্কিন সৈন্যদের বিদায়ের পর কেমন হবে আফগানিস্তানের জীবনমান?

মার্কিন সৈন্যদের বিদায়ের পর কেমন হবে আফগানিস্তানের জীবনমান?

মার্কিন সৈন্যদের বিদায়ের পর কেমন হবে আফগানিস্তানের জীবনমান? - ছবি : সংগৃহীত

অবশেষে প্রায় দুই দশক যুদ্ধের পর আফগানিস্তান ছাড়ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সৈন্যরা। যে তালেবানদের প্রতিহত করতে তারা দেশটিতে এসেছিল সেই তালেবানরাই এখন দ্রুতগতিতে বিভিন্ন এলাকা দখল করে নিচ্ছে।

এই যুদ্ধ কিভাবে আফগানিস্তানকে বদলে দিয়েছে, আগামীতেই বা কী ঘটতে যাচ্ছে?

তালেবান কি ফিরে এসেছে?
২০০১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর অভিযানের পর আফগানিস্তান থেকে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল তালেবান। এরপর দেশটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। পরে সেখানে একটি নতুন সংবিধান গৃহীত হয়।

চলতি বছর প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ঘোষণা অনুযায়ী আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিচ্ছে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী। এ অবস্থায় দেশটির বিভিন্ন এলাকা আবারো দখলে নিচ্ছে তালেবান।

বিবিসির আফগান সার্ভিস ১২ জুলাই পর্যন্ত আফগানিস্তানের অবস্থা যাচাই করে দেশের কোন কোন এলাকা সরকার এবং তালেবানের নিয়ন্ত্রণে আছে তা নিশ্চিত করেছে।

এই মানচিত্রে যে এলাকাগুলোর নিয়ন্ত্রণ কার হাতে তা নিয়ে বিতর্ক আছে বলে দেখানো হয়েছে-সেগুলোতে হয় যুদ্ধ চলছে, নতুবা জেলাটির কিছু অংশে তালেবানের জোরদার উপস্থিতি রয়েছে।

বাস্তব অবস্থা নিয়ত পরিবর্তনশীল। অনেক জায়গায় বাইরের কারো প্রবেশাধিকারও সীমিত। তাই রিপোর্ট যাচাই করা অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে তালেবান নতুন নতুন এলাকা দখল করছে। মনে করা হয়, আফগানিস্তানের এক তৃতীয়াংশের নিয়ন্ত্রণই এখন তাদের হাতে।

২০০১ সালের পর থেকে কত লোক নিহত হয়েছে?
প্রায় ২ দশকের লড়াইয়ে আফগানিস্তানে এবং সীমান্তের ওপারে প্রতিবেশী পাকিস্তানে উভয় পক্ষেই হাজার হাজার যোদ্ধা নিহত হয়েছে। এই সংঘাতের মধ্যে পড়ে বেসামরিক মানুষও নিহত হয়েছে।

চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে বেসামরিক লোক নিহত হওয়ার সংখ্যা এক বছর আগেকার তুলনায় ‘অনেক বেশি’।

জাতিসঙ্ঘের দিক থেকে বলা হচ্ছে, এর কারণ হলো ঘরে তৈরি বোমা বা আইইডি’র ব্যবহার এবং আগে থেকে আক্রমণের লক্ষ্য স্থির করে চালানো হত্যাকাণ্ড।

আফগানিস্তানে ২০২০ সালে যত বেসামরিক লোক নিহত হয়েছেন তার মধ্যে ৪৩ শতাংশই নারী ও শিশু।

কত লোক ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন?
বছরের পর বছর ধরে চলা সহিংস সংঘাতের কারণে লাখ লাখ লোক বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছেন। অনেকে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন, অথবা আরো দূরের কোনো দেশে আশ্রয় চেয়েছেন। অনেকে আফগানিস্তানের ভেতরেই ছিন্নমূল এবং গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। আরো লাখ লাখ মানুষকে ব্যাপক দুর্ভোগ ও অনাহারের মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে।

গত বছর লড়াইয়ের কারণে বাস্তুচ্যুত হন চার লাখেরও বেশি লোক। তা ছাড়া ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত আফগানিস্তান ছেড়ে পালিয়েছেন প্রায় ৫০ লাখ মানুষ। তারা দেশে ফিরতে পারেননি। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীতে যে দেশগুলোতে বাস্তুচ্যুত লোকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি- তাদের মধ্যে আফগানিস্তান হচ্ছে তৃতীয়।

আফগানিস্তানের দেশব্যাপী সম্পদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে করোনাভাইরাস মহামারী। লকডাউন ও লোক চলাচলের ওপর নানা বিধিনিষেধ জারির ফলে অনেক মানুষের অর্থ উপার্জনের ক্ষমতার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে - বিশেষ করে এটা ঘটেছে গ্রামীণ এলাকাগুলোতে।

জাতিসঙ্ঘের মানবিকবিষয়ক দফতর বলছে, আফগানিস্তানের ৩০ শতাংশেরও বেশি লোক খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে জরুরি পরিস্থিতি বা সঙ্কটজনক স্তরে রয়েছে।

মেয়েরা কি এখন স্কুলে যেতে পারছে?
তালেবানের পতনের ফলে আফগানিস্তানে নারী অধিকার ও শিক্ষার ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ও অগ্রগতি হতে পেরেছিল।

১৯৯০-এর দিকে দেশটিতে মাধ্যমিক স্তরের স্কুলে একটি মেয়েও ভর্তি হয়নি। প্রাইমারি স্কুলে যেতো মাত্র ৯ হাজার মেয়ে শিশু।

২০০৩ নাগাদ ২৪ লাখ মেয়ে স্কুলে যাচ্ছিল। এখন দেশটিতে স্কুলে যাচ্ছে এমন মেয়ের সংখ্যা প্রায় ৩৫ লাখ। তা ছাড়া সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের এক-তৃতীয়াংশই মেয়ে। কিন্তু ইউনিসেফের তথ্য মতে, আফগানিস্তানে এখনো ৩৭ লাখ শিশু স্কুলে যায় না। তার ৬০ শতাংশই মেয়ে।

এর প্রধান কারণ হচ্ছে চলমান লড়াই, আর পর্যাপ্তসংখ্যক স্কুল ও নারী শিক্ষকের অভাব।

তালেবান বলছে, এখন তারা আর নারী শিক্ষার বিরোধী নয়। কিন্তু মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, যেসব এলাকা এখন তালেবান নিয়ন্ত্রণে সেগুলোতে খুব কম তালেবান কর্মকর্তাই মেয়েদেরকে বয়ঃসন্ধির পর স্কুলে যাওয়ার অনুমতি দেন।

নারীদের সুযোগ অনেক বেড়েছে
আফগানিস্তানে নারীরা এখন সরকারি কর্মকাণ্ডেও অংশ নিচ্ছেন, তারা রাজনৈতিক পদে আসীন হচ্ছেন এবং অনেকে ব্যবসা করছেন। ২০১৯ সাল নাগাদ এক হাজারেরও বেশি আফগান নারী তাদের নিজস্ব ব্যবসা শুরু করেছেন।

দেশটির সংবিধানে বলা হয়েছে, পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে কমপক্ষে ২৭ শতাংশ পদ মেয়েদের পেতে হবে। এখন আফগান পার্লামেন্টে নারীর সংখ্যা এ অনুপাতের সামান্য বেশি - ২৪৯টি আসনের ৬৯টিতে আছেন নারী এমপিরা।

জীবনধারায় কতটা পরিবর্তন এসেছে?
আফগানিস্তানে অবকাঠামো সংক্রান্ত অনেক সমস্যা থাকলেও মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ছে।

জানুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত জনসংখ্যার ২২ শতাংশ বা ৮৬ লাখেরও বেশি লোকের ইন্টারনেট আছে। লাখ লাখ মানুষ এখন সামাজিক মাধ্যমও ব্যবহার করছেন।

মোবাইল ফোনের ব্যবহারও বাড়ছে - দেশটির ৬৮ শতাংশ লোকই এখন মোবাইল ফোনের মালিক।

তবে জাতিসঙ্ঘ বলছে, মোবাইল সেবায় অনেক সময়ই বিভ্রাট ঘটে এবং তা যোগাযোগের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

আফগানিস্তানে প্রাপ্তবয়স্কদের ৮০ শতাংশেরই কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই। নিম্ন আয়ের দেশগুলোর মধ্যেও এই হার অনেক বেশি।

এর কারণ হিসেবে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ ছাড়াও - বিশ্বব্যাংক বলছে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিশ্বাসও প্রভাব ফেলে। আরো দুটি কারণ হলো, অর্থখাতের ওপর লোকের আস্থার অভাব এবং আর্থিক খাতে সাক্ষরতার নিম্ন হার।

অবশ্য বিশ্বব্যাংক মনে করছে, নতুন কিছু প্রকল্পের কারণে আগামী পাঁচ বছরে অ্যাকাউন্টধারী আফগানের অনুপাত বেড়ে যাবে।

রাজধানী কাবুলে গত ২০ বছর অনেকগুলো বহুতল ভবন উঠেছে, শহরের জনসংখ্যাও বাড়ছে। -বিবিসি