আত্মসমর্পণ ও তাকওয়ার কোরবানি

আত্মসমর্পণ ও তাকওয়ার কোরবানি

আত্মসমর্পণ ও তাকওয়ার কোরবানি

কোরবানি শব্দটি আরবি কারবুন মূল ধাতু থেকে এসেছে। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে নিকটবর্তী হওয়া, নৈকট্য লাভ করা, উৎসর্গ করা ইত্যাদি। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় ১০ জিলহজ ফজর থেকে ১৩ জিলহজ সন্ধ্যা পর্যন্ত নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু জবাই করাকে কোরবানি বলে। কোরবানি মূলত মহান আল্লাহর আদেশ পালন। কুরআনে এসেছে, ‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করো ও পশু কোরবানি করো।’ (সূরা আল কাউসার-০২) রাসূল সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না সে যেন আমার ঈদগাহে না আসে।’ (ইবনে মাজাহ-৩১২৩, হাদিসটি হাসান)

আদম আ: থেকে পৃথিবীর সব জাতিই কোনো না কোনো পদ্ধতিতে আল্লাহর দরবারে নিজেদের প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করেছেন। কুরআনে এসেছে, ‘প্রত্যেক জাতির জন্য আমি কোরবানির নিয়ম করে দিয়েছি; যাতে তারা আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে, যে সমস্ত জন্তু তিনি রিজিক হিসেবে দিয়েছেন তার উপর। তোমাদের ইলাহ তো এক ইলাহ; অতএব তাঁরই কাছে আত্মসমর্পণ করো।’ (সূরা আল হাজ্জ-৩৪) এ ছাড়াও সুন্নাতে ইবরাহিম হিসেবে রাসূলুল্লাহ সা: এবং সাহাবিরাও প্রতি বছর কোরবানি করেছেন। অতঃপর যুগের পরিক্রমায় সামর্থ্যবানদের মধ্যে এটি অব্যাহত আছে।মানব জীবনে কোরবানির মধ্যে রয়েছে অনেক শিক্ষা, যার অনুধাবন মুমিন জীবনকে সুন্দর ও স্বার্থক করবে । যেমন

১. আনুগত্য : বান্দার প্রতি মহান আল্লাহর যেকোনো আদেশ শিরোধার্য এবং বান্দা তা পালন করতে বাধ্য। চাই মহান আল্লাহর সে আদেশ সহজ হোক ও কঠিন হোক। সর্বাবস্থায় আল্লাহর আদেশের আনুগত্য করা মুসলিমের কর্তব্য। এক্ষেত্রে দুনিয়ার ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির মায়া-মমতা প্রতিবন্ধক হতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা ইবরাহিম আ:কে আনুগত্যের চরম পরীক্ষায় অবতীর্ণ করেছিলেন। আর ইবরাহিম আ:-এর আনুগত্য ছিল শর্তহীন। কুরআনে এসেছে, ‘যখন তাঁর প্রভু তাকে বললেন আত্মসমর্পণ করো, তিনি বললেন আমি বিশ্বপ্রতিপালকের জন্য আত্মসমর্পণ করলাম।’ (সূরা আল বাকারা-১৩২)

২. তাকওয়া বা আল্লাহভীতি : তাকওয়া এমন একটি মহৎ গুণ যা ব্যতীত মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় না। একজন মুসলিমের অন্যতম চাওয়া হলো আল্লাহর নৈকট্য অর্জন। পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে কোরবানিদাতা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে। কুরআনে এসেছে, ‘আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না তাদের গোশত, রক্ত বরং তোমাদের তাকওয়া।’ (সূরা আল হাজ্জ-৩৪)

৩. তাওহিদ বা একত্ববাদ : মহান আল্লাহর একত্ববাদ বা তাওহিদকে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠা করা কোরবানির অন্যতম লক্ষ্য। কারণ, একমাত্র বিশ্বজাহানের মালিক মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে তার নামেই পশু কোরবানি দেয়া হয়। জগতের অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা যেখানে তাদের দেব-দেবির নামে কোরবানি করে, সেখানে মুসলিমরা কোরবানি দেয় একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে। ফলে কোরবানির মাধ্যমে তাওহিদ বা একত্ববাদের স্বীকৃতি প্রকাশ পায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘প্রত্যেক উম্মতের ওপর আমি কোরবানির বিধান রেখেছিলাম, যাতে তারা এ পশু জবাই করার সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করে, এ জন্য যে, তিনি চতুষ্পদ জন্তু থেকে তোমাদের জন্য রিজিক নির্ধারণ করেছেন। অতএব তোমাদের প্রভু তো কেবল একজনই, অতএব তারই জন্য আত্মসমর্পণ করো আর বিনয়ীদের সুসংবাদ দাও।’ (সূরা আল হাজ্জ-৩৪)

৪. আল্লাহর নৈকট্য অর্জন : মুমিনের চাওয়া পাওয়া হলো একমাত্র মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জন। তাকওয়া ব্যতীত নৈকট্য অর্জন সম্ভব নয়। পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে কোরবানিদাতা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে। কুরআনে এসেছে, ‘এটাই হলো আল্লাহর বিধান; যে আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে সম্মান করে, নিঃসন্দেহে তা অন্তরের তাকওয়া থেকেই। (সূরা আল হাজ্জ-৩২)

৫. আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ : কোরবানির শিক্ষা হলো আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ত্যাগ স্বীকার করা। ইবরাহিম আ: ত্যাগের সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, যা কিয়ামত পর্যন্ত স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ফলে আমাদের উচিত জীবনের সব ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর জন্য জান ও মালের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করা। আর সে ক্ষেত্রে প্রয়োজন সর্বাধিক প্রিয় বস্তুটি তাঁর রাস্তায় কোরবানি করা। কুরআনে এসেছে ‘তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের সর্বাধিক প্রিয় বস্তু তাঁর জন্য ব্যয় করবে না।’ (সূরা আলে ইমরান-৯২)

৬. ইখলাস ও বিশুদ্ধ নিয়ত : প্রতিটি কাজের সাওয়াব ও বিশুদ্ধতা নিয়তের উপর নির্ভরশীল। যাবতীয় ইবাদতের উদ্দেশ্য একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। কোরবানির উদ্দেশ্যও অনুরূপ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘বলুন, আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও মরণ বিশ্বজগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য।’ (সূরা আল আনআম-১৬২) সুতরাং সব ইবাদতে অবশ্যই একনিষ্ঠতা ও বিশুদ্ধ নিয়ত থাকতে হবে।

৭. অসহায়দের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব : কোরবানির অন্যতম শিক্ষা দরিদ্র ও অসচ্ছলদের সুখ-দুঃখে ভাগীদার হওয়া এবং দারিদ্র্য বিমোচন। কোরবানির পশুর গোশত নিজে খাওয়ার পাশাপাশি আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী ও দরিদ্রদের মাঝে বণ্টন সমাজের অসহায় মানুষের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করার শিক্ষা দেয়। তাছাড়া পশুর চামড়া বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ গরিব মিসকিনদের মাঝে বণ্টন করার মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব হয়। কোরবানির গোশত সেসব অসহায়দের মাঝে বণ্টন করার আদেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘(কোরবানির গোশত)-এর থেকে তোমরা নিজেরা খাও এবং অভাবী ও ফকির- মিসকিনকে খাওয়াও।’ (সূরা আল হাজ্জ-২৮)

৮. সবর বা ধৈর্য : কোরবানি থেকে আমরা সবরের শিক্ষা পাই। যেকোনো ধরনের ত্যাগ স্বীকার স্বীকার করার জন্য প্রয়োজন ধৈর্যের। যেমনটি ইসমাইল আ: দেখিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তা বাস্তবায়ন করুন। অচিরেই আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মাঝে পাবেন।’ (সূরা সাফফাত-১০২)

৯. তাকওয়ার জীবন : কোরবানির সুমহান দীক্ষা হলো তাকওয়াভিত্তিক জীবন-যাপন। জীবনের সব ক্ষেত্রে তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জনই মুমিনের প্রকৃত সফলতা। বস্তুত আল্লাহ তায়ালা মুত্তাকিদের কোরবানি কবুল করে থাকেন। আদম আ:-এর পুত্র হাবিলের কোরবানি কবুল প্রসঙ্গে এসেছে, ‘একমাত্র আল্লাহ মুত্তাকিদের থেকে কবুল করেন।’ (সূরা আল মায়িদাহ-২৭ )

অতএব, কোরবানি শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়; বরং পরিশুদ্ধ জীবন গঠনের নিয়মতান্ত্রিক অনুশীলনও বটে। এর মাধ্যমে ইখলাস, আনুগত্য, তাকওয়া, সবর, সহমর্মিতা অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের অপূর্ব নজির স্থাপন করা যায়। ফলে তাকওয়াভিত্তিক জীবন যাপন সহজ হয়।