কুরবানির ইতিহাস ও শিক্ষা

কুরবানির  ইতিহাস ও শিক্ষা

নাহিদ হাসান সেতু

প্রারম্ভিকাঃ

কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন

ঈদুজ্জোহার চাঁদ হাসে ঐ
এলো আবার দুসরা ঈদ,
কোরবানি দে, কোরবানি দে
শোন খোদার ফরমান তাগিদ

কুরবানি শব্দটি হিব্রু  কোরবান (קרבן) এবং সিরিয়ান  কুরবানা শব্দদুটির সঙ্গে সম্পর্কিত যার আভিধানিক অর্থ কারো নিকটবর্তী হওয়া।অন্যদিকে করব বা কোরবান (قرب বা قربان) শব্দটি উর্দূ ও ফার্সীতে (قربانى) কুরবানি নামে রূপান্তরিত। এর অর্থ হলো-নৈকট্য বা সান্নিধ্য।সামগ্রিকভাবে কুরবানি শব্দের অর্থ হলো নৈকট্য ,ত্যাগ এবং উৎসর্গ।ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ত্যাগের মনোভাব নিয়ে পবিত্র জিলহজ্ব মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে গৃহপালিত এবং হালাল পশু আল্লাহর নামে উৎসর্গ করাকে কুরবানি বলে।মানব সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাস থেকে সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত যে,পৃথিবীর সব জাতি এবং সম্প্রদায় মহান রবের

দরবারে তার প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করতেন।সকলের উদ্দেশ্য একটাই- আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন।

পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন,"

আমি প্রত্যেক উম্মাতের জন্য কুরবানির বিধান নির্ধারণ করে দিয়েছি যাতে তারা ওই পশুদের জবাই করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। আর তোমাদের প্রতিপালক তো এক আল্লাহই,সুতরাং  তোমরা তাঁরই অনুগত হও।" (সূরা হজ্জ: ৩৪)

অন্য আরেক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা আদেশ করেছেন, "(হে রাসূল) বলুন:নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ সবই সারা জাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যে নিবেদিত। তাঁর কোন শরীক নেই।’ (সূরা আন‘আম: ১৬২-৬৩)

আল্লাহ তায়ালা আরও বলেছেন, . فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ

"অতএব আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কুরবানি করুন।" (সুরা কাউসার : আয়াত ২)

এছাড়াও একাধিক আয়াতে কুরবানি আদায়ের জন্য মহান আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ প্রদান করেছেন।সুতরাং একথা স্পষ্ট যে,কুরবানি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কুরবানি মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের এক সুবর্ণ সুযোগও বটে।

কুরবানির ইতিহাসঃআল্লাহ তায়ালা মানব জাতি সৃষ্টির পর থেকেই কুরবানির বিধান দিয়েছেন।

পৃথিবীর সব জাতি ও সম্প্রদায় কোন না কোনওভাবে আল্লাহর দরবারে নিজেদের প্রিয় বস্তু কুরবানী দিয়েছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন, “আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কুরবানীর এক বিশেষ রীতি পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি। যেন তারা এসব পশুর উপর আল্লাহর নাম নিতে পারে। যে সব আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন”। (সূরা আল হজ্জ-৩৪)।

পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম (আ:)-এর সন্তান হাবিল ও কাবিলের মধ্যে বিয়ে নিয়ে মতভেদ দেখা দিল।হযরত আদম (আ.) তাঁর এ দুই সন্তান হাবীল ও কাবীলের মতভেদ দূর করার উদ্দেশ্যে বললেন: ‘তোমরা উভয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে কুরবানি পেশ কর। যার কুরবানি গৃহীত হবে, তার সাথেই আকলিমার বিয়ে দেয়া হবে।’

সে সময় কুরবানি গৃহীত হওয়ার একটা সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল যে, আকাশ থেকে একটি অগ্নিশিখা এসে সে কুরবানিকে জ্বালিয়ে দিত। আর যার কুরবানি কবুল হতো না তার টা সেখানেই পড়ে থকত।

তখনকার কুরবানির পদ্ধতি সম্পর্কে জনা যায়, কাবিল ছিলেন চাষী। তিনি গমের শীষ থেকে ভাল ভালগুলো বের করে নিয়ে খারাপ গুলোর একটি আটি কুরবানির জন্য পেশ করলেন। আর হাবিল ছিলেন পশুপালনকারী। তিনি তার জন্তুর মধ্যে থেকে সবচেয়ে ভাল একটি দুম্বা কুরবানির জন্য পেশ করেন। এরপর নিয়মানুযায়ী আকাশ থেকে অগ্নিশিখা এসে হাবিলের কুরবানিটি ভষ্মীভূত করে দিল। আর কাবিলের কুরবানীিযথাস্থানেই পড়ে থাকল। (সংক্ষেপ; তাফসীর ইবনু কাসীর, দুররে মনসূর, ফতহুল বায়ান, ৩/৪৫ ও ফতহুল ক্বাদীর, ২/২৮-২৯)

হাবিল ও কাবিলের কুরবানির ঘটনা পবিত্র কুরআনে এভাবে বলা হয়েছে- “আপনি তাদেরকে আদমের দু’ পুত্রের ঘটনাটি ঠিকভাবে শুনিয়ে দিন। যখন তারা উভয়ে কুরবানী পেশ করলো, তখন তাদের একজনের কুরবানি গৃহীত হল, আর অপর জনের কুরবানি গৃহীত হলো না। (সূরা আল মায়িদাহ, ২৭ আয়াত)। ‘আদম (আ.) থেকে মুহাম্মাদ (সা.) পর্যন্ত প্রত্যেক জাতিকে আল্লাহ তা’আলা তার নৈকট্য লাভের জন্য কুরবানীর বিধান দিয়েছেন। (তাফসীরে নাসাফী ৩/৭৯; কাশশাফ, ২/৩৩)।

মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে যত শরীয়ত নাযিল হয়েছে, প্রত্যেক শরীয়তের মধ্যে কুরবানি করার বিধান জারি ছিল। প্রত্যেক উম্মতের ইবাদতের এ ছিল একটি অপরিহার্য অংশ।বর্তমান কুরবানির ইতিহাস নবী হযরত ইব্রাহীম (আ:) থেকে এসেছে। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, "ইব্রাহীম (আ.) যখন আমার কাছে দু’আ করল- হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে এক সৎকর্মশীল পুত্র সন্তান দান কর। অতঃপর আমি তাকে এক অতি ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। অতঃপর সে যখন তার পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে পৌঁছল, তখন ইবরাহীম (আ:) বলল, ‘বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবেহ করছি। এখন বল, তোমার অভিমত কী? সে বলল, ‘হে পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তাই করুন। আল্লাহ চাইলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীলই পাবেন। দু’জনেই যখন আনুগত্যে মাথা নুইয়ে দিল আর ইবরাহীম তাকে কাত করে শুইয়ে দিল। তখন আমি তাকে ডাক দিলাম, ‘হে ইবরাহীম! স্বপ্নে দেয়া আদেশ তুমি সত্যে পরিণত করেই ছাড়লে। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি। অবশ্যই এটা ছিল একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি এক মহান কুরবানির বিনিময়ে পুত্রটিকে ছাড়িয়ে নিলাম। আর আমি তাঁকে পরবর্তীদের মাঝে স্মরণীয় করে রাখলাম। ইবরাহীমের উপর শান্তি বর্ষিত হোক! সৎকর্মশীলদেরকে আমি এভাবেই প্রতিদান দিয়ে থাকি। সে ছিল আমার মু’মিন বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত। (সূরা আস-সাফফাত: ১০০-১১১)।বিস্তারিতভাবে উল্লিখিত আছে যে,হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর বয়স যখন ৮৬ বছর তখন বিবি হাজেরার গর্ভে এক পুত্র সন্তান জন্ম নিল। তাঁর নাম রাখা হয় ইসমাঈল। এই পুত্রকে নিয়ে কিছুদিন পর কঠিন এক পরীক্ষায় উপনীত হলেন পিতা হযরত ইব্রাহিম। পুত্রের যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার মত বয়স হলো তখন তিনি স্বপ্নে দেখলেন এবং ছেলেকে বললেন, হে বৎস আমি স্বপ্ন দেখেছি যে আমি তোমাকে জবেহ করছি। কোন কোন রেওয়ায়েত থেকে জানা যায় যে, এই স্বপ্ন হযরত ইব্রাহিম (আ)-কে ওপর্যুপরি তিন দিন দেখানো হয়, তবে এ কথা সত্য যে, পয়গাম্বরের স্বপ্নও ওহি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, "হে ইবরাহিম! তুমি কুরবানি কর।" সকালে ওঠে তিনি হৃষ্টচিত্তে একশত উট কুরবানি করলেন, কিন্তু পরবর্তী রাতেও তিনি একই নির্দেশ প্রাপ্ত হলেন, আবার তিনি পরের দিন সকালে একশত উট কুরবানি করলেন। তৃতীয় রাত্রে আবার স্বপ্ন দেখলেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে ইবরাহিম! তুমি কুরবানি কর। তিনি আরজ করলেন, মা’বুদ! আমি কি কুরবানি করবো? ইরশাদ হলো, তোমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় জিনিসটি আমার রাস্তায় উৎসর্গ কর। অন্য রেওয়ায়েতে নামসহ বলা হয়েছে, এটি জিলহজ্ব মাসের দশ তারিখ রাতের কথা। সুতরাং তাঁর নিকট পরিষ্কার হয়ে গেল যে, আজ আদরের ছেলে ইসমাঈলকে কুরবানি দিতে হবে। অতপর তিনি কুরবানির সংকল্প সম্মন্ধে হযরত হাজেরা (আ) কে অবহিত করলেন এবং বললেন, তাঁকে নতুন কাপড়-চোপড় পরিয়ে দাও। বিবি হাজেরা আ. তার কলিজার টুকরা পুত্রকে গোসল করিয়ে উত্তম পরিচ্ছেদে আচ্ছাদিত করলেন এবং প্রাণ ভরে চির জীবনের মত বুকে জড়িয়ে আদর সোহাগ করে বললেন, যাও আমার পুত্র! আল্লাহর জন্য নিজেকে উৎসর্গ কর। সে দিনটি ছিল কুরবানির দিন। যে সময়ে কিরণ হেজাজের উপত্যকাগুলোতে প্রতিফলিত হয়ে চিকচিক করছে। এমতাবস্থায় ইবরাাহিম আ. বললেন, ইসমাইল! ছুরি ও রশি নিয়ে জঙ্গলে আস। ইসমাইল আ. আব্বার আদেশ পেয়ে দৌড়ে লম্বা রশি ও তীক্ষ ছুরি নিয়ে জঙ্গল অভিমুখে চললেন।

প্রথমেই ইবরাাহিম আ. ইসমাঈলকে স্বপ্নের কথা অবগত করে তার থেকে জবেহের বিষয়ে পরামর্শ চাইলেন। হে পুত্র! তুুমি ভেবে দেখ তোমার অভিমত কি? ইসমাঈল বলে উঠলেন, আল্লাহ আপনাকে যে হুকুম করেছেন, তা পালন করুন আব্বাজান। আমার থেকে বড় সৌভাগ্যবান কে আছে যে, আপন পিতার জবেহের মাধ্যমে আমি মহান আল্লাহর সাথে মিলিত হতে পারবো। আর বিলম্ব নয়, এখনই বিসমিল্লাহ বলে আমার গলায় ছুরি চালিয়ে দিন, যাতে ইবলিস আমাদের এই নেক নিয়তকে নষ্ট করার সুযোগ না পায়। হযরত ইবরাাহিম আ. স্বীয় সন্তানের মুখে একথা শুনে আনন্দে অধীর হয়ে উঠলেন এবং আদরের টুকরা সন্তানকে ঐ পাথরের নিকট নিয়ে গেলেন, যেখানে হজের মৌসুমে কুরবানির পশুগুলো মিনা নামক স্থানে নিয়ে জবেহ করা হয়। অতপর হযরত ইসমাঈল আ. বললেন, ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন। হযরত ইবরাাহিম আ. ছুরিতে পাথরের শান দিতে লাগলেন। এদিকে ঊর্ধ্ব জগতের ফেরেশতাকুলের মাঝে পড়ে গেল হাহাকার। এমন একটি দৃশ্যের অবতারনা হচ্ছে, যার দ্বিতীয় কোন উপমা নেই, ছুরি ধার দেওয়া হয়ে গেছে। ইবরাাহিম আ. নিজের পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন। অদৃশ্য জগতে পড়ে গেল ক্রন্দনের রোল, কিন্তু কারো জানার ক্ষমতা নেই, মহান আল্লাহ কোন উদ্দেশ্যে আপন খলিলের মাধ্যমে এরূপ হৃদয় বিদায়ক ঘটনা ঘটাচ্ছেন। আল্লাহ-ই তো ভালো জানেন। তারপর তড়িৎ-গতিতে বিসমিল্লাহ বলে তীক্ষ ছুরি বের করে নিলেন এবং পুত্রের গলায় ছুরি চালিয়ে দিলেন। এই ঘটনাকে আল্লাহ তায়ালা কুরআনে কারীমের সুরায়ে সাফফাতে উল্লেখ করেছেন যে, যখন তারা আত্মসমর্পন করলেন এবং পুত্রকে উপুড় করে শোয়ালেন তখন আমি ডাকলাম হে ইবরাাহিম! নিশ্চয়ই আপনি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছেন, আমি বিশিষ্ট বান্দাদেরকে এরূপ পুরস্কার প্রদান করে থাকি। প্রকৃতপক্ষে ইহা এক বড় পরীক্ষা।

এ মর্মান্তিক দৃশ্যে ঊর্ধ্ব জগতের ফেরেশতাজগত, সুবিশাল মহাশূন্য, ধরণীর নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, পশু পাখি, তরুলতা সবকিছুর মধ্যে প্রকম্প আরম্ভ হয়েছিল। সৃষ্টি জগৎ রুদ্ধশ্বাসে প্রত্যক্ষ করেছিল আত্মোৎসর্গের এ বিরল ঘটনাটি। ফেরেশতারা প্রার্থনা করেছিল, হে প্রভু! কেন আপনি এমন হুকুম প্রদান করলেন? মহাপ্রতাপশালী আল্লাহ উত্তরে বলেন, আমার কিছু সংখ্যক ফেরেশতারা উক্তি করেছিলো যে, হে প্রভু আপনি ইবরাহিম আ. কে কেন খলিলরূপে আখ্যায়িত করলেন? আমি বলেছিলাম! তিনি আমার প্রকৃত খলিল এবং আমার জন্য তার বন্ধুত্ব কতটুকু তা পরীক্ষা করে নিলাম। দৃঢ়চিত্তে ইবরাহিম আ. সন্তানের গলায় তো ছুরি চালালেন। আল্লাহ তাআলা ছুরিকে লক্ষ করে হুকুম করলেন? খবরদার ইসমাইলের একটি পশমও যেন না কাটে। আল্লাহর হুকুমে ছুরির কাজে পর্দা পড়ে গেল। এতে ইবরাাহিম আ. রাগান্বিত হয়ে ছুুরি দূরে নিক্ষেপ করলেন। ছুরি একটি পাথরে পড়ে পাথর দুই টুকরা হয়ে গেল। সুবহানাল্লাহ! অতপর মহান আল্লাহ জিবরাাঈল আ. কে হুকুম দিলেন, হে জিবরাাঈল! তুমি বেহেশত থেকে একটি দুম্বা নিয়ে যাও এবং আমার খলিলকে সালাম দিয়ে ইসমাঈলের পরিবর্তে এটাকে কুরবানি করতে বল। আমি তার কুরবানি কবুল করেছি। ইসমাঈলের গলা কাটা আমার উদ্দেশ্য নয়।বরং তাকে পরীক্ষা করা আমার উদ্দেশ্য ছিল। (তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন) এই ঐতিহাসিক ঘটনা আল্লাহর জন্য বান্দার ত্যাগের এক দৃষ্টান্ত হিসেবে সোনালি হরফে চিরকাল লিপিবদ্ধ থাকবে।

কুরবানির গুরুত্ব এবং তাৎপর্যঃকুরবানির দিনটি হল বছরের শ্রেষ্ঠ দিন। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে,

عن عبد الله بن قرط عن النبي- صلى الله عليه وسلم- قال : إن أعظم الأيام عند الله تبارك وتعالى : يوم النحر ثم يوم القر. رواه أبو داود ১৭৬৫ وصححه الألباني

আব্দুল্লাহ ইবনে কুর্ত রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূল হযরত মুহাম্মদ স. বলেছেন : আল্লাহর নিকট সকল দিবস সমূহের মাঝে শ্রেষ্ঠ দিন হলো কুরবানির দিন, তারপর পরবর্তী তিনদিন।কুরবানির দিনটি ঈদুল ফিতরের  চেয়েও অধিক মর্যাদাসম্পন্ন। কেননা এ দিনটি বছরের শ্রেষ্ঠতম দিন। এ দিনে সালাত ও কুরবানি একত্রে আদায় করা হয়। যা ঈদুল ফিতরের সালাত ও সদকাতুল ফিতর অপেক্ষা অধিকতর শ্রেষ্ঠ। আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলকে কাওসার দান করেছেন। এই দানের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তিনি তাঁকে এই দিনে কুরবানি ও সালাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন।

এ দিনটির আরও একটি নাম রয়েছে যা হলো ইয়াওমুল হজ্জিল আকবর বা শ্রেষ্ঠ হজের দিন। যে দিনে হাজীগণ তাদের পশু জবেহ করে হজকে পূর্ণ করেন। হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে যে,

عن ابن عمر- رضى الله عنهما- أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال يوم النحر : (أي يوم هذا) ؟ قالوا : يوم النحر، قال: هذا يوم الحج الأكبر .رواه أبو داود ১৯৪৫ وصححه الألباني

ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ স. কোরবানির দিন জিজ্ঞেস করলেন এটা কোন দিন? সাহাবাগণ উত্তর দিলেন এটা ইয়াওমুন্নাহার বা কোরবানির দিন। রাসূলে কারীম স. বললেন : এটা হল ইয়াওমুল হজ্জিল আকবর বা শ্রেষ্ঠ হজের দিন।

মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় পৃথিবীর শত সহস্র মুসলমান এই মহান দিনে কুরবানি আদায় করে থাকে।জবাইকৃত পশুর রক্ত,চামড়া,মাংস কিছুই পৌঁছায় না তাঁর দরবারে বরং আল্লাহ মানুষের তাকওয়া পরীক্ষা করেন এই কুরবানির মাধ্যমে। আল্লাহ তায়ালা বলেন :-

لَنْ يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِنْ يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنْكُمْ كَذَلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِينَ. (الحج : ৩৭)

‘আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না তাদের গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এজন্য যে, তিনি তোমাদের পথ-প্রদর্শন করেছেন ; সুতরাং আপনি সুসংবাদ দিন সৎকর্মপরায়ণদেরকে।’

কুরবানির মাধ্যমে মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের পাশাপাশি সামাজিক সম্প্রীতি গড়ে উঠে।কুরবানির গোশত সবার মধ্যে বিতরণের মাধ্যমে গড়ে উঠে এক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক।আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কুরবানির গোশত বিষয়ে বলেন :

﴿فَكُلُواْ مِنۡهَا وَأَطۡعِمُواْ ٱلۡبَآئِسَ ٱلۡفَقِيرَ ٢٨ [الحج: ٢٨]

‘অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং দুঃস্থ, অভাবগ্রস্তকে আহার করাও।’ [সূরা আল-হজ্জ: ২৮] অন্যদিকে কুরবানীর গোশত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«كُلُوا وَأَطْعِمُوا وَادَّخِرُوا»

“তোমরা নিজেরা খাও ও অন্যকে আহার করাও এবং সংরক্ষণ কর।”   [সহীহ আল-বুখারী : ৫৫৬৯] ইসলাম এভাবেই সকল বাধা বিপত্তিকে এড়িয়ে মিলিয়েছে প্রাণের বন্ধনে যেন সকলেই এক মায়ের সন্তান।সমগ্র সৃষ্টিজগতের শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান ইসলামের লক্ষ্য। কোরআন মজিদে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মুমিনগণ পরস্পর ভাই

ভাই; সুতরাং তোমরা ভ্রাতৃগণের মধ্যে শান্তি স্থাপন করো আর আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও।’ (সূরা-৪৯ হুজুরাত, আয়াত: ১০)।

উপসংহারঃকাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন,

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যগ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন

দূর্বল ভীরু চুপরহো ওহো খামখা ক্ষুব্ধ মন

ধ্বনী ওঠে রণি দুরবানীর

আজিকার এ খুন কুরবানির

দুম্বাশির-রুমবাসীর

শহীদের শির সেরা আজি’’   (কুরবানি)

কুরবানি মানে শুধুমাত্র পশু জবাই নয়,বরং নিজের আত্মার পরিশুদ্ধতা অর্জন।কুরবানির মাধ্যমে বান্দা তার মনের সব কালাকানুন ত্যাগ করে উদ্ভাসিত হবে ত্যাগের অপার মহিমায়।মহিমান্বিত এই দিনে সমগ্র পৃথিবীতে নেমে আসুক মহান রবের সুমহান রহমত।মুছে যাক সমস্ত গ্লানি।করোনাকালীন এই আঁধার পেরিয়ে নেমে আসুক রহমতের আলোকচ্ছটা।ভালো থাকুক ধরা,কুরবানির মাধ্যমে বিসর্জিত হোক মানবহৃদয়ের সব জরা

রচনা প্রতিযোগিতায় খ-গ্রুপে ১ম স্থান অধিকারী

নাহিদ হাসান সেতু

বরিশাল ক্যাডেট কলেজ।

একাদশ শ্রেণি।

নিজ জেলা: ঝিনাইদহ