বুক রিভিউ; যদ্যপি আমার গুরু

বুক রিভিউ; যদ্যপি আমার গুরু

রুদ্র ইকবাল, শিক্ষার্থী কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

ছফা পাঠ শুরু করলাম। একটু দেরি হয়ে গেলেও শুরু করলাম। ভাবলাম- পাঠ করার আগে যদি 'যদ্যপি আমার গুরু' দিয়ে শুরু করি তাহলে ছফা নিয়ে একটা ধারণা পাওয়া যাবে। গুরু-শিষ্য সম্পর্ক। মজার পাঠ। প্রথম একবার পড়লাম, আসলে পড়ার মাঝে তেমন একটা বুঝা যায় না। পরের বার পাঠ করলাম। পাঠ মানুষকে ভাবতে শেখায়, উপলব্ধি করতে শেখায়। এই বই পড়ার সময় বারবার উপলব্ধি হচ্ছিলো, ছফার পাশাপাশি আমিও বসে আছি স্যারের সামনে।

এবং চুপচাপ হয়ে শুনে যাচ্ছি- ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং বিভিন্ন ফিলোসোফিকাল বয়ান এবং বিভিন্ন সমাজের চিত্র ও শিক্ষা ব্যবস্থার অবস্থার পাশাপাশি বিভিন্ন বই এবং মতবাদ নিয়ে আলোচনা যা এই বইয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আলাপ সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আহমদ ছফা শুরুতেই রাজ্জাক স্যারের সাথে পরিচয় হওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা তুললেন।

মূলত, একটা রত্নের (রাজ্জাক স্যার) সাহচার্য পাওয়ার পূর্বে রত্নের খোজ কিভাবে পেলেন তার একটা বিষদ বর্ণনা দিলেন। ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো- রাজ্জাক স্যারের সাথে ছফার যেদিন প্রথম আলাপ হয় সেদিনের ব্যাপারটা গুরু-শিষ্য নিয়ে একটা দারুণ মেসেজ দেয়।

জ্ঞানী মানুষরা এক্সেপশনাল কিছু পছন্দ করেন বিষয়টা উঠে আসে এই ঘটনার মাধ্যমে। শিষ্টাচারের গন্ডি থেকে বাইরে। যেদিন প্রথম আলাপ হয়েছিল সেদিন প্রথমে রিজেক্টেড হওয়ার পর- ছফা রাজ্জাক স্যারের কাথাটা টান দিয়ে দু'চারটে কথা মুখের উপর বলে দিয়েছিলেন। তা হইলো- 'এত জ্ঞান নিয়ে কই রাখবেন?' স্যার তখনই ছফাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে চিনে নেয়। স্যারের সাথে পরিচয় থিসিসের কাজ নিয়ে।

রাজ্জাক স্যারকে এমন ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেন এক সাক্ষাৎ লাইব্রেরি, পুরো বই পড়ার পর আমার কাছে তার চেয়ে একটু বেশি মনে হয়। সবাই তার কাছে আসে জ্ঞানের পাশাপাশি, বিভিন্ন তদবির নিয়ে যেমন চাকরি, মেয়ের বিয়ে এরকম। রাজ্জাক স্যারের যে গুণটা আমায় অবাক করে সেটা তার সাদামাটা জীবন, নম্রতা এবং আঞ্চলিকতা (অবশ্য এখন স্মার্টনেসের পোষাক পরিয়ে আঞ্চলিকতাটা'রে খারাপ ভাবে নেওয়া অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে সবার)। এই বইয়ে স্যারের সাথে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা তাজ্জব করার মতো।

 ১. সলিমুল্লাহ ওনাকে গালিগালাজ করে বই লিখলেন। কিন্তু সলিমুল্লাহ সাহেবের বিপদের সময় যে মানুষটা এগিয়ে এসেছে ওনি- রাজ্জাক স্যার।

২. এস এম সুলতান, যাকে স্যার এবং স্যারের পরিবার ভালবাসত তিনি একসময় গিয়ে স্যারকে ভুল বুঝলেন। মানুষের কথায় তিনি বিশ্বাস করলেন যে- স্যার ওনার শিল্পকর্ম গুলো বিক্রি করে দিতে পারেন। অথচ সেই শিল্পকর্ম সোনারগাঁওয়ে নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করে স্যার বাসায় সাজিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

 ৩. একদিন স্যার ছফার বাসায় যায়। দরজায় স্যারের করাঘাতের পর ছফা ভেবেছিলেন নাস্তা দেওয়া ছেলেটা এসেছে হয়তো (ওই ছেলের নামও- আব্দুর রাজ্জাক)। পরে ছফা বলেছিল পরে আইসেন। স্যার কিছু ভাবেন নাই। এরপর ছফার অফিসে ও একই রকম ঘটনা ঘটে। এরকম বেশ কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে।

এসব ঘটনা থেকে উপলব্ধি করার বিষয় হলো- জ্ঞান মানুষকে অহংকারী করে না বরং বিনয়ী করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ নিয়ে এই বইয়ে দেওয়া ২টা মেসেজ'ই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমার মনে হয়- শেখ মুজিবুর রহমান এবং আলী জিন্নাহকে নিয়ে স্যারের বলা কথা গুলো আহমদ ছফার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় বিদায় ওনি বইয়ে নিয়ে এসেছেন।

ছফা ঢাবি'র তিনটা অবদান বর্ণনা করেছেন তার যদ্যপি আমার গুরু বইয়ে। যার মূল কথা হলো আন্দোলন ছাড়া শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে ব্যর্থ। মূলত, বিভিন্ন আন্দোলনকে ঘিরে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলো যেভাবে সংগঠিত হয় তা শিক্ষা-গবেষনা ক্ষেত্রে দেখা যায় না।

 ছফার মতে, আর্কিটেকচার দিক দিয়ে বিচার করলে ঢাবিরে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের সাথে তুলনা করতে পারবেন। আমার মতে- ছফার বর্ণিত অবদান গুলো বর্তমানে বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের হালচালের সাথে তুলনা করলে মন্দ হবে না।

আর্কিটেকচার এবং আন্দোলন ছাড়া আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলো এখনো এদেশরে কিছু দিতে পারে নাই তা আমি হলফ করে বলতে পারব। সবচেয়ে ভাল লাগার বিষয় হইলো- একাধারে নজরুল, জসিমউদদীন, প্রেমেন মিত্র, লেনিন, ট্রটস্কি, শেক্সপিয়ারকে, এ কে ফজলুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, আলী জিন্নাহ, এস এম সুলতান, রবীন্দ্রনাথ, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং আরো বিখ্যাত ব্যক্তির নিখুঁত ভাবে দারুণ আলাপ নিয়ে তুলে ধরেছেন। ছফা পাঠের আগে এই বই পাঠ করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

 

লেখক ঃ রুদ্র ইকবাল

শিক্ষার্থী কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।