ক্রোধ ও ইসলাম

ক্রোধ ও ইসলাম

ক্রোধ ও ইসলাম

রাগ মানবিক আবেগের একটি অংশমাত্র। কমবেশি রাগ সবারই আছে। কারো রাগ নিয়ন্ত্রিত আর কারো অনিয়ন্ত্রিত। মাত্রাতিরিক্ত ক্রোধ বরাবরই অকল্যাণ ডেকে আনে। যখন মানুষ খুব বেশি রেগে যায় তখন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা করার বুদ্ধি লোপ পায়। তখন মানবাত্মায় বিবেকবুদ্ধির ওপর ক্রোধ ও আবেগ রাজত্ব করে।

অনিয়ন্ত্রিত রাগ মানুষের নানা সমস্যা সৃষ্টি করে। যে ব্যক্তি রাগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে, সে অনেকখানি সফল। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে কারিমে ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে ছুটে যাও, যার সীমানা হচ্ছে আসমান ও জমিন, যা তৈরি করা হয়েছে পরহেজগারদের জন্য। যারা সচ্ছলতায় ও অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে আর মানুষকে ক্ষমা করে, বস্তুত আল্লাহ সৎকর্মশীলদিগকেই ভালোবাসেন’ (সূরা আলে ইমরান-১৩৪)।

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘অতএব তোমাদের যা দেয়া হয়েছে তা পার্থিব জীবনের ভোগমাত্র। আর আল্লাহর কাছে যা রয়েছে তা উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী, তাদের জন্য যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের পালনকর্তার ওপর ভরসা করে। যারা বড় গুনাহ ও অশ্লীল কাজ থেকে বেঁচে থাকে এবং ক্রোধান্বিত হয়েও ক্ষমা করে’ (সূরা আশ-শুয়ারা : ৩৬-৩৭)।

নবীজী সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের ক্রোধ চরিতার্থ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা সংবরণ করে, আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিন সমগ্র সৃষ্টির সামনে ডেকে আনবেন এবং জান্নাতের যেকোনো হুর নিজের ইচ্ছামতো বেছে নেয়ার অধিকার দান করবেন’ (ইবনে মাজাহ-৪১৮৬)। নবীজী সা: আরো বলেন, ‘আল্লাহ র সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য বান্দার ক্রোধ সংবরণে যে মহান প্রতিদান রয়েছে, তা অন্য কিছুতে নেই’ (ইবনে মাজাহ-৪১৮৯)।

এক সাহাবি নবীজীর কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাকে অল্প কথায় কিছু নসিহত করুন। নবীজী বললেন, ‘রাগ বর্জন করো’। সাহাবি কয়েকবার বললেন, আরো নসিহত করুন। প্রত্যেকবারই বললেন, ‘রাগ বর্জন করো’ (বোখারি)।নবীজী সা: একবার সাহাবিদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কাকে তোমরা অধিক শক্তিশালী মনে করো?’ তারা উত্তর দিলেন, ‘যে ব্যক্তি কুস্তিতে অন্যকে হারিয়ে দিতে পারে।’ নবীজী সা: বললেন, ‘সে প্রকৃত বীর নয় যে কাউকে কুস্তিতে হারিয়ে দেয়; বরং সে-ই প্রকৃত বীর যে ক্রোধের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়’ (বুখারি-৫৬৮৪)।

সামগ্রিক বিবেচনায় রাগ-ক্রোধ ভালো নয়। তবে যৌক্তিক কারণে রাগ করা খারাপও নয়। সাধারণত মানুষ কোনো কারণ ছাড়া এমনিতেই ক্রুদ্ধ হয় না। পেছনে কোনো না কোনো কারণ থাকেই। কিছু লোক, একজনের ক্ষোভ অন্যের ওপর প্রকাশ ঘটায়। এটা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। আবার অনেকে সরাসরি প্রতিক্রিয়া দেখায়। এই প্রতিক্রিয়া আক্রমণাত্মক না হয়ে যদি কৌশলগত হয় তাহলেই উত্তম। একদম কমসংখ্যক কিছু মানুষ আছে যারা হাজারো অন্যায় দেখার পরও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। এ ধরনের প্রতিক্রিয়াহীনতা শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য ভালো নয়। তবে যারা রাগকে কৌশলে সংবরণ করে সেই শক্তিকে ভালো কাজে লাগাতে পারে তারাই প্রকৃত সফলকাম।

একেবারে রাগহীন জীবনকে অনুৎসাহিত করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্ষোভ প্রকাশের কথাও বলেছে ইসলাম। তবে তা হবে ভারসাম্যপূর্ণ ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এবং অবশ্যই তা দ্বীনের খাতিরে। আল্লাহর জন্য। ব্যক্তিগত আক্রোশে নয়। নবীজী সা: বলেন, ‘ঈমান পূর্ণ করার চারটি আমল, যা কিছু মানুষকে দেবো আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য, যা কিছু নেবো আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য। যাকে ভালোবাসব আল্লাহ র জন্যই ভালোবাসব। যার প্রতি রাগ করব তাও আল্লাহ হকে খুশি করার জন্য’ (তিরমিজি)।

লোকমুখে হজরত আলী রা:-এর একটি ঘটনা শোনা যায়। সাহাবা সংক্রান্ত অনেক কিতাবেও ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়েছে, যদিও কিছু বিজ্ঞজন স্কলার এই ঘটনাকে ভিত্তিহীন বলেছেন। তা হলো এই ‘হজরত আলী রা: এক যুদ্ধে কাফের বাহিনীর সেনাপ্রধানকে সম্মুখযুদ্ধে ধরাশায়ী করলেন এবং যখন তাকে হত্যা করতে উদ্যত হলেন, তখন তিনি আলী রা:-এর মুখে থুথু নিক্ষেপ করলেন।

সাথে সাথে আলী রা: লোকটিকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে গেলেন। তখন ওই সেনাপ্রধান বললেন, ‘আপনি আমাকে হত্যা করতে পারতেন, কিন্তু তা করলেন না কেন?’ উত্তরে আলী রা: বললেন, ‘আপনার সাথে আমার কোনো ব্যক্তিগত বিরোধ নেই। আপনার সাথে আমি যুদ্ধ করেছি শুধু আপনার অবিশ্বাস ও আল্লাহর প্রতি বিদ্রোহের কারণে। আমার মুখে থুথু নিক্ষেপের পর আমি যদি আপনাকে হত্যা করতাম, তবে তা আমার ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও প্রতিশোধস্পৃহার বহিঃপ্রকাশ, যা আমি কখনোই চাই না’ ( সাহাবা চরিত)। তবে এই ঘটনাটি ক্রোধের যৌক্তিকতা ও অযৌক্তিকতার তরে বড় সুন্দর একটি উদাহরণ!

ক্রোধের যৌক্তিকতা ও অযৌক্তিকতার ব্যাপারে যেমন বলেছে ইসলাম, তেমনি যখন রাগ আমাদের গ্রাস করতে চায় কিংবা আমরা রাগান্বিত অবস্থায় থাকি, তখন রাগ সংবরণে আমাদের কী করা উচিত! নবীজী সা: বলেন, ‘যদি তোমাদের কেউ দাঁড়ানো অবস্থায় রাগান্বিত হয়ে পড়ে, তবে তার উচিত বসে পড়া। যদি তার রাগ কমে যায়, তবে ভালো; নয়তো তার উচিত শুয়ে পড়া’ (তিরমিজি)।
নবীজী সা: আরেকটি চমৎকার পদ্ধতি শিখিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘রাগ আসে শয়তানের পক্ষ থেকে; শয়তানকে তৈরি করা হয়েছে আগুন থেকে, আর একমাত্র পানির মাধ্যমেই আগুন নেভানো সম্ভব। তাই তোমাদের মধ্যে কেউ যখন রাগান্বিত হয়ে পড়ে, তার উচিত অজু করা’ (আবু দাউদ)।

এ ছাড়া নবীজী সা: আরো বলেন, ‘আমি এমন একটি কালেমা জানি, যা পাঠ করলে ক্রোধ দূর হয়ে যায়। আর তা হলো ‘আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইত্বানির রাজিম’ অর্থাৎ, আমি বিতাড়িত শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই’ (মুসলিম, অধ্যায়-৩২, হাদিস-৬৩১৭)।