সামাজিক মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের সাইবার লড়াই, উদ্বেগ কোথায়?

সামাজিক মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের সাইবার লড়াই, উদ্বেগ কোথায়?

সামাজিক মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের সাইবার লড়াই, উদ্বেগ কোথায়?

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো সাম্প্রতিক বছরে অনলাইন প্লাটফর্মে নানা ধরণের প্রচারণা নিয়ে বেশ সরব হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যামে পাল্টাপাল্টি অবস্থান, পরষ্পরবিরোধী প্রচারণা আরো জোরদার হবে।

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এরই মধ্যে দলীয়ভাবে ১ লক্ষ কর্মী প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের ভাষায় `গুজব ও অপপ্রচার' মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত করছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে যেকোনো রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা এবং বিতর্ক হয়। ফেইসবুক, ইউটিউবসহ অনলাইন বিভিন্ন মাধ্যমে পাল্টাপাল্টি প্রচার প্রচারণাতেও আধিপত্য বিস্তার এখন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে।

২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের ব্যানারে আন্দোলনের সময় থেকে অনলাইন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রচার প্রচারণা এবং তর্ক বিতর্ক বেশি দৃশ্যমান হয়। পরবর্তীকালে হেফাজতের কর্মসূচী, কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের অনলাইন ব্যাপক প্রচার প্রচারণা দেখা গেছে।

বিএনপি জামায়াতসহ সমমনা দল ও সংগঠনের মতাদর্শের পক্ষে ব্যাপক প্রচার অনলাইনে দেখা গেছে।

বিএনপির গবেষণা সেল বিএনআরসির এডিটোরিয়াল বোর্ড মেম্বার ফারজানা শারমিন পুতুল বলছেন, ‘সরকার যেভাবে সব কিছুতে ব্যারিয়ার দিয়ে রেখেছে সেখানে মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য দলের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা কাজ করছে ।’

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে রাজপথে শক্ত অবস্থানে থাকলেও অতীতে বেশ কিছু ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আধিপত্য দেখাতে পারেনি।

কোটা সংস্কার বা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের অনলাইন প্রচার প্রচারণায় সরকার-বিরোধীদের দাপট ছিল বলেই দলটিতে মূল্যায়ন রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে আন্দোলনের সময় গুজব ও অপপ্রচার হয়েছিল বলেও অভিযোগ রয়েছে। যে কারণে লক্ষ কর্মী নিয়ে দলের শক্তিশালী সাইবার টিম গঠনের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে।

আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক মো. আব্দুস সবুর বলছেন, ‘উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়ের মধ্যে একটা হলো তথ্য সন্ত্রাস অপপ্রচার। বিএনপি জামায়াত যখন রাজপথের আন্দোলনে পেরে উঠছে না তখন কিন্তু তারা এই তথ্য সন্ত্রাসের মাধ্যমে উন্নয়ন অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। তাই আমাদের নৈতিক দায়িত্ব হলো এই বিষয়গুলোকে অ্যাড্রেস করে উন্নয়ন, অগ্রগতি সমৃদ্ধিকে বাধাহীন করা।’

সবুর জানান, দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামী লীগের কর্মীদের এই প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা চলছে। বিরোধী দলের গুজব অপপ্রচার মোকাবেলা করার পাশাপাশি সরকারের উন্নয়ন ও দলীয় কর্মসূচী প্রচার করবে তারা।

এদিকে রাজনৈতিক দলের কর্মীদের এই সক্রিয়তা অনলাইনে সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য একধরনের হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। অভিযোগ হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা দলনিরপেক্ষ মতামত বা সমালোচনা প্রকাশ করে তাদেরকে দলীয় কর্মীরা নানাভাবে নাজেহাল করছে।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, ন্যূনতম সমালোচনা হলেও রাজনৈতিক কর্মীদের দলগত হামলার শিকার হচ্ছেন অনেকে। যেটি সাধারণ মানুষের মতপ্রকাশের জায়গা আরো কতটা সঙ্কুচিত করছে।

ফেসবুকে বেশ সক্রিয় একজন লেখক জান্নাতুন নাঈম প্রীতি বলেন, নানাভাবে তিনি হেনস্তার শিকার হয়েছেন। নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘ধরেন আমি একটা কিছু লিখলাম যে বাংলাদেশে এই আইনটা হলো এটা ঠিক হলো না। দেখা যায় সেখানে গিয়ে একজন দলীয় স্লোগান দিচ্ছে। কিংবা দলের অন্যান্য সবাইকে ট্যাগ করছেন বা ডেকে নিয়ে আসছেন যেন আমাকে সবাই মিলে বুলি করা হয়। আমি যেন মন্তব্য থেকে সরে আসি। ওখানে আবার হুমকিও দেয়া হয় যে আপনার নামে কিন্তু মামলা করা হবে।’

প্রীতির কথায় কোনো লেখা বা মন্তব্য যে দলেরই বিপক্ষে যায় সে দলের পক্ষেই তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। এক্ষেত্রে বিএনপি জামায়াত কিংবা আওয়ামী লীগ সব দলের সমর্থকদের ভূমিকা একইরকম।

‘আমি বলতে পারি না যে এইদল কিংবা ওই দল। আমি রিসেন্টলি যে লেখাগুলো লিখেছি সেগুলার জন্য মৌলবাদীদের পক্ষ থেকে আমি খুবই আশঙ্কজনকভাবে একজন লেখককে হার্ম করা বা মতপ্রকাশে যতভাবে বাধা দেয়া সম্ভব সেটার নজির আমি দেখেছি।’

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরকম অভিজ্ঞতা আরো অনেকেরই কারণ বাংলাদেশে সামাজিক মাধ্যমে দলীয় কর্মীদের নজরদারি অনেক বেড়েছে।

ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিটি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনেরই নামে অসংখ্য পেইজ, অ্যাকাউন্টের উপস্থিতি দেখা যায়। এর সদস্যরা নিজ দল বা মতের বিরুদ্ধে সমালোচনা হলেই সেই ব্যক্তির প্রোফাইল বা পেজে দলবেধে হামলা চালায়। ফেসবুকে মন্তব্য করে টার্গেট হয়েছেন এমন একজন ইমতিয়াজ মাহমুদ। সংঘবদ্ধ রিপোর্ট করায় তার ফেইসবুক সাময়িক বন্ধ হয়েছিল।

তিনি বলেন, ‘সংঘবদ্ধভাবে এরা টাকাপয়সা খরচ করে যদি পছন্দ না হয় তাহলে আপনার ফেইসবুক প্রোফাইলটার ওপর আক্রমণ করবে বা গ্রুপ বা পেজটার ওপর আক্রমণ করবে। এক লক্ষ লোক যদি রিপোর্ট করে বা দশ হাজার লোক যদি রিপোর্ট করে তাহলেতো ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে সিদ্ধান্ত নেবার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় সেটি রাখবে কি রাখবে না।’

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মন্তব্য সমালোচনার জন্য ব্যক্তির ওপর হামলার বিষয়টি অহরহ ঘটছে। এক্ষেত্রে অভিযোগ সব রাজনৈতিক দলের কর্মী সমর্থকদের বিরুদ্ধেই।

এ ব্যাপারে বিএনপির ফারজানা শারমিন পুতুল বলেন, ‘হ্যাঁ বিএনপি জামায়াতের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে যে তারা পেইজ ব্লক করে দিয়েছে সেটা ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে হতে পারে। কিন্তু তার মানে এটা না যে আমি নিজে থেকে একটা বাহিনী গঠন করবো এবং এটাকে বন্ধ করে দেব। এটাকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। যেটা আওয়ামী লীগ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু বিএনপি কিন্তু সেভাবে পরিকল্পনা করে কিছু করছে না। এটাতো তারা সত্যটাকে ঠেকানোর চেষ্টা করবে। একটা অনলাইন সন্ত্রাসী বাহিনী তারা গড়ে তুলছে বলেই মনে হচ্ছে।’

আওয়ামী লীগের অনলাইন কর্মী প্রশিক্ষণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন তাদের প্রশিক্ষণ কাজে লাগছে। হেফাজত নেতা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে প্রচার ও জনমত গঠনে কর্মীরা সফলতা দেখিয়েছে বলেই মনে করছেন তারা।

তবে গুজব ঠেকাতে সরকারি দলের এক লক্ষ অনলাইন এক্টিভিস্ট মাঠে নামানোর বিষয়টি অনেকের মধ্যে সন্দেহ এবং প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাবেরী গায়েন বলেন, ‘দলীয় কর্মীর কাছে তার দলের বিপক্ষে যায় এমন যেকোনে তথ্যকেই তারা মনে করতে পারেন অসত্য, বানোয়াট গুজব। এই ঝুঁকিটা আমরা নিতে পারি না। কোনোভাবেই যে রাজনৈতিক দলটি সরকার গঠন করেছে তার দলীয় কর্মীদের দিয়ে এ কাজ করা ঠিক নয়। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান এই ফেইক নিউজ কেউ ছড়ায় কিনা, কীভাবে সেটা প্রসমন করবে তার জন্য নীতি নির্ধারনের মাধ্যমে এই কাজটা করবে।’

তিনি বলেন কোনটা গুজব, কোনটা মিথ্যা তথ্য সেইটা নির্ধারণ করে দেবে কে, তার সংজ্ঞাটা কী? এই জায়গাতে এসে কিন্তু প্রচণ্ড একটা ঝামেলার মুখে পড়তে হবে।

‘অনেকটা যেমন পুলিশরা ঠিক করে দিচ্ছিলেন যে বই পড়ে তারাই ঠিক করে দেবেন সেখানে ধর্মবিদ্বেষী কোনো বক্তব্য বা বিদ্বেষমূলক কোনো বক্তব্য আছে কি না। এটা যেমন কাম্য না ঠিক একইভাবে এই জাতীয় ক্যাডার বাহিনী দিয়ে অন্যের বক্তব্য যাচাই করা এবং তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া এইটা কখনোই কাঙ্ক্ষিত না। এবং এটা একটা গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য প্রচণ্ড একটা হুমকি বলেই আমি মনে করি হবে। বাক স্বাধীনতার প্রতি হুমকি এবং মুক্তচিন্তার প্রতি হুমকি।’

সূত্র : বিবিসি