ধৈর্য : এক মহৎ গুণ

ধৈর্য : এক মহৎ গুণ

ধৈর্য : এক মহৎ গুণ

মানুষ কখনো একা বসবাস করতে পারে না। মানুষকে সমাজবদ্ধভাবে বাস করতে হয়। পরিবারিক ও সমাজিক জীবনে যে গুণটি সবচেয়ে বেশি জরুরি, তা হলো ধৈর্য। ধৈর্যহীনরা পরিবারে, সমাজে লজ্জিত হয়ে থাকে। কেউ সুঠাম দেহের অধিকারী হতে পারে, প্রচণ্ড শক্তি থাকতে পারে কিন্তু প্রকৃত শক্তিশালী ধৈর্যশীল ব্যক্তি।

আল্লাহ তায়ালাও কুরআনে ধৈর্যশীলদের প্রশংসা করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আর দেখো আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব (কখনো) ভয়-ভীতি দ্বারা, (কখনো) ক্ষুধা দ্বারা এবং (কখনো) জান-মাল ও ফসলহানী দ্বারা। যেসব লোক (এরূপ অবস্থায়) সবরের পরিচয় দেয়, তাদের সুসংবাদ শোনাও।’ (সূরা বাকারা-১৫৫) অর্থাৎ বান্দা যদি বিপদে ধৈর্য ধরে, তাহলে আল্লাহ বান্দার ওপর খুশি হন। খুশি হয়ে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। (আয়সারুত তাফাসির-১/৬৬) অথচ আমাদের ওপর কোনো বিপদ-আপদ এলে আমরা ধৈর্যহারা হই। যা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষেধ।

বিপদে পড়লে রাসূল সা: কী বলেছেন : রাসূলুল্লাহ সা: তাঁর প্রিয় ছেলে ইবরাহিমকে হারিয়ে বলেছেন, ‘চক্ষু তো অশ্রু বিসর্জন করে। অন্তর তো পেরেশান। তবে আমরা তো এমন কথা বলব, যে কথায় আমাদের রব খুশি হন। আর এমন কথা কখনোই বলব না, যে কথায় আমাদের রব অসন্তুষ্ট হন। হে ইবরাহিম! তোমার বিচ্ছেদে আমরা শোকাহত।’ (শুআবুল ঈমান বাইহাকি, হাদিস নং-১০১৬২)তাই আমাদেরকে রাসূল সা: থেকে শিক্ষা নিতে হবে। তবেই আমারা প্রকৃত মুমিন হতে পারব। আল্লাহ কুরআনে বলেন, ‘যারা সবর অবলম্বন করে তাদেরকে তাদের সাওয়াব দেয়া হবে অগণিত।’ (সূরা জুমার-১০)

উক্ত আয়াতে ‘সবিরুন’ শব্দ দ্বারা কাদের বোঝানো হয়েছে? এটা নিয়ে মুফাসসিরে কিরামদের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে। কেউ বলেন এই সবিরুন হলো ওই সব লোক, যারা অটুট ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সাথে ঈমানের ওপর ইসলামের ওপর অধিষ্ঠিত থাকে। সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের দ্বারা লাঞ্ছিত ও অত্যাচারিত হওয়া সত্ত্বেও ধর্মচ্যুত হয় না।

কেউ কেউ বলেছেন, ওই সব হিজরতকারী যারা আত্মীয় স্বজন বন্ধু-বান্ধব ও জন্মভূমির বিচ্ছেদে ধৈর্যধারণ করেছে। কেউ কেউ বলেছেন, সবিরুন দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, হজরত জাফর ইবনে আবু তালেবসহ তার সাথী-সঙ্গীরা। যারা হিজরত করে হাবশায় বর্তমানে ইথিওপিয়ায় গিয়েছিলেন।

তবে অনেকের দাবি এখানে সবিরুন দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ব্যাপক। অর্থাৎ যারা স্বভূমিতে প্রায় বন্দী অবস্থায় বহুবিধ অত্যাচারে জর্জরিত হয়েও স্বধর্মে অটল-অবিচল ছিলেন। তারাও সবিরুন দ্বারা উদ্দেশ্য। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় হজরত আলী রা: বলেন, সব আনুগত্যকারীকে ওজনে মেপে মেপে প্রতিদান দেয়া হবে। কেবল ধৈর্যশীলরা হবে এর ব্যতিক্রম। তাদেরকে ওপর তো প্রতিদান বর্ষিত হতে থাকবে বৃষ্টির মতো। (তাফসিরে বাগাবি-৭/১১১, তাফসিরে মাজহারি-৮/২০১)

হজরত আনাস রা: থেকে ইস্পাহানি বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, (হাশরের মাঠে) দাঁড়িপাল্লা বসানো হবে, নামাজিদেরকে ডাকা হবে এবং ওজন অনুসারে তাদেরকে প্রতিদান দেয়া হবে। এরপর ডাকা হবে আল্লাহর রাস্তায় দানকারীদেরকে। তাদেরকেও প্রতিদান দেয়া হবে ওজন অনুসারে। হাজীদেরও প্রতিদান দেয়া হবে এভাবেই।

পরে ডাকা হবে বিপদে ধৈর্যধারণকারীদেরকে। কিন্তু তাদের জন্য থাকবে না কোনো তুলাদণ্ড, পুণ্যকর্মের ফিরিশতি, অথবা আমলনামা। তাদের ওপর বর্ষিত হতে থাকবে অপরিমেয় প্রতিদান। তখন পৃথিবীতে যারা স্বাস্থ্যবান ছিল তারা কামনা করবে, হায়! দুনিয়াতে যদি আমাদের শরীর কাঁচি দিয়ে কাটতে থাকা হতো। (তাহলে আমরাও হতাম অপরিমেয় সৌভাগ্যের অধিকারী) (তাফসিরে বাগাবি-৭/১১১, কাশশাফ-৬/৫০, তাফসিরে মাজহারি-৮/২০১)

একটি হাদিস, হজরত জাবের রা: থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘দুঃখ-দৈন্য ভোগকারীদেরকে যখন পুরস্কৃত করা হবে, তখন পৃথিবীর জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ভোগকারীরা মনে মনে এই ভেবে আফসোস করতে থাকবে যে, পৃথিবীতে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বদলে যদি আমাদের গায়ের চামড়া কাঁচি দিয়ে কর্তন করা হতো (তাহলে আমরাও আজ পুরস্কৃত হতাম)।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস নং-২৪০২, তাফসিরে মাজহারি-৮/২০১)

একটি হাদিস, হজরত আবু মালেক আল আশআরি রা: রাসূলুল্লাহ সা: থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘... নামাজ হলো নূর বা আলো, সদকা হলো বুরহান বা দলিল আর সবর হলো দিয়া বা উজ্জ্বল।’ (শুআবুল ঈমান বাইহাকি-২৭০৯) এই হাদিসে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ সা: নামাজকে বলেছেন নূর আর সবর তথা ধৈর্যকে বলেছেন দিয়া। আল্লাহ কুরআনে বলেন, ‘তিনিই সূর্যকে দিয়া তথা উজ্জ্বল করেছেন আর চাঁদকে করেছেন নূরানী তথা আলোকিত।’ (সূরা ইউনুস)

একটি প্রশ্ন, সূর্য আর চাঁদের মাঝে কার বেশি আলো? কে বেশি উজ্জ্বল? কে বেশি শক্তিশালী? অবশ্যই সূর্যই চাঁদ থেকে বেশি শক্তিশালী। দ্বীনের প্রতিটি আদেশ-নিষেধের সাথে জড়িয়ে আছে সবর তথা ধৈর্য। ধৈর্যের ওপরই নির্ভরশীল ইসলামের আদেশ-নিষেধ। ইসলামের প্রতিটি আদেশ পালনের আগে ধৈর্য থাকা খুবই জরুরি। আর নিষেধের বেলায় একই কথা। শরিয়তের প্রতিটি নিষেধ মেনে চলতে হলে থাকা চাই সবর তথা ধৈর্য। ধৈর্য না থাকলে শরিয়তের আদেশ-নিষেধ মেনে চলাও সম্ভব হবে না।

যেমন খুব শীতের সময় ফজরের নামাজ পড়তে হলে গরম লেপ-কম্বল থেকে বের হতে হবে। হাড় কাঁপানো শীতে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে অজু করতে হবে। এরপর কুয়াশা ভেদ করে আসতে হবে মসজিদে। এতগুলো কাজের সাথে জড়িয়ে আছে সবর তথা ধৈর্য। যদি কোনো ব্যক্তি সবর না থাকে তাহলে তার পক্ষে এই কনকনে শীতের সময় মসজিদে আসা সম্ভব নয়। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেন, ‘তোমরা সাহায্য প্রার্থনা করো ধৈর্যের মাধ্যমে এবং নামাজের মাধ্যমে।’ (সূরা বাকারা-৪৫)

এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালাবান্দাদেরকে আশান্বিত করে বলেন, ‘তোমরা দুনিয়ার কল্যাণ চাও, পরকালে মুক্তি চাও, তাহলে তোমাদেরকে দু’টি কাজ করতে হবে ১. তোমাদেরকে ধৈর্য ধরতে হবে ও ২. তোমাদেরকে নামাজ পড়তে হবে। তবেই তোমরা দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের ভাগিদার হবে।’

এখানে ধৈর্য ধরার অর্থ হলো, সবরের সাথে শরিয়াতের ফরজ বিধানাবলি মেনে চলতে হবে। কেউ কেউ বলেন, এখানে সবরের অর্থ হলো রোজা। কেননা, রামজানকে বলা হয়েছে সবরের মাস। কেউ কেউ বলেন, এখানে সবর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা।তাই ধৈর্যের কোনো বিকল্প নেই। তাই ধৈর্য ধরতে হবে। সবর করতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে ধৈর্য ধরার তাওফিক দান করুন। আমিন।

মুফতি মুহাম্মাদুল্লাহ : শিক্ষক, মাদরাসা উলুমে শরিয়াহ