অসুস্থ পাবনা মানসিক হাসপাতালটির আগে দরকার সুস্থ্যতা

অসুস্থ পাবনা মানসিক হাসপাতালটির আগে দরকার সুস্থ্যতা

অসুস্থ পাবনা মানসিক হাসপাতালটির আগে দরকার সুস্থ্যতা

মানসিক রোগ চিকিৎসার জন্য দেশের একমাত্র বিশেষায়িত পাবনা মানসিক হাসপাতাল( মেন্টাল হসপিটাল) মানসিক  রোগীদেও শেষ ভরসাস্থল হলেও নানা সংকটে ধুঁকছে হাসপাতালটি। চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারি সংকটে কাঙ্খিত চিকিৎসা সেবা থেকে বি ত হচ্ছেন মানসিক রোগীরা।

হাসপাতালটিতে চিকিৎসক আছেন নির্ধারিত চিকিৎসকের তিন ভাগের এক ভাগ। মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্র হলেও সংকট আছে মনো চিকিৎসকের। নেই পর্যাপ্ত অকুপেশনাল থেরাপিষ্ট, প্রশিক্ষিত নার্স। কর্মকর্তা-কর্মচারিদের আবাসন সংকটতো আছেই।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নানা চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে কালের স্বাক্ষী হয়ে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাওয়া এই বিশেষায়িত হাসপাতালটিতে এখনও লাগেনি আধুনিকতার ছোঁয়া। রোগি ও রোগির স্বজনেরা নানা সমস্যায় পড়লেও তার সমাধান নেই।

পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. শাফকাত ওয়াহিদ জানালেন, চিকিৎসকের ৩১ পদ থাকলেও বাস্তবে চিকিৎসক আছেন মাত্র ১১ জন। অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনেকগুলো পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য।

হাসপাতালের আবাসিক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মোঃ মাসুদ রানা সরকার বলেন, পর্যাপ্ত মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রয়োজন। অথচ মাত্র ৩ জন সাইকিয়াট্রিস্ট দিয়ে এই হাসপাতালের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।’তিনি আরও বলেন, দেশে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ মানসিক স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী সংকটের প্রভাব হাসপাতালটিতে আছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমনিতেই বাংলাদেশে মানসিক রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকট আছে। যারা আছেন সুযোগ-সুবিধা বেশি থাকার কারনে তারা সরকারি হাসপাতালের পরিবর্তে বেসরকারি হাসপাতালের দিকে ঝুঁকছেন।

বিশেষায়িত মানসিক রোগ নিরাময় কেন্দ্র পাবনা মানসিক হাসপাতাল শহর থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার দূূরে পাবনা সদর উপজেলার হেমায়েতপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। ১৯৫৭ সালে পাবনা শহরের শীতলাই জমিদার বাড়িতে তৎকালীন পাবনা জেলার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ হোসেন গাংগুলী এই হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার বছরেই হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে এ হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ৫০০।

পাবনা মানসিক হাসপাতালের ২০২১ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ওই বছর হাসপাতালটিতে রোগি ভর্তি হয়েছিলেন ১ হাজার ৫শ’৩১ জন। বহি: বিভাগে চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন ৬০ হাজার ৪৪৫ জন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, বহি: বিভাগে গড়ে প্রতিদিন ৩৫০ থেকে ৪০০ রোগী চিকিৎসাসেবা নেন। এর মধ্যে আসন খালি থাকা সাপেক্ষে গুরুতর রোগিদের ভর্তি করা হয় হাসপাতালে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে এই হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে ৫০০ আসনের বিপরীতে ৩৭৫ জন এর মধ্যে  কেবিনে ৩৯ জন ও সাধারনে বেডে ৩৩৬ জন।

প্রায় ২৫ বছর হাসপাতালে ভর্তি আছেন ঢাকার মগবাজার এলাকার সাইদ হোসেন। তিনি বলেন,‘আমি এখন সুস্থ্য, কিন্তু কেউ আমাকে নিয়ে যায় না।’ কথাগুলো বলার সময় চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল ঠিকানা জটিলতায় বাড়ি  যেতে না পারা সাইদের।সাইদের মতো ঠিকানা জটিলতায় সুস্থ্য হয়েও বাড়িতে যেতে পারছেন না ৯ রোগী। বাড়ির ফেরার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে সেখানেই মারা গেছেন তিন রোগী ।

হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শফিউল আযম বলেন, চিকিৎসক সংকট থাকায় আমাকে একাই প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০ জন রোগী দেখতে হয়। ফলে সময় নিয়ে রোগীর দেখার সুযোগ কম থাকায় রোগীদের কাঙ্খিত সেবা দিতে পারছি না ।

হাসপাতালের অকুপেশনাল থেরাপি (বৃত্তি) বিভাগের অকুপেশনাল থেরাপিষ্ট অলক কুমার দাস বলেন, এই বিভাগে  রোগীদেও খেলাধুলা, বিনোদন, গ্রুপ থেরাপি ও বিভিন্ন হস্ত শিল্প প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। রয়েছে বিনোদন ও ইনডোর  খেলাধুলার ব্যবস্থা । কিন্তু লোকবল সংকট ও পর্যাপ্ত সরঞ্জামের অভাবে তা ব্যহত হচ্ছে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পাবনা গণপূর্ত বিভাগ পাবনা মানসিক হাসপাতালের আবাসিক ভবন ও কটেজ বসবাসের অনুপযোগি হিসেবে পরিত্যাক্ত ঘোষণা করে। তারপর থেকে আবাসন সংকটে ভুগছেন চিকিৎসকসহ অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী। অনেকে আবার ঝুঁকি নিয়েই বসবাস করছেন পরিত্যক্ত ভবনে।

এছাড়া হাসপাতালে ভর্তি হতে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা রোগীর স্বজনদের জন্য যে দশটি কটেজ ছিল তার মধ্যে ৫ টি একাবারে ফাঁকা পড়ে আছে। বাকি ৫টির মধ্যে একটিতে হাসপাতালের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আনসার সদস্যরা থাকছেন। কর্তৃপক্ষের অনুমতিসাপেক্ষে অন্য চারটিতে বসবাস করেন আউটসোর্সিংয়ে কর্মরত কর্মচারীসহ অন্যরা। ফলে রোগীর পরিবারের লোকজনকে আবাসন সংকটের কারনে বেশি অর্থ ব্যয়ে পাবনা শহরের আবাসিক হোটেলে থাকতে হচ্ছে ।

সিনিয়র স্টাফ নার্স শারমিন ইয়াসমিন বলেন, সরকারি বাসভবন পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। এগুলো সংস্কার করে দ্রুত বসবাসের উপযোগী করা প্রয়োজন, যাতে আমরা নিরাপদে এখানে থাকতে পারি।

পুরুষ ওয়ার্ডের নার্সিং সুপারভাইজার আব্দুল কাদের বলেন, পুরুষ ওয়ার্ডে পুরুষ নার্সেও বেশ সংকট। পুরুষ  রোগীদের সব কাজ নারী নার্স দিয়ে করানো সম্ভব নয়। পুরুষ রোগীগুলো কিছুটা উত্তেজিত ও আক্রমনাত্মক হওয়ায় নারী নার্সরাও তাদের সেবায় এগিয়ে যেতে সাহস পান না। এ জন্য পুরুষ নার্স বিশেষ প্রয়োজন।তিনি আরও বলেন, আমরা মানসিক রোগীদেও সেবা দিতে গিয়ে অনেক সময় বড় ধরণের ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাই। এ জন্য আমাদের ঝুঁকি ভাতার প্রয়োজন।

নারী ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রোগি রোখসানা খাতুন (৩৭) বলেন, এখানকার খাবার খাওয়া খুবই কষ্ট। সহজে পেটের  ভেতওে যেতে চায় না। তারপর সময়মত খাবারও আসে না।ঢাকার মগবাজার এলাকা থেকে ভর্তি হওয়া শামীম (২৬) বলেন, মাছ ও মাংস সব ৫০ গ্রামের খুব ছোট এক পিস, মন ভওে খেতে পারি না, কি করব বলেন।

পুরুষ ওয়ার্ডেও রোগী মাসুদ সরদার (৩২) বলেন, ডাল আর পানি সমান। কি খাচ্ছি বুঝা যায় না। কোনো রকমে গিলে খাই। কি করব, যা দেয় তাই খেতে হয় ।আরেক রোগী এমরান (১৯) বলেন, এখানকার খাবারের স¦াদ আছে কিন্তু পরিমানে খুব কম, তরকারি আরো বেশি দিলে ভাল হয়।হাসপাতালের বাবুর্চি মোঃ মোকারম হোসেন জানালেন, রোগীদের চার বেলার খাবারের জন্য বরাদ্দ মাত্র ১২৫ টাকা। এত কম টাকায় যা দিচ্ছি তা দিতেও কষ্ট হয়।

হাসপাতালের ষ্টুয়াড (খাবার রক্ষণাবেক্ষণ কাজে নিয়োজিত) মোঃ আতোয়ার রহমান বলেন, সকালের নাস্তায় সপ্তাহে তিনদিন খিচুরী, বাকি চারদিন সুজি-রুটি। আর বিকেলের নাস্তায় বিস্কুট। ৫০ গ্রাম করে দুপুরে ও রাতের খাবারে মাছ, ব্রয়লার মুরগীর মাংস সাথে কখনও ডিম, সবজি ও ডাল।

হাসপাতালের সাইকিয়াট্রিক সোসাল ওয়ার্কার পথ্য বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বোরহান উদ্দিন হায়দার বলেন, এখানে রোগীদের বাইরের খাবার খাওয়ার সুযোগ নেই, চার বেলায় ১২৫ টাকায় মানসম্মত খাবার দেয়া সম্ভব নয়, তবে চলতি ডিসেম্বর থেকে চার বেলায় খাবার ১৭৫ টাকায় করা হচ্ছে, বর্তমান বাজার মূল্যে সে টাকাতেও মানসম্মত ভালো খাবার দেয়া সম্ভব না।

হাসপাতালটিতে আগের তুলনায় সেবাপ্রার্থীর সংখ্যা বাড়ছে বলে জানালেন আবাসিক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মাসুদ রানা সরকার। সে কারণে এর সেবামানের দিকে নজর দেয়া জরুরি মনে করছেন তিনি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতি দ্রুত শূন্য পদে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্সসহ কর্মকর্তা কর্মচারি নিয়োগ না দিলে কাঙ্খিত  সেবা দেয়া সম্ভব নয়। আধুনিক চিকিৎসা সেবা দেয়ার লক্ষে এর আধুনিকায়নের বিষয়টিতেও গুরুত্ব দিতে হবে। সিটি স্ক্যান, এমআরআই, ইইজিসহ মানসিক স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট আধুনিক রোগ নির্ণয় যন্ত্রপাতি প্রয়োজন।

পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালক বলেন, এই হাসপাতালের নিজেরই আগে চিকিৎসা দরকার। কারন এখানে গুরুত্বপূর্ণ পদ ফাঁকা রেখে ভাল সেবা দেয়া সম্ভব না। তাই হাসপাতালটি বাঁচাতে হলে আগে চিকিৎসক নার্স ও অন্যান্য শূন্য পদে দ্রুত নিয়োগ দিতে হবে। এ ছাড়া হাসপাতালটিকে আরো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে আরও আধুনিক করে গড়ে তুলতে হবে ।