বড় ভূমিকম্প মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি কতটা?

বড় ভূমিকম্প মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি কতটা?

বড় ভূমিকম্প মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি কতটা?

যেকোন সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও বাংলাদেশ ভূমিকম্প মোকাবেলায় তেমন কোন প্রস্তুতি নেই বললেই চলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তুরস্কের মতো বড় ভূমিকম্প বাংলাদেশে হলে উদ্ধার কাজ পরিচালনা করাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

তারা বলছেন, রাজধানী ঢাকার মতো বড় শহরগুলোতে যে পরিমাণ বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে তাতে ভূমিকম্পে এসব ভবন ধসে পড়লে শহরগুলো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। যার কারণে ব্যাহত হবে উদ্ধার কাজ।সরকার বলছে, ভূমিকম্প মোকাবেলার জন্য চীনের সহায়তায় ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেয়া হলেও তার কাজ চলছে ধীর গতিতে।

এই সেন্টারের মাধ্যমে সরকারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বেসরকারি সংস্থার সমন্বয়ে দুর্যোগের আগে ও পরে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়। এছাড়াও অন্য কোন দেশ থেকে উদ্ধার সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রেও দরকার হয় এই ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তুরস্কসহ অন্যান্য দেশের ভূমিকম্পের পর তাদের থেকে শিক্ষা নিয়ে অবিলম্বে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেয়া উচিত বাংলাদেশের। কারণ ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ।ভূতত্ত্ববিদদের মতে, সাধারণত প্রতি একশ বছর পর পর বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে।বাংলাদেশে সবশেষ ১৮২২ এবং ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। সে হিসেবে আরেকটি বড় ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ।

ভূতত্ত্ববিদরা বলছেন, ভূমিকম্পের জন্য দায়ী বেশ কয়েকটি প্লেট ও সাব-প্লেটের উপর বাংলাদেশের অবস্থান হওয়ার কারণে যেকোন মুহূর্তে বাংলাদেশে ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে।ভূতত্ত্ববিদরা হুঁশিয়ার করেছেন যে, এসব ভূমিকম্প সাত বা আট মাত্রা বা তারও বেশি হবে।

সরকারের প্রস্তুতি কেমন?

বাংলাদেশে তুরস্কের মতো বড় মাপের ভূমিকম্প হলে পরিস্থিতি যে ভয়াবহ হবে তা নিয়ে কোন সন্দেহই নাই।২০০৯ সালে সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) ও জাইকার যৌথ জরিপে বলা হয়, ঢাকায় সাত বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হলে, শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে এবং এক লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তৈরি হবে সাত কোটি টন কনক্রিটের স্তূপ।

ভূমিকম্প মোকাবেলায় তেমন কোন প্রস্তুতি না থাকার অভিযোগ উঠলেও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান বলেন, উদ্ধার কাজের জন্য সিটি কর্পোরেশনগুলোকে আলাদা আলাদা অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। এসব অঞ্চলে ৩৬ হাজার প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তাদের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়েছে। দায়িত্ব রয়েছে সামরিক বাহিনীগুলোরও।

এছাড়া উদ্ধার কাজের সহায়তার জন্য ২০১৯ সালে ২২০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে আরো যন্ত্রপাতি বাংলাদেশ হাতে পাবে। অনুসন্ধান ও উদ্ধার কাজ এবং দুর্যোগ মোকাবেলা কার্যক্রম শক্তিশালী করতে ২৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।কিন্তু ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলি আহমদ খান বলেন, ভূমিকম্প মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি খুবই অপ্রতুল।

তিনি বলেন, ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় করে কাজ করতে হয় যার জন্য ন্যাশনাল অপারেশন সেন্টার দরকার। বাংলাদেশে এখনো এ ধরনের কোন সংস্থা নেই।এছাড়া বড় দুর্যোগ হলে আন্তর্জাতিক সাহায্য সহযোগিতা আসতে হলে স্থানীয় ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট কমিটি দরকার যা এখনো গঠিত হয়নি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান বলেন, ন্যাশনাল অপারেশন সেন্টার নির্মাণের জন্য চীনের সাথে ২০১৬ সালে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সেই চুক্তি অনুযায়ী, চীনের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় এটি নির্মাণের কথা রয়েছে। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে একটি জায়গা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বর্তমানে এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে।

তবে এই কাজের গতি ধীর উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এই সেন্টারটি নির্মাণ নিয়ে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ যেমন ধীরগতির, তেমনি চীনের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও ধীরগতির।“তাদেরকে বারবার পত্র দেয়ার পর তারা রেসপন্স করে একটু একটু করে।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ঘন জনবসতি এবং হাজার হাজার বহুতল ভবন যেগুলো কোন ধরনের বিল্ডিং কোড না মেনেই নির্মাণ করা হয়েছে।ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলি আহমদ খান বলেন, ভূমিকম্প হলে মেগা স্ট্রাকচারগুলো ধসে গিয়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে উদ্ধার কাজ চালানো অসমম্ভব হবে। হবে ব্যাপক প্রাণহানি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারীও বলছেন, তুরস্কের ভূমিকম্পের চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সেখানে বেশিরভাগ প্রাণহানিই হয়েছে ভবন ধসের কারণে। এমনিতেও ভূমিকম্পের ৯০ ভাগ প্রাণহানি ভবন ধসের কারণেই হয়।ঢাকা শহরে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড মানা হচ্ছে কি না তা নজরদারির দায়িত্ব রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা রাজউকের।

অভিযোগ রয়েছে যে, বেশিরভাগ সময়েই রাজউক এই দায়িত্ব পালন করে না।রাজউকের নগরপরিকল্পনাবিদ মাহফুজা আক্তার বলেন, ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদন হয় মূলত রাজউক থেকে। এর পর সেই নকশা মেনে ভবনটি নির্মাণ করা হচ্ছে কি না বা বিল্ডিং কোড মানা হচ্ছে কি না তা তেমন নজরদারি করা হয় না।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় রাজউকের একটি প্রকল্প রয়েছে যার নাম আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্প। তবে মিজ আক্তার জানান, এই প্রকল্পটি শুধু শহরের ক্রিটিক্যাল ফ্যাসিলিটি বা জনগুরুত্বপূর্ণ ভবনের ভূমিকম্প সহনশীলতা নিয়েই কাজ করে থাকে। যেমন হাসপাতাল, স্কুল ইত্যাদি।“ওভারঅল সব বিল্ডিংয়ের উপর কাজ হয় না,” বলেন তিনি।

কোন ভবনের ভূমিকম্প সহনশীলতা নজরদারি করা কেন সম্ভব হয় না এ বিষয়ে মিজ আক্তার বলেন, ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদনের সময় যেহেতু অবকাঠামো প্রকৌশলী (স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার) হিসেবে একজনের স্বাক্ষর থাকে, তাই ধরেই নেয়া হয় যে তার তত্বাবধানে সব কিছু হচ্ছে।

তবে এ বিষয়ে সীমাবদ্ধতা রয়েছে উল্লেখ করে রাজউকের নগরপরিকল্পনাবিদ বলেন, একটি ভবন তৈরি হওয়ার পর এর ব্যবহার শুরুর আগে একটি অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নিতে হয়, যেখানে ভবনটি নির্মাণে সব ধরনের নিয়ম মানা হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা হয়।তবে এই সার্টিফিকেট নেয়ার হার খুব কম।

তিনি বলেন ঢাকার উত্তরা, গুলশান আর বনানী ছাড়া অন্য কোন এলাকায় এ ধরনের সার্টিফিকেট কেউ নেন না। এসব এলাকার বাসিন্দাদের বাধ্য হয়েই এই সার্টিফিকেট নিতে হয় কারণ এসব এলাকায় কোন ভবন বা ফ্ল্যাট হস্তান্তর করতে হলে অকুপেন্সি সার্টিফিকেট দরকার হয়।এছাড়াও যেসব ভবন নির্মাণ হয়ে গেছে সেগুলোর ভূমিকম্প সহনশীলতা পরিমাপের কোন উপায় নেই বলে জানান মিজ আক্তার।

বুয়েটের শিক্ষক মেহেদি আহমেদ আনসারী বলেন, বাংলাদেশে ভূমিকম্পের সহনশীলতা নজরদারি বিষয়ক যেসব সংশ্লিষ্ট সংস্থা রয়েছে সেগুলোর সক্ষমতা কম। সেক্ষেত্রে আউটসোর্স করে বা দেশের প্রচলিত ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মগুলোকে দিয়ে ভবনগুলোর সহনশীলতা পরীক্ষা করিয়ে সার্টিফিকেট দেয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।তবে এ বিষয়ে রাজউক আগ্রহী নয় উল্লেখ করে মি. আনসারী বলেন, রাজউক আসলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব ভবন এরইমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে, রেট্রো-ফিটিং বা সংস্কার করে সেগুলো ভূমিকম্প সহনশীল করে তোলা সম্ভব যা কিছুটা ব্যয় সাপেক্ষ।মি. আনসারী বলেন, রানা প্লাজা ধসের পর গার্মেন্ট শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক ভবনে এ ধরনের সংস্কার করে সেগুলোকে আবার ব্যবহারের উপযোগী করা হয়েছে।

সূত্র : বিবিসি