ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেকার সিন্ধু জল চুক্তি কি আদৌ টিঁকবে?

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেকার সিন্ধু জল চুক্তি কি আদৌ টিঁকবে?

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেকার সিন্ধু জল চুক্তি কি আদৌ টিঁকবে?

সিন্ধু অববাহিকাকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে পুরনো ও সবচেয়ে বেশি দিন ধরে চালু থাকা আন্তর্জাতিক জল ভাগাভাগির চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, কারণ ভারত ওই চুক্তির শর্তে বড়সড় পরিবর্তন দাবি করছে।

‘ইন্ডাস ওয়াটার ট্রিটি’ (সিন্ধু জল চুক্তি) নামে পরিচিত এই সমঝোতাটি ১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। দুই দেশের মধ্যে আলোচনায় মধ্যস্থতা করেছিল বিশ্ব ব্যাঙ্ক, তারাও ছিল চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী আর একটি পক্ষ।

এই চুক্তির প্রধান লক্ষ্য ছিল সিন্ধু অববাহিকার নদীগুলোর জল দুই দেশের মধ্যে ন্যায্যতার সঙ্গে ভাগাভাগি করা।দ্বিপাক্ষিক স্তরে যে ‘পার্মানেন্ট ইন্ডাস কমিশন’ আছে, সেখানে ২৫শে জানুয়ারি ভারত তার কমিশনারের মাধ্যমে চিঠি পাঠিয়ে জানায়, চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন নিয়ে যে অভিযোগ উঠেছে তারা চায় আগামী ৯০ দিনের মধ্যে সেটা নিয়ে আগে দুই দেশের সরকার নিজেদের মধ্যে আলোচনা করুক।

ভারতের বক্তব্য ছিল, চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে কোনও বিতর্ক দেখা দিলে ‘ধারাবাহিক আলোচনা’ বা গ্রেডেড অ্যাপ্রোচের মাধ্যমে তার নিষ্পত্তি করতে হবে।অন্য দিকে এক্ষেত্রে পাকিস্তানের পছন্দ হল সালিশি বা আরবিট্রেশন আদালতের পথ এবং তার আগে বিষয়টিতে তৃতীয় কোনও দেশের নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞকে যুক্ত করা।

এর দুদিন পরেই (২৭শে জানুয়ারি) দ্য হেগের পার্মানেন্ট কোর্ট অব আরবিট্রেশনে বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তান যে মামলা করেছে তার শুনানি নির্ধারিত ছিল। কিন্তু ভারত সেই শুনানি বয়কট করে।পাকিস্তানের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসও একটি বিবৃতি দিয়ে বলেছে, ভারত একতরফাভাবে সিন্ধু জল চুক্তিকে পাল্টে দিতে চাইছে যা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়।

ইতিমধ্যে গত সপ্তাহে এই বিতর্কে বিশ্ব ব্যাঙ্কের ভূমিকাকে কটাক্ষ করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মন্তব্য করেছে, “আমাদের হয়ে এই চুক্তি ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব কেউ বিশ্ব ব্যাঙ্ককে দেয়নি।”সব মিলিয়ে চুক্তির ব্যাখ্যা নিয়ে দুই দেশের মতবিরোধ এতটাই জটিল আকার নিয়েছে যে পর্যবেক্ষকরা অনেকেই চুক্তিটির ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন।

মূল বিরোধ যা নিয়ে

সিন্ধু জল চুক্তি অনুসারে এই অববাহিকার পূর্ব দিকের তিনটি নদী – বিয়াস, রাভি ও শতদ্রুর জল ভারতকে বরাদ্দ করা হয়েছে এবং পশ্চিমের তিনটি নদী – চন্দ্রভাগা, সিন্ধু ও ঝিলমের ভাগ পেয়েছে পাকিস্তান।

তবে চুক্তিতে দুই দেশকেই অন্যের ভাগের নদীগুলোকে বিশেষ কয়েকটি উদ্দেশ্যে ব্যবহারেরও অনুমতি দেওয়া হয়েছে।যেমন, ছোট মাপের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, যাতে জল আটকে রাখার প্রয়োজন হয়ই না বা খুব কম হয়, সেগুলো বানাতে কোনও অসুবিধা নেই।

এই সব শর্ত নিয়েই চুক্তিটি গত ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে মোটামুটি মসৃণভাবেই বাস্তবায়িত হয়ে এসেছে, তবে ভারত শাসিত জম্মু ও কাশ্মীরের কিষেণগঙ্গা ও রাতলে নামে দুটি প্রকল্প নিয়ে সাম্প্রতিককালে তীব্র বিতর্ক দেখা দিয়েছে।এর মধ্যে বান্দিপোরা জেলায় কিষেণগঙ্গা নদীর (যা ঝিলমের একটি শাখানদী) ওপর নির্মিত কিষেণগঙ্গা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি ভারত সরকার ২০১৮ সালে উদ্বোধন করেছে।

আর কিশওয়ার জেলায় চন্দ্রভাগার ওপর রাতলে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটির কাজ এখনও শেষ হয়নি, সেখানে নির্মাণকাজ চলছে।পাকিস্তান মনে করে, এই দুটি প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভারত যেভাবে ড্যাম বা জলাধারের নকশা প্রস্তুত করেছে তাতে নদীগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে।

আর যেহেতু এই সব নদী থেকেই পাকিস্তানের কৃষিক্ষেত্রে শতকরা ৮০ ভাগ সেচের জল সরবরাহ করা হয়, তাই কিষেণগঙ্গা ও রাতলের মতো প্রকল্প নির্মাণের মাধ্যমে ভারত সিন্ধু চুক্তিকেই লঙ্ঘন করছে বলে পাকিস্তানের অভিযোগ।এই বিতর্কের মীমাংসা করতেই পাকিস্তান প্রথমে বিশ্ব ব্যাঙ্ককে একজন ‘নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ’ নিয়োগ করার দাবি জানায়, পরে ২০১৬ সালে বিষয়টি নিয়ে আরবিট্রেশন বা সালিশি আদালতের দ্বারস্থ হয়।

ভারত যে পরিবর্তন চায়

কিষেণগঙ্গা ও রাতলে প্রকল্প নিয়ে যে বিতর্ক, তার মীমাংসার চেষ্টায় কার্যত দুটি সমান্তরাল প্রক্রিয়া চলছিল – একটি ভারতের অনুরোধ অনুসারে নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ নিযুক্ত করে এবং অপরটি পাকিস্তানের অনুরোধ অনুসারে কোর্ট অব আরবিট্রেশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করে।

২০১৬ সালে বিশ্ব ব্যাঙ্ক এই দুটি সমান্তরাল প্রক্রিয়াই স্থগিত করার কথা ঘোষণা করে, কারণ তারা মনে করেছিল এই দুটি প্রক্রিয়াতে ‘পরস্পরবিরোধী’ রায় এলে তা চুক্তিটির ভবিষ্যৎকেই বিপন্ন করে তুলবে।কিন্তু চলতি বছরের ৩রা ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ব্যাঙ্ক জানায়, তারা এখন চাইছে এই দুটো প্রক্রিয়াই আবার পাশাপাশি চলুক।

বিশ্ব ব্যাঙ্কের এই প্রস্তাবেই তীব্র আপত্তি জানাচ্ছে ভারত। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী বিশ্ব ব্যাঙ্ককে বিদ্রূপ করে এমনও মন্তব্য করেছেন, “আমি তো জানতাম সিন্ধু জল চুক্তিটা দুটো দেশের মধ্যে!”মূল চুক্তিতে যে ‘গ্রেডেড মেকানিজম’ বা ধাপে ধাপে পর্যায়ক্রমিক আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির কথা বলা হয়েছে, ভারত যে সেই অবস্থানেই আবার ফিরে যেতে চাইছে সেটাও দিল্লির পক্ষ থেকে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে।

ভারতের এই প্রস্তাবে সাড়া দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের হাতে তিন মাস সময় আছে। কিন্তু এই সময়সীমার মধ্যে কোনও ইতিবাচক সাড়া না-মিললে ভারত চুক্তি বাতিল করার কথাও বিবেচনা করবে বলে সরকারি সূত্রগুলো আভাস দিচ্ছে।ভারতের প্রথম সারির থিঙ্কট্যাঙ্ক অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের একটি রিপোর্টে (৮ ফেব্রুয়ারি) মন্তব্য করা হয়েছে, “স্থায়ী ইন্ডাস কমিশনের আওতায় বিগত কয়েক দশকের হাইড্রো-কূটনীতির মাধ্যমে যে সাফল্য অর্জিত হয়েছিল, বিষয়টির রাজনীতিকরণের মাধ্যমে এখন তা নষ্ট হতে বসেছে, অবিশ্বাসের একটা বিষাক্ত বাতাবরণ তৈরি হয়েছে।”

ওই রিপোর্টের প্রণেতা সায়নাংশু মোদক ও নীলাঞ্জন ঘোষ আরও মনে করিয়ে দিয়েছেন, উজানের দেশ হিসেবে ভারতের যে সুবিধা বা ‘ইন্ডাস লিভারেজ’ আছে, দেশের অনেক বিশেষজ্ঞই এখন সেটিকে কাজে লাগানোর জন্য সওয়াল করছেন।

পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া

ভারত যেরকম ‘একতরফাভাবে সিন্ধু জল চুক্তিকে পাল্টাতে চাইছে’, সেটি একটি বিভ্রান্তিকর চেষ্টা বলে পাকিস্তান সরকার মন্তব্য করেছে।পার্মানেন্ট ইন্ডাস কমিশনে ভারত চিঠি পাঠানোর পর পাকিস্তানের অ্যাটর্নি জেনারেল শেহজাদ আতা ইলাহির কার্যালয় থেকে একটি কঠোর বিবৃতি জারি করা হয়।

ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “পাকিস্তান তাদের আপত্তি পেশ করার পর এত দেরিতে ভারত যেভাবে সেই বিতর্ক মীমাংসার পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, সেটা তাদের অসদিচ্ছার পরিচায়ক।”সিন্ধু অববাবাহিকার নদীগুলোর ওপর নির্মিত বিভিন্ন জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে দুটো দেশই যে বছরের পর বছর ধরে তর্কবিতর্ক চালিয়ে আসছে, বিবৃতিতে সেটাও মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এদিকে জলবায়ু পরিবর্তন ও উন্নয়ন খাতে পাকিস্তানের সুপরিচিত বিশেষজ্ঞ আলি তৌকির শেইখ ‘দ্য ডন’ পত্রিকায় (৯ই ফেব্রুয়ারি) এই বিষয়টি নিয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছেন।সেখানে তিনি মন্তব্য করেছেন, “তুলনায় দুর্বল দেশ হিসেবে পাকিস্তান এটাই মনে করে, যে কোনও দ্বিপাক্ষিক ইস্যুকে আন্তর্জাতিকরণ করতে পারলে আলোচনার টেবিলে তাদের অবস্থান অনেক বেশি শক্তিশালী হবে।”

সিন্ধু চুক্তি নিয়ে বিরোধকে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে টেনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটাই পাকিস্তানের আসল কারণ বলে তিনি মনে করছেন।ওই চুক্তিতে নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ, আরবিট্রেশন কোর্টে যাওয়ার অবকাশ কিংবা বিশ্ব ব্যাঙ্কের ‘অনেস্ট ব্রোকারে’র ভূমিকা পালনের মতো যে সব বৈশিষ্ট্য আছে, সেগুলো আঞ্চলিক আর কোনও নদী চুক্তিতে নেই বলেও মি শেইখ জানাচ্ছেন।

এদিকে পাকিস্তানের অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় থেকে আরও বলা হয়েছে, “এই যুক্তি একতরফাভাবে পরিবর্তন করা যাবে না। আমরা মনে করি সালিশি আদালতে যে শুনানি চলছে এটা সেখান থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর একটা চেষ্টা।”আলি তৌকির শেইখও মনে করছেন, ভারত এই চুক্তিতে যে ধরনের পরিবর্তন আনতে চাইছে তাতে শুধু সিন্ধু নিয়ে নয় – দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের “সবগুলো আন্তর্জাতিক জল সম্পর্কই বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।”

সূত্র : বিবিসি