কুরআন অনুধাবন করুন মাতৃভাষায়

কুরআন অনুধাবন করুন মাতৃভাষায়

ফাইল ছবি

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর জিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে; জেনে রাখ, আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তরসমূহ শান্তি পায়।’ (সূরা আর-রাদ, আয়াত : ২৮)।

পবিত্র কুরআন এমন এক মহা ঐশী গ্রন্থ যা পাঠে হৃদয় পবিত্র হয়। হৃদয়কে স্বচ্ছ পবিত্র করার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে পবিত্র কুরআন। তবে একটি বিষয় আমাদের বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে শুধু পবিত্র কুরআনের আরবি বাক্যগুলো পড়লেই হবে না বরং আল্লাহপাক এতে আমাদের কী শিক্ষা দিয়েছেন তাও বুঝতে হবে এবং সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনাও করতে হবে।

পবিত্র কুরআনের আদেশ-নিষেধ বোঝা ও আমল করার জন্য চাই মাতৃভাষায় পড়া। আমরা যদি পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের পর মায়ের ভাষায় অর্থ পড়ি তাহলে আল্লাহপাকের নির্দেশগুলো মেনে চলা আমাদের জন্য অনেক সহজ হবে।

পৃথিবীর সর্বত্র আজ যে অশান্তি আর নৈরাজ্য বিরাজ করছে এর জন্য আমরা কী দায়ী নই? অবশ্যই আমরাও দায়ী। কেননা, আজ আমরা পবিত্র কুরআনের অর্থ না বুঝার কারণে এর শিক্ষা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছি। বিশ্বময় শান্তির জন্য চাই শান্তির বৃক্ষে আশ্রয় নেওয়া আর এ শান্তির বৃক্ষ হচ্ছে পবিত্র কুরআন।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে এক নুর এবং উজ্জ্বল কিতাবও। এর মাধ্যমে আল্লাহ সেসব লোককে শান্তির পথে পরিচালিত করেন, যারা তার সন্তুষ্টির পথে চলে। আর তিনি নিজ আদেশে তাদের অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে নিয়ে যান এবং সরল সুদৃঢ় পথে তাদের পরিচালিত করেন’ (সূরা মায়িদা, আয়াত : ১৫-১৬)।

পবিত্র কুরআন মজিদ শান্তির বীজ হিসাবে আল্লাহতায়ালার অস্তিত্বে পূর্ণ ইমান আনাকে উপস্থাপন করেছে। এর পর স্পষ্ট প্রমাণ হলো, যারা আল্লাহতায়ালার অস্তিত্বে জীবন্ত ইমান রাখে তারা কখনো অস্থিরতা, অস্বস্তি বা মানসিক চাপের ততটুকু শিকার হয় না যাতে নিজের জীবন সম্পর্কেই নিরাশ হয়ে যেতে হয়।

আমরা দেখি, সেসব মনোনিত ব্যক্তি যাদের আল্লাহতায়ালা নিজে বেছে নিয়ে নবুয়্যতের মর্যাদায় ভূষিত করে তাদের হৃদয়ে এমন শান্তি ও প্রশান্তি ভরে দেন যে, পার্থিব জগতের শত বিরোধিতা এবং বিপদাপদের ঝড়-তুফান সত্ত্বেও তারা সর্বদা আল্লাহতায়ালার আঁচলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার ফলে শান্তি ও নিরাপত্তার জান্নাতে জীবন কাটান।

পৃথিবীর ইতিহাসে একজন নবি (আ.)ও এমন অতিবাহিত হননি যিনি পরিস্থিতির শিকার হয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছেন বা তার কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছেন। যেহেতু তাদের হৃদয় সর্বদাস্থায়ী শান্তি ও স্বস্তির আবাসস্থল হয়ে থাকে, তাই তাদের হৃদয়কে আল্লাহতায়ালা সর্বদা আলোকিত রাখেন। প্রত্যেক উদ্বেগ উৎকণ্ঠার সময় রহিম ও করিম খোদার রহমতের ছায়া তাদের মাথার ওপর বিরাজ করে এবং আল্লাহতায়ালার ক্ষমতাবলে তাদের তত্ত্বাবধান করেন।

কুরআন মজিদ এ মৌলিক বিষয়টিকে এভাবে বর্ণনা করেছে, ‘হৃদয়ে প্রকৃত ও সত্যিকারের শান্তি ও স্বস্তি আল্লাহতায়ালার স্মরণেই পাওয়া সম্ভব’ (সূরা রাদ, আয়াত : ২৮)। আর আল্লাহতায়ালাকে স্মরণ করার সম্পদ আল্লাহতায়ালার সত্তায় পূর্ণ ইমান বলেই পাওয়া যায়। আর এটি তখনই পূর্ণতা পাবে যখন আমরা নিজ মায়ের ভাষায় বুঝে পড়ব ও তার ওপর আমল করব।

প্রকৃতপক্ষে, হৃদয়ে যদি আল্লাহতায়ালার অস্তিত্ব সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকে এবং দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি হয়ে যায় তাহলে এটিই সেই ব্যবস্থাপত্র যা বিশ্ব শান্তির নিশ্চিত ও সত্যিকার মাধ্যম। সমাজে বসবাসকারী সব সদস্যের সঙ্গে উত্তম আচরণ করা এবং শান্তি ও নিরাপত্তার আচরণ অবলম্বন করার বিষয়ে মহানবি (সা.) ইসলামি শিক্ষামালার সারাংশ এভাবে বর্ণনা করেছেন, ‘প্রকৃত মুসলমান সে-ই, যার কথা এবং হাত থেকে কোনো মানুষ কোনোরূপ কষ্ট বা ক্ষতির সম্মুখীন হয় না’ (সুনানে নিসাই, কিতাবুল ইমান)। শান্তির এ শিক্ষাই পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বর্ণিত হয়েছে। আমরা যেহেতু নিজ মাতৃভাষায় পবিত্র কুরআন পড়ি না, চর্চা করি না যার ফলে সমাজে বিভিন্ন সময় নৈরাজ্য দেখা দেয়।

পবিত্র কুরআন পারস্পরিক সম্মান, ভক্তি ও মর্যাদা প্রদর্শনের বিষয়ে কতই না উত্তম শিক্ষা দিয়েছে, পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘হে যারা ইমান এনেছ! (তোমাদের) কোনো জাতি অন্য কোনো জাতিকে উপহাস করবে না। হতে পারে তারা এদের চেয়ে উত্তম। আর নারীরাও অন্য কোনো নারীদের (উপহাস করবে) না। হতে পারে তারা এদের চেয়ে উত্তম।

আর তোমরা নিজেদের লোকদের অপবাদ দিয়ো না। আর নাম বিকৃত করে তোমরা একে অন্যকে উপহাস করো না। ইমান (আনার) পর দুর্নামের ভাগীদার হওয়া অবশ্যই মন্দ। আর যারা অনুতাপ করে না তারাই দুষ্কৃতকারী’ (সূরা হুজরাত, আয়াত : ১২)। কতই না চমৎকার শিক্ষা পবিত্র কুরআনের। আমরা যদি নিজ ভাষায় কুরআনের অর্থ পড়তাম তাহলে কী সম্ভব অন্যের সঙ্গে মন্দ আচরণ করা? অবশ্যই না।

আরেকটি দোষ যা পুরো বিশ্বের শান্তি বিনষ্ট করে রেখেছে তা হলো মিথ্যা ও ভ্রান্ত বর্ণনা। সব শ্রেণিতে এ দোষটি এমনভাবে বিস্তার লাভ করেছে যে, মানুষের স্বভাবে এটি মিশ্রিত হয়ে গেছে। এর ফলে মানুষের মাঝে এবং জাতিতে জাতিতে পারস্পরিক আস্থা উঠে গেছে। কপটতা এবং প্রতারণা সমাজে এমনভাবে ঢুকে গেছে যে, বড় বড় দেশ গরিব দেশগুলোকে সহমর্মিতার নামে সাহায্য দেওয়ার সময় বিভিন্ন শর্তারোপের বাহানায় সর্বদার জন্য তাদের নিজেদের হীন গোলাম বানিয়ে নেয়।

এ দোষটি ব্যক্তিগত শান্তি এবং আন্তর্জাতিক শান্তিকে উইপোকার মতো কুরে কুরে খেয়ে ধ্বংস করে দিচ্ছে। পবিত্র কুরআন এ দোষকে কঠোরভাবে তিরস্কার করে। আল্লাহতায়ালার ভাষ্য, ‘আর সর্বদা সোজা সরল কথা বল’ (সূরা আল হাজ, আয়াত : ৩১)। আমরা যদি পবিত্র কুরআনের শিক্ষামালা অনুযায়ী চলতাম তাহলে পৃথিবীর অবস্থা আজ এমন হতো না। পবিত্র কুরআনের এ নীতি পুরো বিশ্বে শান্তির জন্য এক স্বর্ণালি নীতি। সততার সঙ্গে যদি এর ওপর আমল করা হয় তাহলে এ প্রশ্নই ওঠে না যে, কোনো রাষ্ট্র অন্য কোনো রাষ্ট্রের বিষয়াদিতে হস্তক্ষেপ করবে এবং এ বাহানায় তাদের সম্পদের ভান্ডার হরণ করবে বা এগুলোকে নিজের করায়ত্বে নিয়ে নেবে।

বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে যেসব শিক্ষা বর্ণনা করেছেন এগুলো সেসব চমৎকার শিক্ষামালার খুবই সংক্ষিপ্ত সামগ্রিক একটি চিত্র। এতে মুসলমানরাও সম্বোধিত এবং বিশ্বের অন্য লোকেরাও সম্বোধিত। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় সত্যিকারের আকাঙ্ক্ষী ও আগ্রহী প্রত্যেক ব্যক্তি এসব শিক্ষার সম্বোধিত। বর্তমান যুগের সংকটাপন্ন পরিস্থিতি দাবি করে, পবিত্র কুরআনের এসব শিক্ষামালাকে যদি হৃদয়ে গেঁথে নিয়ে কার্যে বাস্তবায়ন করা হয় তবেই সারা বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার ক্রোড়ে আশ্রয় নেবে।

আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দিয়ে পবিত্র কুরআনকে বোঝার ও হৃদয়ে ধারণ করার জন্য মায়ের ভাষায় প্রতিদিন কুরআন চর্চা করার বিকল্প নেই। তাই আসুন! আমরা সবাই সবার স্থানে থেকে সমাজ, দেশ ও পরিবারে শান্তির জন্য কাজ করি আর সে কাজ প্রথমে শুরু করি নিজ পরিবার থেকে। পরিবারের সবার জন্য বাধ্যতামূলক করে দেই প্রত্যহ কুরআন পাঠের পর অবশ্যই যেন মায়ের ভাষায় এর অর্থ পড়ে এবং তার ওপর আমল করার চেষ্টা করে। আল্লাহতায়ালা আমাদের এর তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট