নাজমুল হোসেন শান্ত যেভাবে বাতিলের খাতা থেকে তারকা হয়ে উঠলেন

নাজমুল হোসেন শান্ত যেভাবে বাতিলের খাতা থেকে তারকা হয়ে উঠলেন

নাজমুল হোসেন শান্ত যেভাবে বাতিলের খাতা থেকে তারকা হয়ে উঠলেন

নাজমুল হোসেন শান্ত ছিলেন দল থেকে বাদ পড়ার দ্বারপ্রান্তে, তাকে নিয়ে আশা হারিয়েছিলেন সমর্থকদের অনেকেই, এমনকি কেউ কেউ বলছিলেন, নাজমুল হোসেন শান্তকে যে সুযোগ দেয়া হচ্ছে, সেটা অন্যায্য এবং নির্বাচক কমিটি এই আস্থার প্রতিদান পাবে না।ক্রিকেট বিশ্লেষকরাও শান্তকে দলে নেয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তখন। কেউ কেউ তাকে ফেলেছিলেন বাতিলের খাতায়।

তবে পরবর্তীতে মিনহাজুল আবেদীন নান্নুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় দলের নির্বাচক কমিটি তাদের আস্থার প্রতিদান পেলেন সম্ভবত সবচেয়ে সুমিষ্ট প্রক্রিয়ায়।নাজমুল হোসেন শান্ত ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যে কোনও ফরম্যাটে বাংলাদেশের প্রথম সিরিজ জয়ের ম্যান অফ দ্য সিরিজ।একই সাথে বড় ব্যবধানে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক।এতোদিন যে উন্নতির কথা নির্বাচকরা বলছিলেন, যে সক্ষমতার কথা বলছিলেন টিম ম্যানেজমেন্ট, সেটার প্রতিফলন মাঠে দেখিয়েছেন নাজমুল হোসেন শান্ত।

বাংলাদেশের সাবেক কোচ রাসের ডমিঙ্গো শান্ত'র সাথে কাজ করে যারপরনাই খুশি ছিলেন, ম্যাচের আগে শান্ত যে নিবেদন নিয়ে কাজ করতেন, সেটা তার স্কোরকার্ডে প্রমাণ করতে বেগ পেতে হয়েছে।তবে তিনি এখন পারছেন। শান্ত যে পারেন, সেটা ২০২২ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকেই প্রমাণ দিচ্ছেন, যেখানে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান ছিল তার, বিশ্বকাপের সেরা পাঁচ রান সংগ্রাহকদের একজন হিসেবে ভিরাট কোহলিদের পাশে নাম লিখিয়েছিলেন এই ওপেনার।

শান্ত'র সবচেয়ে বড় গুণ সে মানসিকভাবে শক্তিশালী

বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিকেএসপির ক্রিকেট কোচ এবং সাকিবসহ বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন সিনিয়র ক্রিকেটারদের মেন্টর নাজমুল আবেদীন ফাহিমের মতে, “শান্ত ছোটখাটো কিছু টেকনিক্যাল বিষয় নিয়ে কাজ করেছে, তারই ফল সে এখন পাচ্ছে”।বর্তমান ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাঁচটি ইনিংস খেলেছেন নাজমুল হোসেন শান্ত, যার মধ্যে টি-টোয়েন্টিতে ৩টি এবং ওয়ানডেতে ২টি।

এই পাঁচ ইনিংসে দু'টি ফিফটি ও দু'টি ৪০ এর ঘরের ইনিংস।নাজমুল হোসেন শান্ত’র কাছে তার করা ৪৭ বলে ৪৬ রানের ইনিংসটিই সবচেয়ে বেশি মূল্যবান, এই ইনিংসে বাংলাদেশ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ জয় নিশ্চিত করেছিল দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতেই।নাজমুল হোসেন শান্ত তৃতীয় টি-টোয়েন্টি ম্যাচেও প্রভাবশালী একটি ইনিংস খেলেছেন ১৩০ স্ট্রাইক রেটে।

নাজমুল আবেদীন ফাহিম মনে করেন, শান্ত'র সবচেয়ে বড় গুণ সে মানসিকভাবে শক্তিশালী। এটা অনেক ক্রিকেটারের বেলায় ঘটে না।শান্তকে নিয়ে যেভাবে সমালোচনা হয়েছে এটা সামলানো কঠিন। তবে শান্ত এটাকে দারুণভাবে সামলেছেন বলে মনে করেন কোচ নাজমুল আবেদীন ফাহিম।“এতো কিছুর পরেও মানসিকভাবে কখনো ভেঙ্গে পড়েনি,” বলেন মি. ফাহিম।তিনি আরও বলেন, “এটা একটা ইঙ্গিত যে শান্ত ধীরে ধীরে বাংলাদেশের ক্রিকেটের গুরুত্বপূর্ণ একজন চরিত্র হয়ে উঠবেন”।

তারকা হয়ে উঠছেন শান্ত

ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক ও ধারাভাষ্যকার নাসের হুসেইনের মতে, শান্ত ধীরে ধীরে বাংলাদেশের তারকা হয়ে উঠছেন।শান্ত এখন টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি তিন ফরম্যাটেই বাংলাদেশের জাতীয় দলে নিয়মিত থাকবেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।মাত্র ১৮টি ওয়ানডের ক্যারিয়ার নাজমুল হোসেন শান্তর, কিন্তু এরই মধ্যে তার সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে হয়েছে তুমুল বিশ্লেষণ।আঠারো ম্যাচে তিনবার ০, ছয় ম্যাচে ১০ এর নিচে রান করেছেন শান্ত।

ওয়ানডে ফরম্যাটে সাড়ে চার বছর আগে অভিষেক হয়েছিল তার, শান্ত তার প্রথম অর্ধশতক পেয়েছেন এই মাসের এক তারিখ।এখন তার ক্যারিয়ারে দু'টো ওয়ানডে ফিফটি, দু'টিই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে।গত চার বছরে শান্ত জাতীয় দলে থিতু হতে যে সময় কাটিয়েছেন, তাতে অনেক ক্রিকেটারই অসহায় বোধ করতেন কিন্তু শান্ত নিবেদিত ছিলেন বলেই বিশ্বাস করেন নাজমুল আবেদীন ফাহিম।

শান্ত ২০১৬ সালের অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের সেরা পারফর্মারদের একজন ছিলেন, তখনই মনে করা হতো, তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ ‘কান্ডারী’ হতে যাচ্ছেন।তাই পরের বছরই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে শান্ত ডাক পেয়েছিলেন এবং টেস্ট ক্রিকেটে এখন শান্ত’র দু'টি সেঞ্চুরি, দু'টিই দেশের বাইরে এবং তিনটি ফিফটি।

ঘরোয়া ক্রিকেটের সাথে জাতীয় দলের পার্থক্য

শান্ত নিয়মিত রান পাননি এটা সত্য, কিন্তু ম্যাচে পুরোপুরি নিয়োজিত ছিলেন, ফিল্ডিংয়েও তার অবদান চোখে পড়ার মতো।নাজমুল আবেদীন ফাহিমের মতে, “বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেট ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের কাঠামো ও ক্রিকেটারদের মানের মধ্যে তারতম্য আছে। এটা অনেক সময় বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়।”একজন ক্রিকেটার যখন ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসে প্রত্যাশিত সফলতা পান না, তখন তিনি বোঝেন স্কিলই বড় কথা নয়, এখানে বড় ব্যাপার মানসিকভাবে শক্তিশালী হওয়া।

মি. ফাহিমের মতে, “শান্ত'র মধ্যে এই উপাদানগুলো আছে। তিনি নিজের দুর্বলতা জানেন এবং সেটা নিয়ে কাজ করেন। এটা বড় ক্রিকেটারের লক্ষণ।”বাংলাদেশে যেভাবে একজন ক্রিকেটার গড়ে ওঠেন এবং জাতীয় দল পর্যন্ত আসেন তাতে অনেক সময়ই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা বা স্বভাবজাত নেতা হয়ে ওঠার চর্চাটা থাকে না।

এখানে অনেক কিছুই পারিপার্শ্বিক অনেক মানুষের ওপর নির্ভর করে, যেটা একজন ক্রিকেটারকে স্বাধীনচেতা হয়ে উঠতে দেয় না।নাজমুল আবেদীন ফাহিমের মতে, এসব কারণে অনেক ক্রিকেটারই নিজের সক্ষমতা নিয়ে দ্বিধায় থাকে, অনেক ক্রিকেটারের শারীরিক ভাষায় আত্মবিশ্বাস থাকে না, অনেকে হীনমন্যতায় ভোগেন।নাজমুল হোসেন শান্ত এই সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন।

শান্ত 'পাস-মার্ক' পেয়েছেন

দশ ম্যাচ, পনেরো ম্যাচ, কখনো এক, দুই বছর একজন ক্রিকেটারকে বিচার করার জন্য যথেষ্ট সময় নয়, তবে এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগ, তাই যে কোনও মন্তব্য সহজেই ছড়িয়ে যায়।শ্রীলঙ্কার সাবেক ক্রিকেটার মারভান আতাপাত্তু টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেকের পর প্রথম ছয় ইনিংসের ছয়টিতেই শূণ্য রান করে আউট হয়ে গিয়েছিলেন।তিনি প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন অভিষেকের সাত বছর পরে।

গত দশকের সেরা ওপেনারদের একজন ভারতের বর্তমান অধিনায়ক রোহিত শর্মা ক্যারিয়ারের প্রথম শতক পেয়েছেন ৪৩তম ম্যাচে।বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের যে মান এবং ব্যাটসম্যানদের যে ধরনের উইকেটে খেলতে হয়, তাতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে খানিকটা বেশি সময় লাগাটাই স্বাভাবিক বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

নাজমুল হোসেন শান্ত'র প্রতি সমর্থকদের একটা বড় অংশের সোশ্যাল মিডিয়া ট্রায়াল একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ চলার সময় গণমাধ্যমে শান্ত বলেছিলেন, “কখনো কখনো মনে হয়, গোটা দেশের বিরুদ্ধে খেলি আমি।”এই বিপিএলেই শান্ত ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের ম্যান অফ দ্য টুর্নামেন্ট, তবে স্ট্রাইক রেট কম হওয়ায় এই প্রাপ্তিতে অনেকে 'পাস মার্ক' দিতে রাজি হননি।এবারে শান্ত পাস মার্ক পেলেন, তাও আবার দুই ফরম্যাটের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে।

সূত্র : বিবিসি