ভিনিশিয়াসকে 'বানর' বলে গালি, বর্ণবাদী আচরণে সমালোচনার ঝড়

ভিনিশিয়াসকে 'বানর' বলে গালি, বর্ণবাদী আচরণে সমালোচনার ঝড়

ভিনিশিয়াস রেফারিকে দেখাচ্ছিলেন কে ছুড়েছে বর্ণবাদী মন্তব্য

ব্রাজিল ও রেয়াল মাদ্রিদে খেলা তরুণ ফরোয়ার্ড ভিনিশিয়াস জুনিয়রকে উদ্দেশ্য করে বর্ণবাদী মন্তব্য করার অভিযোগে তিনজনকে গ্রেফতার করেছে স্প্যানিশ পুলিশ।স্প্যানিশ পুলিশ টুইটারে জানাচ্ছে, গ্রেফতারকৃতদের বয়স ১৮ থেকে ২১ এর মাঝে।

এর আগে জার্সি পরিহিত পুত্তলিকা ব্রিজে ঝোলার অভিযোগে মাদ্রিদে চারজনকে গ্রেফতার করেছে স্প্যানিশ পুলিশ, এই বছরের ২৬শে জানুয়ারি এই ঘটনা ঘটেছিল, এই পুত্তলিকার ওপরে একটি ব্যানারে লেখা ছিল ‘মাদ্রিদ রেয়ালকে ঘৃণা করে’।ভিনিশিয়াস জুনিয়রকে উদ্দেশ্য করে সাম্প্রতিক বর্ণবাদী আচরণের ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে স্প্যানিশ পুলিশ। এই ঘটনায় কড়া সমালোচনা করছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাবেক ও বর্তমান ফুটবলাররা।

রবিবার ব্রাজিলের তরুণ তারকা ভিনিশিয়াস জুনিয়র স্প্যানিশ লিগের একটি ম্যাচে তার বিরুদ্ধে বর্ণবাদী আক্রমণ হয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন। গোটা লা লিগাকেই তিনি বর্ণবাদীদের লিগ বলে আখ্যা দিয়েছেন। ভিনিশিয়াসের ক্লাব রেয়াল মাদ্রিদ স্পেনের আদালতে এই ঘটনায় ‘হেইট ক্রাইম’-এর অভিযোগ তুলে একটি মামলা করেছে।ম্যাচের মধ্যেই ভিনিশিয়াস জুনিয়র উত্তেজিত হয়ে ভ্যালেন্সিয়ার সমর্থকদের আচরণ সম্পর্কে রেফারিকে জানানোর চেষ্টা করেছিলেন।এরপর ম্যাচের ৯৭তম মিনিটে ভিনিশিয়াস একটি হাতাহাতির ঘটনায় জড়িয়ে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন।

ভিনিশিয়াস কী বলেছেন?

এই ঘটনার পর ভিনিশিয়াস নিজের ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্টে লেখেন, “যে লিগ একসময় রোনালদিনিও, ক্রিশ্চিয়ানো, মেসিদের ছিল তা আজ বর্ণবাদীদের দখলে।”“এটা প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় ঘটনা নয়। লা লিগায় বর্ণবাদ একটা স্বাভাবিক ঘটনা, কর্তৃপক্ষই মনে করে এটা স্বাভাবিক এবং প্রতিপক্ষ এটাকে উষ্কে দেয়”।

ভিনিশিয়াস লিখেছেন, “দারুণ একটা দেশে আমি এসেছি, যারা আমাকে গ্রহণ করেছিল উষ্ণভাবে, কিন্তু তারা সবাই আজ নিজেদের বর্ণবাদী হিসেবে জাহির করছে। আমি দু:খিত অনেকেই আমার সাথে একমত হবেন না কিন্তু আজ ব্রাজিলে স্পেনকে সবাই বর্ণবাদী জাতি হিসেবে জানবে”।

ভিনিশিয়াস বলেন, ‘স্পেনের এই লিগে বর্ণবাদী আচরণ একদিন কিংবা দুদিনের ঘটনা নয়, এটা চলে আসছে, প্রতি সপ্তাহে এটা হচ্ছে কারও না কারও সাথে’।বিবিসি স্পোর্টস ধারণা করছে, ভিনিশিয়াস জুনিয়রকে উদ্দেশ্য করে যে বা যারা র্বণবাদী মন্তব্য করেছেন, তাদের মধ্যে দুজনকে চেনা গেছে এবং ভ্যালেন্সিয়া তাদের স্টেডিয়ামে প্রবেশ চিরতরে বন্ধ করতে যাচ্ছে।এই মৌসুমেই ভিনিশিয়াসকে বেশ কয়েকবার বর্ণবাদী মন্তব্যের মুখে পড়তে হয়েছে।

লা লিগা প্রেসিডেন্ট কী বলেছেন?

যদি অপরাধ চিহ্নিত হয় সেক্ষেত্রে ‘যথাযথ ব্যবস্থা নেবে’ বলে জানিয়েছে লা লিগা কর্তৃপক্ষটুইটারে লা লিগা প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের তেবাজ বলেছেন, বর্ণবাদ রোধে লা লিগা কী করতে পারে এই বিষয়ে আলোচনায় দুইবার ভিনিশিয়াস আসেননি।‘লা লিগার সমালোচনা করার আগে ভিনিশিয়াসকে নিজের ব্যাপারে জানতে হবে’, লিখেছেন লা লিগা প্রেসিডেন্ট।

বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে স্প্যানিশ পত্রিকা মার্কার সাংবাদিক হুয়ান ক্যাস্ট্রো বলেন, “ভ্যালেন্সিয়ার সমর্থকরা ভিনিশিয়াসের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে তারা বানর ডেকেছে। আমাদের স্পেনে এই সমস্যাটা আছে, ভিনিশিয়াসের সাথে এটা এনিয়ে দশ বার ঘটলো”।বিবিসি অন্তত সাতবার এমন রেকর্ডের কথা উল্লেখ করেছে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে।

যার মধ্যে আছে অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদের বর্ণবাদী গান, ভিনিশিয়াসের গোল উদযাপন নিয়ে সমালোচনা, মায়োর্কা সমর্থকদের বর্ণবাদী মন্তব্য।বিশ্লেষকরা মনে করছেন, লা লিগা এক্ষেত্রে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। ইংলিশ ফুটবল উপস্থাপক মিকাহ রিচার্ডস বলছেন, “তেবাজ যে মন্তব্য করেছে তাতে আমার রক্ত গরম হয়ে গেছে”।“তেবাজ চেষ্টা করছেন, যাতে লোকে ভিনিশিয়াসকেই দোষী মনে করে এবং এটা লজ্জাজনক। এটা আর ফুটবলের মধ্যে নেই। এটা মানুষের দৈনন্দ্যিন সমস্যা”।

ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে সেই ম্যাচের ৭০ মিনিটের পরে দেখা গেছে ভিনিশিয়াস গ্যালারিতে থাকা এক দর্শকের দিকে ইঙ্গিত করছেন এবং ভ্যালেন্সিয়ার ফুটবলাররা ও রেয়াল মাদ্রিদের সতীর্থরা তাকে বোঝাচ্ছেন যাতে ঘটনা বেশি দূর না গড়ায়।খেলা চলাকালীন ধারাভাষ্যকার বলছিলেন, “এটা ফুটবলের প্রতিই অপমান এবং একটা নোংরা দৃশ্য আমরা দেখছি”।

ফিফার নিয়মে কী আছে?

ভিনিশিয়াস জুনিয়র ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই বর্ণবাদী মন্তব্য নিয়ে সোচ্চার এবং সাম্প্রতিক সময়ে তিনি ফুটবল বিশ্বে একজন চরিত্র হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছেন।

রেয়াল মাদ্রিদের ম্যানেজার কার্লো আনচেলত্তি বলছিলেন, “গোটা স্টেডিয়ামেই বর্ণবাদী গালিগুলো শোনা যাচ্ছিল”।“আমরা যা দেখেছি তা মেনে নেয়া যায় না একেবারেই। লা লিগার সমস্যা রয়েছে, ভিনিশিয়াস এখন বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফুটবলারদের একজন, এখন বর্ণবাদের কারণে খেলা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।”ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগে এই মৌসুমে শুধু লিওনেল মেসি ও ভিনিশিয়াস জুনিয়রের বিশটির বেশি গোল ও এসিস্ট রয়েছে।

ভ্যালেন্সিয়া কর্তৃপক্ষও বলেছে তারা এই ঘটনা তদন্ত করবে এবং সবচেয়ে কঠোর ব্যবস্থাই নেবে।“এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা, ভ্যালেন্সিয়া কর্তৃপক্ষ যে কোনও ফুটবলারকেই অপমান, আক্রমণের বিপক্ষে”।ফিফা প্রেসিডেন্ট জেয়ানি ইনফান্তিনো ভিনিশিয়াসের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করে বিবৃতি দিয়েছেন। মি. ইনফান্তিনো বর্ণবাদী মন্তব্যের বিরুদ্ধে লড়তে ফিফার আনুষ্ঠানিক নিয়মের কথা মনে করিয়ে দেন।

তিনি বলেছেন, “প্রথমে আপনার ম্যাচ বন্ধ করে ঘোষণা করতে হবে, দ্বিতীয়ত ফুটবলারদের মাঠ ছাড়তে হবে যদি এই আক্রমণ চলতে থাকে”।“যদি তারপরেও এই ধরনের আক্রমণ চলতে থাকে তাহলে প্রতিপক্ষকে পূর্ণ তিন পয়েন্ট দিয়ে দিতে হবে, এই নিয়মগুলো সব দেশে, সকল লিগে বাস্তবায়ন করতে হবে”।

বর্ণবাদ 'সামাজিক অসুখ'

ইংল্যান্ড ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাবেক ডিফেন্ডার রিও ফার্দিনান্ড নিজের ইন্সটাগ্রামে লিখেছেন, এই কর্তৃপক্ষ ভিনিশিয়াসের কোনও কাজেই আসছে না। স্পেনে ভিনিশিয়াসকে কে রক্ষা করবে? কতবার আমরা এই ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখবো?”

থিবো কুর্তোয়া বলেছেন, খেলার ২০ মিনিটের মাথায় তিনি গ্যালারি থেকে বানরের ডাক শুনতে পান।“যদি ভিনি খেলতে চায় তো আমরা খেলবো, যদি সে মাঠ ছাড়তে চায় তবে আমি তার সাথে হাঁটা দেবো। এই ধরনের ঘটনা সহ্য করবো না”।ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি এডনালডো রদ্রিগেজ বলেছেন, “আমরা কতো দিন এসব ঘটনা দেখতে থাকবো? একবিংশ শতাব্দীতে এসেও লা লিগায় এমন ঘটনা দেখতে হচ্ছে?”

ব্রাজিলের বিখ্যাত ভাস্কর্য ক্রাইস্ট দ্য রিডিমারের আলো এক ঘণ্টার জন্য নিভিয়ে দেয়া হয়েছিল ভিনিশিয়াসের প্রতি সংহতি প্রকাশের জন্য।স্পেনের ফুটবল লেখক গিলেম বালাগ এই ঘটনায় বিবিসিতে একটি কলাম লিখেছেন, যেখানে তিনি ভিনিশিয়াসকে উদ্দেশ্য করে ঘটে আসা নানা ঘটনাকে সমাজের অসুখ বলে চিহ্নিত করেছেন।এই ঘটনাগুলোকে ন্যাক্কারজনক বলে আখ্যা দিয়েছেন বালাগ।

“ভিনিশিয়াস টানা এই ধরনের ঘটনায় চুপ থাকেননি এটা দারুণ। স্পেনে অনেকেই মনে করছে স্টেডিয়ামে বর্ণবাদী আক্রমণ করা একটা মজা বা খুনসুটি, এটা সত্যিই অবাক করার মতো ঘটনা। ভিনিশিয়াস বলে দিয়েছে, এবার যথেষ্ট”।গিলেম বালাগের মতে দৃষ্টান্তমূলক কোনও পদক্ষেপ না নিলে এসব থামবে না। লা লিগার কাজ হচ্ছে এসব ঘটনা আমলে নেয়া, তদন্ত করা এবং পুলিশের কাছে বিবরণ দেয়া, এরপরের দায়িত্ব পুলিশের।এর আগে স্পেনে একজন এস্পানিওল সমর্থককে হাজতে দেয়া হয়েছিল ইনাকি উইলিয়ামসকে বর্ণবাদী মন্তব্য করার দায়ে।

গিলেম বালাগ লিখেছেন, “বিশ্বব্যাপীই আসলে এটা নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। আমরা আগাচ্ছি বটে কিন্তু শামুকের গতিতে”।ভিনিশিয়াস জুনিয়র যেভাবে প্রতিবাদ করেছেন এবং মাঠেই একটা বিহিত করার চেষ্টা করেছেন তা ফুটবল অঙ্গনকে একটা ধাক্কা দিয়েছে, গ্যারেথ বেল, রোনালদো নাজারিও, কাকা, রিও ফার্দিনান্দের মতো ফুটবলাররা ভিনিশিয়াস জুনিয়রের প্রতি সংহতি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন।

সূত্র : বিবিসি