১৯ অক্টোবর, ২০১৯
বিশ্বের প্রবল ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের একজন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। গোয়েন্দা কর্মকর্তা থেকে প্রেসিডেন্ট হয়ে যাওয়া এই ব্যক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর দূর্বল ভেঙ্গে পড়া রাশিয়াকে বিশ্ব শক্তিতে পরিনত করেছেন। ২০ বছর ধরে তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে আছেন। তবে সুষ্টু ভোটের মাধ্যমে নয়, তার নিজস্ব কায়দায়। হিলারি ক্লিনটনের ভাষায় পাতলা চামড়ার এই শক্ত নেতার বয়স বাড়ছে। কিন্তু চেহারা দেখে তা বোঝার উপায় নেই।
ভ্লাদিমির পুতিন ৬৭ বছরে পা দিয়েছেন ৭ অক্টোবর। দিনটি কাটিয়েছেন সাইবেরিয়ার এক পাহাড়ে। সীমান্তবর্তী মঙ্গোলিয়ার তুবা পাহাড়ে অভিযানে গেছেন পুতিন। তার সঙ্গে ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী সর্গেইে শোইগু। লাঠি হাতে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুড়ছেন। ভ্লাদিমির পুতিন মাঝে মাঝে এমন রোমা কর অভিযানে যান। যেনো একঘেয়ে কর্মব্যস্ত সময়ে মাঝে নিখাদ অবকাশ। নিজেকে চাঙ্গা করা। কখনো নেমে যান কাস্পিয়ান সাগর বা অন্য কোনো লেকে মাছ ধরতে। এমনকি সাবমেরিনে চেপে চলে যান পানির নীচে। আসলে তার জীবনটা গল্পের মতো। পুতিন দেরিতে ঘুম থেকে ওঠেন এবং প্রায় দুপুরের দিকে তার দিনের প্রথম খাবার খান। নাশতায় তার ‘কটেজ চিজ’ নামে পনির থাকে। এ ছাড়া তিনি কোয়েলের ডিম ও ফলের রস পছন্দ করেন। সকালে নাশতার পর পুতিন সুইমিং পুলে নামেন সাঁতার কাটার জন্য। এ সময় তিনি সাঁতার কাটার চশমা পরে নেন এবং ক্রলিং স্টাইলে সাঁতার কাটেন। সাঁতারের পর জিমে তিনি কিছুটা সময় দেন। এরপর গরম ও ঠান্ডা পানিতে গোসল করেন। ২০১৪ সালে নিউজ উইক ম্যাগাজিনে তার জীবনের ওপর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছিলো।
পুতিন ইন্টারনেট পছন্দ করেন না আর তার অফিসে টেলিভিশনও নেই। যোগাযোগের ক্ষেত্রে তিনি খুবই নিরাপদ প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। এর অন্যতম হলো কাগজ ও সোভিয়েত যুগের ল্যান্ড টেলিফোন লাইন। তিনি খুব কমই ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। বিদেশ ভ্রমণের সময় নিরাপত্তার খাতিরে তার সাথে থাকে রাশিয়ান বাবুর্চি, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও ওয়েটার। হোটেলে থাকার সময় তার সাথে থাকা লোকজন হোটেলের সব কাগজ ও প্রসাধনী দ্রব্য সরিয়ে ফেলে সেখানে ক্রেমলিনের অনুমোদিত সামগ্রী রেখে দেয়। আর ক্রেমলিনের অনুমোদন ছাড়া তিনি কোনো বিদেশী খাবার খান না। বসবাস করেন মস্কোর বাইরের একটি স্থানে । এর কারণ হিসেবে জানা যায় তিনি যানজট, দূষণ ও মানুষের ভিড় অপছন্দ করেন। তিনি তার সরকারি দফতর ক্রেমলিনে যেতেও পছন্দ করেন না। পুতিনের নিজস্ব কর্মীরা তাকে ‘টিসার’ নামে ডাকে। যার অর্থ বস।
ব্যক্তিগত জীবনে দুই কন্যার জনক পুতিনের স্ত্রী লুদমিলার সাথে বিচ্ছেদ হয় ২০১৩ সালে। রুশ, জার্মান, ইংরেজীসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় পারদর্শী তিনি। জুডোতে ব্ল্যাকবেল্টধারী পুতিন আইস হকি, মার্শাল আট, ব্যাডমিন্টন, সাঁতার ও শিকারে দক্ষ। ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টাইম ম্যাগাজিনের পত্রিকার ‘বছরের সেরা ব্যক্তিত্ব’ ও ২০১৫ সালে সবচেয়ে ‘প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব’ এবং ফোবর্স ম্যাগাজিনের ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত টানা সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিত্ব মনোনীত হয়েছেন। বিরোধীদের দাবি, পুতিন অত্যন্ত ধনী ব্যক্তি হলেও সরকারি কাগজপত্রে সম্পদের পরিমান কম দেখানো হয়।
এতো গেলো বিশ্বের ক্ষমতাধর এক প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত জীবনের কথা। কিন্তু তার রাজনৈতিক জীবন কেমন? দুই দশকের বেশি সময় যাবত ক্ষমতায় আছেন। কিভাবে তিনি ক্ষমতার শীর্ষে উঠে এলেন? আর কিভাবে বা তিনি দেশ পরিচালনা করছেন।
১৯৫২ সালের ৭ অক্টোবর এক শ্রমিক পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন ভ্লাদিমির পুতিন। বাল্যকাল থেকেই খেলাধুলা করতে ও গুপ্তচরদের নিয়ে সিনেমা দেখতে ভালোবাসতেন। রুশ প্রজাতন্ত্র বা রাশিয়ার অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তিনি।
ভ্লাদিমির পুতির লেখাপড়া করেছেন আইন বিষয়ে। চাকরি করেছেন গোয়েন্দা সংস্থায়। তিনি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৭৫ সালে লেনিনগ্রাদ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের আর্ন্তজাতিক শাখা থেকে উত্তীর্ণ হন। তাকে সেই সময়ের নিয়ম মেনে দেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিভাগে কাজ করতে পাঠানো হয়। ১৯৮৪ সালে তিনি মস্কো শহরের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পরিষদের উচ্চ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হন ও জার্মান ভাষায় দক্ষ হয়ে এই ভাষার দেশগুলোতে কাজের জন্য বিশেষভাবে তৈরি হন। এরপর তাকে তৎকালীন পূর্ব জার্মানিতে পাঠানো হয়। যেখানে তিনি ১৯৮৯ সালের শেষ পর্যন্ত ড্রেসডেন শহরের সোভিয়েত জার্মান মৈত্রী ভবনের ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেন।
১৯৯২ সালে তিনি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পরিষদ থেকে অবসর নেন। সেই সময়ে তিনি ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল। সেন্ট পিটার্সবার্গ ফিরে আসার পর তিনি শহরের বিধানসভার সভাপতি আনাতোলি সবচাকের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অবস্থা থেকেই তাকে চিনতেন পুতিন। ১৯৯৬ সালে মস্কো আসার পর তিনি রাশিয়ার রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৮ সালে তাকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পরিষেবার ডিরেক্টর পদ দেয়া হয়। আর ১৯৯৯ সালের মার্চ মাস থেকে রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের সচিব নিযুক্ত করা হয়। আগস্ট মাসে তিনি মন্ত্রিসভার সভাপতি হন। ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি বরিস ইয়েলৎসিনের পক্ষ থেকে সময়ের আগেই নিজের ওপর থেকে দায়িত্বভার প্রত্যাবর্তনের পর তিনি কার্যকরভাবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পুতিন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে রুশ প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বরিস ইয়েলৎসিন আকস্মিকভাবে পদত্যাগ করার প্রেক্ষাপটেই তার এই দায়িত্বভার গ্রহণ।
২০০০ সালের ২৬ মার্চ তিনি রাশিয়ান ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ২০০৪ সালের ১৫ মার্চ তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কিন্তু সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতাজনিত কারণে পুতিন ধারাবাহিকভাবে তৃতীয় মেয়াদের জন্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি।
পরে ২০০৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তার উত্তরসূরি হিসেবে দিমিত্রি মেদভেদেভ জয়লাভ করেন। এতে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেয়ার মাত্র দুই ঘণ্টার মাথায় মেদভেদেভ রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভ্লাদিমির পুতিনকে মনোনীত করেন। ২০০৮ সালের ৮ মে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দাফতরিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন পুতিন।
প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে পুতিন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেন যে, তিনি তৃতীয় মেয়াদের জন্য নতুন করে ২০১২ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। ২০১২ সালের নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ চার বছর থেকে বাড়িয়ে ছয় বছর করা হয়। আবার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হন পুতিন। ২০১৭ সালে শেষ হয় তার তৃতীয় মেয়াদ। ২০১৭ সালের নির্বাচনে জিতে শুরু হয় চতুর্থ মেয়াদের পুতিন যুগ, যা চলবে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। বর্তমান নিয়মে ২০২৪ সালের নির্বাচনে পর পর তিনবার প্রার্থী হতে পারবেন না পুতিন। তবে রাশিয়ার রাজনীতিতে তার যে অবস্থান তাতে এই মেয়াদের মধ্যেই সংবিধান থেকে মেয়াদের এই সীমাবদ্ধতা সংক্রান্ত ধারাটি তুলে দিলেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।
ভ্লাদিমির পুতিন বেশ কঠোরভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। গোয়েন্দা কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা থেকে ভিন্ন মতাবলম্বীদের এক রকম দমন করে একক হাতে দেশ পরিচালনা করেছেন। দেশের ভেতরে যেমন তার রাজনৈতিক বন্ধু নেই। তেমনি নেই কোনো প্রতিদ্বন্দ্বি।তবে আর্ন্তজাতিক পরিমন্ডলে ভøাদিমির পুতিনের কোনো বন্ধুর অভাব নেই। বিশে^র অনেক দেশে এখন কতৃত্ববাদি শাসন চলছে। এই শাসকদের সাথে গড়ে উঠেছে পুতিনের ঘনিষ্টতা। আসুন আর্ন্তজাতিক রাজনীতিতে পুতিন কাদের সাথে সুসর্ম্পক বজায় রেখে চলছেন।
ভ্লাদিমির পুতিন ক্ষমতায় আসার পর ব্যাপক সামরিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে হারানো গৌরব ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছেন।রুশদের মধ্যে পুতিনের জনপ্রিয়তাও কম নয়। বিশেষ করে তরুণরা দেশের নেতৃত্বে পুতিনকেই চান বলে জানা গেছে বিভিন্ন জরিপে। পুতিন যুগে রাশিয়ার নাগরিকদের আর্থিক অবস্থা উন্নত হয়েছে। দারিদ্রের হার ২৮ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ১৩ শতাংশে। দেশটির জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি লোক এখন ব্যক্তিগত গাড়ির মালিক। নাগরিক সুযোগ-সুবিধাও বেড়েছে অনেক। তবে ২০০০ সালের পর থেকে রাশিয়াকে যেভাবে বিশ্বরাজনীতিতে তার পুরনো অবস্থান ফিরে পাওয়ার পথে নিয়ে চলেছেন- সেটিই তার জনপ্রিয়তার মূল কারণ।
গত ২০ বছরে রাশিয়ার সামরিক সক্ষমতা বেড়েছে বহুগুণ। কিছু আগ্রাসী পদক্ষেপও নিয়েছেন। যা আত্মবিশ্বাস ও ক্ষমতার কথাই প্রমাণ করে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল ও সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পক্ষে সরাসরি যুদ্ধ করাকে পুতিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। চীনের সাথে বাড়িয়েছেন গভীর সর্ম্পক। চীনের প্রেসিডেন্ট পুতিনকে বেস্ট ফ্রেন্ড হিসাবে অভিহিত করেছেন। ন্যাটোর সদস্যতুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েপ এরদোগানের সাথে এখন তার বন্ধুত্বপূর্ন সর্ম্পক। দুই নেতা বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক ফোরামে ঘন ঘন বৈঠক করছেন। এমনকি ট্রাম্পের সাথে তার গোপন সর্ম্পক রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। তবে সমালোচকরা বলেন দুনিয়ার গনতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদি শাসকদের সাথে নিবিড় সর্ম্পকে গড়ে তুলেছেন তিনি। যে কারনে নিজেই বলেছেন উদার নৈতিক গনতন্ত্রের দিন শেষ হয়ে গেছে। ক্রিমিয়া দখলের পর থেকে রাশিয়ার ওপর কয়েক দফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। যা দেশটির ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদেরজন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। পুতিনের শাসনামলে পশ্চিমাদেশগুলোর সাধে রাশিয়ার সম্পর্ক শীতল থাকবে বলেই মনে করা হচ্ছে। ইউরোপীয় নেতারা তো বলেই দিয়েছেন, মস্কোর সাথে তাদের সম্পর্ক সহজ হবে না।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কঠিন সংগ্রাম ও কঠোর পরিশ্রমের মধ্যদিয়ে তাকে এ পর্যায়ে আসতে হয়েছে। একই সাথে তার জীবন ঝুকিপূর্নও বটে। একনায়কত্ববাদী শাসক হিসাবে তার সমালোচনা করা হলেও বাস্তবতা হচ্ছে দূর্বল রাশিয়াকে তিনি আর্ন্তজাতিক রাজনীতির রঙ্গমে নিয়ে এসেছেন।
আলফাজ আনাম : সাংবাদিক