১২ জুন, ২০২২
অর্ধ শতাব্দী আগে যে সব জায়গায় ছিল পথের ধারের বাজার আর তাঁবুর মত দেখতে বসতবাড়ি, সে সব জায়গায় এখন অত্যাধুনিক শহর, চোখ ধাঁধানো স্থাপত্যের সারি সারি গগনচুম্বী অট্টালিকা আর প্রশস্ত সড়ক। দেখে মনে হবে যেন, মরুর বুকে মহাকাশের কল্পিত কোনো নগরী নেমে এসেছে।
যেসব জায়গায় ৫০ বছর আগেও মানুষ গাছ থেকে খেজুর পাড়তো, মুক্তোর লোভে সাগর বেলার ঝিনুক কুড়াতো কিংবা উট পালতো, সেখানে এখন প্যারিসের ল্যুভ যাদুঘরের শাখা, আমেরিকান বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের, এমনকি প্যারিসের বিখ্যাত সোরবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের, স্যাটেলাইট ক্যাম্পাস।
বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবন এখন ইউএই’তে, সবচেয়ে বিলাসবহুল হোটেলও সেখানে। এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দামে চিত্রকর্ম কিনেছে ইউএই (লিওনার্দোর আঁকা সালভাটোর মুন্ডি)। কিছুদিন আগ পর্যন্তু বিশ্বের সবচেয়ে বড় শপিং মলও ছিল এখানে।
গত বেশ কয়েক বছর ধরে সংযুক্ত আরব আমিরাত পশ্চিম এবং প্রাচ্যের মধ্যে একটি যোগসূত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। তেল সম্পদের পয়সায় এই মরুর দেশে আধুনিকতা, আধুনিক প্রযুক্তি এবং চোখ ধাঁধানো চাকচিক্যের অসামান্য প্রসার ঘটেছে।
সেই সাথে ইউএই হয়ে উঠেছে বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্র। পারস্য উপসাগরে দেশটি এখন পশ্চিমা বিশ্বের অন্যতম প্রধান মিত্র।
কীভাবে তৈরি হলো ইউএই
কে এই মরু রাষ্ট্রের অবিশ্বাস্য রূপান্তরের রূপকার?
মধ্যপ্রাচ্যের পর্যবেক্ষকরা কোনো দ্বিধা ছাড়াই যার নাম করেন তিনি হলেন সদ্য মৃত শেখ খালিফা বিন জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান। এই শতাব্দীর শুরু থেকে এ মাসে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনিই উপসাগরীয় কতগুলো মরু রাজ্যের এই কনফেডারেশনের শাসক ছিলেন।
বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী এবং আবুধাবির আমীর শেখ খালিফা ছিলেন ইউএইর দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট। এই দেশকে তিনি আঞ্চলিক মানচিত্রের বাইরে বিশ্ব মানচিত্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসিয়ে গেছেন।
২০১৪ সালে একটি স্ট্রোকের পর থেকে শেখ খালিফা লোকসমক্ষে খুব একটা আসতেন না। কিন্তু সর্বত্রই দৃশ্যমান ছিলেন তিনি। সরকারি অফিস থেকে শুরু করে হোটেলের লবি, রেস্তোরাঁ, দোকানপাটের দেয়ালে ঝুলছে তার ছবি।
তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন তারই সৎ ভাই মোহামেদ বিন জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান। অবশ্য কেউই তাতে বিস্মিত হয়নি। গত এক দশক ধরে শেখ মোহামেদই আমিরাতের পররাষ্ট্র নীতির কর্ণধার ছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
কিন্তু কীভাবে এই শেখ রাজবংশ উপজাতীয় কয়েকটি রাজ্যের কনফেডারেশনকে মধ্যপ্রাচ্যের নতুন শক্তিতে রূপান্তর করলেন?
১৯৬০ এর দশকের শেষ নাগাদ, ব্রিটেন পারস্য উপদ্বীপ এলাকায় উপনিবেশগুলো থেকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। তার আগের এক শ’ বছর আগে ব্রিটিশরা ওই এলাকায় আসে। প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, ওই এলাকার উপকূলের পাশ দিয়ে যাওয়া মালবাহী জাহাজে জলদস্যুতা নিয়ন্ত্রণে আনা। কারণ বহু উপজাতীয় আরব প্রায়ই ওই সব জাহাজে হামলা করে লুটতরাজ করতো।
যদিও সে সময় তেল পাওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল, তারপরও ব্রিটিশরা মনে করলো সেই লোভে এই এলাকায় শাসন অব্যাহত রাখার ঝুঁকি লাভের চেয়ে অনেক বেশি।
সে সময়ই ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যের (আবুধাবি, দুবাই, শারজাহ, আজমান, উম আল খাইন এবং ফুজাইরা) শাসক শেখরা স্ব স্ব এলাকার শাসন ব্যবস্থা নিয়ে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় এবং শলা-পরামর্শের জন্য একটি কাউন্সিল গঠন করেন।
এরপর ১৯৭১ সালে ডিসেম্বরে তারা অভিন্ন একটি দেশ গঠনের ঘোষণা করেন - ইউনাইটেড আরব আমিরাত - যেটি আধা-স্বশাসিত ছয়টি আমিরাত বা রাজ্যের একটি কনফেডারেশন হবে।
পরপরই আরেকটি আমিরাত - রাস আল খাইমা - এই কনফেডারেশনে যোগ দেয়। এই সাতটি আমিরাত নিয়েই বর্তমানের ইউএইর মানচিত্র।
সে সময়কার আবুধাবির আমির জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান (খালিফা এবং মোহামেদের বাবা) এই কনফেডারেশনের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তার কিছুদিন আগে এ অঞ্চলে তেল পাওয়া যায়। ফলে শুরু হয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপক এক প্রক্রিয়া। সেই সাথে বাড়তে থাকে জনসংখ্যা এবং জমা হতে থাকে অভ্যন্তরীণ সম্পদ।
ধনী হওয়ার প্রক্রিয়া
পারস্য উপসাগর অঞ্চলের বাকি রাজতন্ত্রগুলো (সৌদি আরব, ওমান, কাতার, বাহরাইন, কুয়েত) যে প্রক্রিয়ায় এগিয়েছে, ইউএইও সেই একই পথে এগুনো শুরু করে।
ইতিহাসবিদ রয় মিলার তার বই ‘ফ্রম ডেজার্ট কিংডম টু গ্লোবাল পাওয়ার্স : দি রাইজ অব গালফ স্টেটস’ বইতে লিখেছেন, এই সব দেশগুলোর অভাবনীয় অর্থনৈতিক সাফল্যের পেছনে প্রধানত যে বিষয়গুলো কাজ করেছে তা হলো- তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষমতাধর অংশগুলোর মধ্যে তেল থেকে অর্জিত আয় সাফল্যের সাথে বণ্টন করতে পেরেছে এবং উদ্বৃত্ত্ব আয়কে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সম্পত্তি বা স্টকের মত গুরুত্বপূর্ণ সম্পদে বিনিয়োগ করেছে।
উপসাগরের অন্য দেশগুলোর তুলনায়, ইউএই এই সাফল্য পেয়েছে অপেক্ষাকৃত কম সময়ে এবং তাদের সাফল্যের মাত্রাও অপেক্ষাকৃত বেশি। তাদের জনপ্রতি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাত্রা ওই অঞ্চলে এক নম্বরে।
তবে ইউএইর অন্তর্গত সাতটি আমিরাতের সবগুলোর তেল সম্পদ একই মাত্রার নয়। আর এ কারণেই বাকি আর পাঁচ আমিরাতের তুলনায় আবুধাবি এবং দুবাই উন্নয়নের মাপকাঠিতে বাকিদের চেয়ে অনেক এগিয়ে এবং তারাই ইউএইর জাতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ডে পরিণত হয়েছে।
স্বায়ত্ত্বশাসনের কারণে একেকটি আমিরাত তাদের উন্নয়নের কৌশলে একেকটি বিষয়কে অন্যদের চেয়ে অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছে। যেমন, কয়েকটি আমিরাত পর্যটনের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছে, অন্যরা মনোনিবেশ করেছে বিদেশি পুঁজি টানার দিকে।
এভাবেই ১৯৮৫ সালে বিদেশী বিনিয়োগ টানার জন্য দুবাইতে তৈরি করা হয় জেবেল আলি মুক্ত অর্থনৈতিক জোন। প্রায় ৪০ বছর পরও এটিই এখনো বিশ্বের বৃহত্তম মুক্ত অর্থনৈতিক জোন। দুবাইতে এখন ৩০টিরও বেশি মুক্ত অর্থনৈতিক জোন বা এলাকা হয়েছে যেখানে বিদেশী বিনিয়োগকে কর এবং শুল্ক ছাড়সহ নানারকম সুবিধা দেয়া হয়।
জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান টার্গেট নিয়েছিলেন বিংশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ অর্থাৎ ২০০০ সালের মধ্যে তিনি তার নতুন দেশকে বিশ্বের মানচিত্রে স্থাপন করবেন। তবে সন্দেহ নেই নতুন শতাব্দীতে দেশকে শক্ত পায়ে দাঁড় করিয়েছেন তার দুই ছেলে - শেখ খালিফা এবং তার সৎ ভাই শেখ মোহামেদ।
নতুন শতাব্দী
নতুন শতাব্দীতে ইউএইর নতুন প্রেসিডেন্ট হিসাবে শেখ খালিফার সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসাবে হাজির হয় ২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক সঙ্কট। বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক কেন্দ্র দুবাইকে ওই সঙ্কট দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে শেখ খালিফা দুবাইকে জরুরি তহবিল থেকে শত শত কোটি ডলার দেন। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবন বুর্জ দুবাইয়ের নাম পাল্টে করা হয় বুর্জ খালিফা।
শেখ খালিফা তেল সম্পদে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক এবং অ্যাকাডেমিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে আসেন, যা বিশ্বে ইউএই'র ভাবমূর্তি অনেক উঁচুতে নিয়ে যায়।
বিশ্বের দেশে দেশে আমিরাতের সরকারি এবং বেসরকারি পুঁজি বিনিয়োগ হয়েছে বড় বড় কোম্পানিতে, উঁচু মূল্যের রিয়েল স্টেটে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে, অভিজাত ব্র্যান্ডে এবং এমনকি ফুটবল ক্লাবে (যেমন, ম্যানচেস্টার সিটি)।
পশ্চিমা দেশগুলোতে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি খুবই দামী ভবন নির্মিত হয়েছে ইউএইর পয়সায়।
শেখ খালিফা তেলের ওপর অর্থনীতির নির্ভরতা কমাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির গবেষণার ওপর জোর দিয়েছিলেন। যদিও তারা তেল এবং গ্যাসের রফতানি আয় বাড়াতে ওই খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে চলেছে। কিন্তু গত বছর ইউএই ২০৫০ সালে মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসার ঘোষণা করেছে।
প্রভাব-প্রতিপত্তির ডানা
শেখ খালিফার মৃত্যুর পর যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, তা থেকে বিশ্বে ইউএইর প্রভাব-প্রতিপত্তির আঁচ পাওয়া যায়।
জানাজায় যুক্তরাষ্ট্র ভাইস প্রেসিডেন্ট কামালা হ্যারিসকে পাঠায়। অন্যদিকে, কিউবার মত দেশও সরকারি আদেশ জারি করে শোক পালন করেছে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে যে তিন নেতা ইউএই শাসন করেছেন, তারা সবাই তাদের দেশের প্রভাব-প্রতিপত্তির বলয় বাড়াতে সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছেন।
আবুধাবি ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম রাষ্ট্রীয় তহবিল যার অধীনে ৭০ হাজার কোটি ডলারের সম্পদ রয়েছে।
ভাইয়ের মৃত্যুর পর যিনি ক্ষমতা নিয়েছেন সেই মোহামেদ বিন জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ানকে দেখা হয় এমন একজন ব্যক্তি হিসাবে যিনি বিশ্ব জুড়ে, এমনকি প্রত্যন্ত ছোটো দেশগুলোতেও ইউএইর প্রভাব বিস্তারে সবরকম চেষ্টা করে চলেছেন।
ইউএই প্রথম কোনো সমসাময়িক আরব দেশ যারা এমনকি ইউরোপে পর্যন্ত সৈন্য পাঠিয়েছে। ১৯৯০ সালে নেটোর সমর্থনে লড়াই করতে কসোভোতে তারা সৈন্য পাঠায়। পরে বিশ্বের অন্যান্য জায়গাতেও সৈন্য পাঠিয়েছে ইউএই।
আফগানিস্তানে তারা নেটোর সমর্থনে সৈন্য পাঠায়। মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডকে ঘায়েল করতে সৈন্য পাঠায়, এরপর ২০১১ সালে লিবিয়ার গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে যুদ্ধবিমান পাঠায়। এখনো লিবিয়াতে সামরিক উপস্থিতি বজায় রেখেছে ছোট এই উপসাগরীয় দেশটি।
কয়েক বছর পর সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যোগ দেয় তারা।
একইসাথে, ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব তৈরির লক্ষ্যে তুরস্কের মত দেশের সাথেও টক্কর দেয়া শুরু করে ইইউএই। সোমালিয়া, সোমালি-ল্যান্ড, জিবুতি এবং সুদানের মত দেশেও তারা যুক্ত হয়।
তবে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সৌদি সমর্থিত জোটে যোগদানে মোহামেদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের সিদ্ধান্ত ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। আমিরাতের সৈন্যদের বিরুদ্ধে ইয়েমেনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বহু অভিযোগ ওঠে।
প্রতিবেশী কাতারের ওপর বিতর্কিত অবরোধ আরোপের ব্যাপারেও নেতৃত্ব দেন শেখ মোহামেদ।
ভূমধ্যসাগরের পূর্বে জাহাজ চলাচল এবং জ্বালানির মালিকানা নিয়ে তুরস্কের সাথে বিরোধে গ্রিস ও সাইপ্রাসের সমর্থক হিসাবে হাজির হয়েছে ইউএই।
সূত্র : বিবিসি