১৮ মে, ২০২৩
পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে মঙ্গলবার বাজি তৈরির কারখানায় বিস্ফোরণে নয়জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় কারখানার মালিককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তিনি নিজেও বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (১৮ মে) উড়িষ্যার এক হাসপাতাল থেকে গ্রেফতার করা হয় কৃষ্ণপদ ওরফে ভানু বাগ নামে ওই বাজি কারখানার মালিককে।
জাতীয় সন্ত্রাস দমন এজেন্সি এনআইএকে দিয়ে এ ঘটনার তদন্ত করার জন্য পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী যে মামলা করেছিলেন হাইকোর্টে, বৃহস্পতিবার সেটা খারিজ হয়ে গেছে। রাজ্য পুলিশের সিআইডি ইতোমধ্যেই বিস্ফোরণের তদন্ত শুরু করেছে। তবে আদালতের নির্দেশে ওই তদন্ত রিপোর্ট এনআইএ-কেও দিতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সিআইডি জানাচ্ছে বাগ উড়িষ্যার দিকে পালিয়ে গেছেন, এরকমটাই তারা খবর পেয়েছিলেন। তাই উড়িষ্যা পুলিশের যেমন সহায়তা চাওয়া হয়, তেমনই সাদা পোশাকের পুলিশ নিজেরাই উড়িষ্যার বিভিন্ন হাসপাতাল, নার্সিং হোমে ভানু বাগের ছবি দেখিয়ে খোঁজ চালাচ্ছিল।
বৃহস্পতিবার সকালে তারা কটকের একটি হাসপাতালে তার খোঁজ পায়। সেখানে তার ছেলে এবং ভাইপোরও চিকিৎসা হচ্ছিল। ভানু বাগের শরীরের অনেকটা অংশ পুড়ে গেছে। তাই তাদের গ্রেফতার করা হলেও এখনই তাকে হাসপাতাল থেকে পশ্চিমবঙ্গে নিয়ে আসা যাবে না বলেও সিআইডি জানিয়েছে।
‘কারো হাত, কারো পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল'
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার এগরার খাদিকুল গ্রামে মঙ্গলবার দুপুরে হঠাৎই প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ হয় একটি বাজি কারখানায়। ওই গ্রামের বাসিন্দা মনোরঞ্জন মাইতি বলেন, ‘ এমন বিকট আওয়াজ, না শুনলে বিশ্বাস করতে পারবেন না। বলে বোঝানো যাবে না আওয়াজের তীব্রতা। আমরা সবাই দৌড়ে যাই ভানু বাগের কারখানার দিকে। রাস্তায়, মাঠে, পুকুরে চারদিকে লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। যারা বেঁচে গিয়েছিল, তারা আর্তনাদ করছিল। কারো হাত, কারো পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। বারুদের গন্ধ আর লাশের পোড়ার গন্ধে টেকা যাচ্ছিল না ওখানে।
মাইতি বলেন,‘আমিই পুলিশকে ফোন করেছিলাম। যতক্ষণে পুলিশ আর দমকল এল, তখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ভানু বাগের কারখানা পুরোটাই উড়ে গেছে, তখনো আগুন জ্বলছে। দমকল আগুন নেভায়, তারপরে পুলিশ দেহগুলো এক এক করে উদ্ধার করে।’
ওই বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছিলেন পাশের গ্রামের বাসিন্দা ও বিজেপি কর্মী রামচন্দ্র আচার্য্যও। তার কথায়, ‘দুপুরবেলা বাড়িতেই ছিলাম আমি। এত বিকট আওয়াজ হল, বুঝতেই পারিনি কিসের আওয়াজ। প্রথমে মনে হচ্ছিল যেন প্লেন বা হেলিকপ্টার ভেঙে পড়ল না কি! তারপরেই তো খবর পেলাম ও ভানু বাগের কারখানায় বিস্ফোরণ হয়েছে।’
মাইতি বলেন, ‘এর আগে তিনবার ওর বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ হয়েছে। প্রথমবার ১৯৯৫ সালে, সেই বিস্ফোরণে দু‘জন মারা যায়, তারপরে ২০০০ সালে আরেকবার বিস্ফোরণ হয়। দ্বিতীয় বিস্ফোরণে ভানু বাগের নিজের ভাই এবং আরো দু‘জন মারা যান। তৃতীয়বার বোমা ফাটার সময়ে অবশ্য কেউ মারা যায়নি।’
মৃত ও আহতরা সকলেই স্থানীয় বাসিন্দা, অনেকেই নারী
নিহতদের মধ্যে রয়েছেন গ্রামের বাসিন্দা মঞ্জু রাণী পাত্রের দাদা এবং বৌদি। তিনি বলেন, ‘দাদা মাস দুয়েক ধরে ওই কারখানায় কাজ করতেন তবে তার বৌদি ছয় সাত বছর ধরে ওই ‘বোমা কারখানায়’ কাজ করতেন। এর আগে তিনবার বিস্ফোরণ হয়েছে, একবার তো ওর নিজের ভাইই মারা গেল।’
তিনি বলেন’ জ্ঞান হওয়া থেকে চার দশকেরও বেশি সময়ে ধরেই তিনি ভানু বাগের বাজি কারখানা দেখছেন।
ঘটনার পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন গত বছর অক্টোবর মাসে একবার গ্রেফতার হয়েছিলেন ভানু বাগ।
মমতা ব্যানার্জি সংবাদ সম্মেলনে বলেন ‘পুলিশ তাকে বেআইনি বাজি কারখানা চালানোর জন্য গত বছর একবার গ্রেফতার করেছিল, তার বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশীটও দেয় পুলিশ। কিন্তু তিনি কোর্ট থেকে জামিন পেয়ে যান। পুলিশ আমাকে যা জানিয়েছে, তা হল এই ভদ্রলোক উড়িষ্যায় প্রচুর বাজি সরবরাহ করতেন আবার নাকি বাংলাদেশেও বাজি পাঠাতেন।’
তিনি এই প্রশ্নও তোলেন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে একটা বেআইনি বাজি কারখানা চলছে, সেটা স্থানীয় থানা কেন জানত না?
এগরা থানার ওসিকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেয়া হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী ঘটনার পরেই সিআইডিকে তদন্ত ভার দেন। তিনি এও বলেন জাতীয় সন্ত্রাস দমন এজেন্সি এনআইএ তদন্তেও তার আপত্তি নেই।
স্থানীয় মানুষ বলছেন বেআইনি বাজি কারখানার মালিক ভানু বাগ একসময়ে বামফ্রন্টে ছিলেন, তারপরে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে তিনি সেই দলে চলে যান। একবার পঞ্চায়েতের নির্বাচিত সদস্যও হয়েছিলেন। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তার পুত্রবধূ তৃণমূলের হয়েই ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন।
গ্রামবাসীদের কেউ কেউ বলেছেন তিনি কিছুদিন আগে আবারো দল বদল করে বিজেপির দিকে ঝুঁকেছিলেন। আবার পুলিশের সাথে তার যোগসাজস ছিল বলেও অভিযোগ করছেন গ্রামের বাসিন্দাদের একাংশ।
ঝুঁকি স্বত্বেও কেন বাজি কারখানায় কাজে যেতেন গ্রামের মানুষ?
যে কাজ বিপজ্জনক, আগেও বিস্ফোরণে প্রাণহানি হয়েছে, তা সত্ত্বেও গ্রামের মানুষ সময় মতো মজুরি পাওয়ার আশাতেই কাজ করতেন ভানু বাগের কারখানায় বলছিলেন মনোরঞ্জন মাইতি।
মাইতি বলেন,‘ও ঠিকমতো দিনের দিন মজুরিটা দিয়ে দিত, টাকাও বেশি পেত, প্রায় ৩০০ টাকা রোজ। তাই মানুষ কাজে যেত ওর কারখানায়।’
আবার তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে বৃহস্পতিবার টুইট করে অভিযোগ তোলা হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার ‘মহাত্মা গান্ধী গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্প’, যেটির চালু নাম ‘একশো দিনের কাজ’, সেই প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দ দীর্ঘদিন আটকে রেখেছে। তাই গ্রামের মানুষ বাধ্য হয়ে বিপদ জেনেও ওই বাজি কারখানায় কাজ করতে যেতেন।
তারা ইংরেজি সংবাদপত্র দ্য টেলিগ্রাফে প্রকাশিত একটি খবরও তাদের টুইটে জুড়ে দিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে ‘একশো দিনের কাজ’ পাননি গ্রামের মানুষ, আবার কাজ করা সত্ত্বেও মজুরি আটকে আছে।
তাই খাদিকুল গ্রামের মানুষ বাধ্য হতেন ভানু বাগের কারখানায় কাজ করতে।
প্রতিবেদনটিতে অম্বিকা মাইতি এবং মাধবী বাগ নামে দুজন নারীর কথা লেখা হয়েছে, যারা মঙ্গলবারের বিস্ফোরণে মারা গেছেন। তাদের পরিবারকে উদ্ধৃত করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে একশো দিনের কাজ করেও টাকা পান নি, আর নতুন করে কাজও বন্ধ হয়ে আছে। পরিবার চালানোর জন্যই কয়েক মাস আগে থেকে বেআইনি কারখানায় কাজ করতে যাচ্ছিলেন বিস্ফোরণে মৃত দুই নারী, এমনটাই বলেছেন তাদের স্বামীরা।
স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যকে উদ্ধৃত করে ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে বেআইনি বাজি কারখানার মালিক ভানু বাগ আগে নাকি মালদা, মুর্শিদাবাদ থেকেই শ্রমিক নিয়ে আসতেন। কিন্তু ‘একশো দিনের কাজ’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে স্থানীয় গ্রামবাসীরাই তাকে তার কারখানায় কাজ দেয়ার অনুরোধ করতে থাকেন। স্থানীয়দের দিয়ে কাজ করালে তার সাশ্রয়ও হত।
তৃণমূল কংগ্রেস দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে পশ্চিমবঙ্গের প্রাপ্য অর্থ বরাদ্দ আটকে রেখেছে কেন্দ্রীয় সরকার।
অন্যদিকে বিজেপি বলে ‘একশো দিনের কাজ’-এ ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে, বহু ভুয়া মজদুরের নাম তালিকায় তোলা হয়েছে আর তাদের নামে বরাদ্দ মজুরি স্থানীয় তৃণমূল নেতারা আত্মসাৎ করছেন। সেজন্যই বরাদ্দ আটকে রেখেছে কেন্দ্র সরকার।
সূত্র : বিবিসি