হাত ধোয়ার ইতিকথা

২১ মে, ২০২০

হাত ধোয়ার কথা যে বিজ্ঞানী প্রথম বলেছিলেন তাঁকে পাগলা গারদে পাঠিয়ে পিটিয়ে মারা হয়েছিল।

টিভিতে প্রতি আধ ঘন্টা অন্তর অন্তর বিজ্ঞাপন দিয়ে দেখানো হচ্ছে, কুড়ি সেকেন্ড এর বিরতি দেওয়া হল, হাত ধুয়ে আসুন। কারণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) থেকে বাঁচার প্রথম উপায় হিসেবে হাত ধোয়ার উপর জোর দিতে বলেছে।

অথচ পৃথিবীর ইতিহাসে ভাইরাস থেকে বাঁচতে প্রথম যে ডাক্তার সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার কথা বলেছিলেন তাঁকে অন্য ডাক্তাররা পাগলা গারদে পাঠিয়ে সেখানকার গার্ড দিয়ে পিটিয়ে খুন করিয়েছিলেন।

সেটা ছিল ১৮৪০ সাল। জীবাণু ছড়ানোর বিষয়টি জানা ছিল না। হাত ধোয়ার প্রচলনটা ছিল কদাচিৎ। টয়লেট থেকে এসে, এমনকি ক্লিনিক্যাল প্রসিডিওর কিংবা অপারেশনের আগে ডাক্তাররাও হাত ধুতেন না। ডাক্তাররা মর্গ থেকে এসে যখন রোগী দেখতেন তখন মৃতদেহ থেকে ভয়ংকর পার্টিকল জীবিত রোগীদের মধ্যে সংক্রমিত হত এবং তাদের অপমৃত্যু ঘটত। হাঙ্গেরিয়ান চিকিৎসক ইগনাজ স্যামেল- ওয়াইজ প্রথম এ বিষয়ে নজর করেন। ১৮৪৭ সালে স্যামেলওয়াইজ পুরুষ গাইনি ডাক্তারদের নির্দেশ দেন প্রসূতি বিভাগে স্বাস্থ্যবতী মায়েদের পরীক্ষা করবার আগে হাত ধুতে হবে এবং তাদের ইনস্ট্রুমেন্ট- গুলি ক্লোরিনেটেড লাইম দিয়ে ধুতে হবে। এর ফল হল অবিশ্বাস্য। ওই বছর একজন রোগীরও মৃত্যু হল না।

স্যামেলওয়াইজ এরপর হাত ধোয়ার উপকারিতা নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। কিন্তু তাঁর সহকারীরা তাঁর বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করলেন, কারণ তাদের মনে হল ডা. স্যামেল- ওয়াইজ তত্ত্ব বলতে চায় তারাই, অর্থাৎ চিকিৎসকরাই রোগীর মৃত্যুর জন্য দায়ী। ভিয়েনা হাসপাতালে মৃত্যুহার কমলেও, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও হাত ধোয়ার তত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করল। উদ্বিগ্ন স্যামেলওয়াইজ হাঙ্গেরিতে ফিরে ১৮৬১ সালে নিজের কাজ প্রকাশ করলেন, কিন্তু কোনও লাভ হল না। সায়েন্টিফিক সোসাইটির লোকজন তখনও বিশ্বাস করত রোগ বালাই হয় খারাপ আত্মার মাধ্যমে।

স্যামেলওয়াইজ মরিয়া হয়ে সকল গাইনি ডাক্তারদের চিঠি লিখতে শুরু করেছিলেন যেন তারা হাত ধুয়ে, ইনস্ট্রুমেন্টস ধুয়ে কাজ করেন। এতে জীবন বাঁচবে। তখন সব ডাক্তাররা তাঁকে ‘পাগল’ আখ্যা দেন। আস্তে আস্তে তিনিও ডিপ্রেশনে চলে যান। সবাই তাকে পাগল মনে করছিল। ১৮৬৫ সালে নার্ভাস ব্রেকডাউনের পর স্যামেলওয়াইজকে দেওয়া হলো ‘মেন্টাল এসাইলামে’। কেউ বললো তাঁর ‘নিউরো সিফিলিস’ হয়েছে, কেউ বলল, ‘বদ আত্মা’ ভর করেছে। মাত্র ১৪ দিন পর, মেন্টাল এসাইলামের গার্ডরা তাঁকে প্রচন্ড পেটাল। পেটানোর ফলে তাঁর হাতে-শরীরে ক্ষত থেকে ডান হাতে গ্যানগ্রিন হয়। রক্তের বিষক্রিয়ায় মাত্র ৪৭ বছর বয়সে ১৩ আগস্ট, ১৮৬৫ সালে মারা যান এই যুগান্ত সৃষ্টিকারী চিকিৎসক। ইগনাজ স্যামেলওয়াইজের কাজ লুই পাস্তুরের জীবাণু তত্ত্বের অন্যতম ভিত্তি। তার কাজ ও ব্যাখ্যা লুই পাস্তুরকে প্রচুর সাহায্য করেছিল। অথচ তাঁর শ্রাদ্ধে কোনও ডাক্তার এলেন না। এমনকি তাঁর মৃত্যুর খবর ‘হাংগেরিয়ান মেডিক্যাল সোসাইটি’ প্রকাশও করেনি তাদের পেপারে।

জীবাণু তত্ত্ব, অর্থাৎ রোগের উৎপত্তি জীবাণু থেকে হতে পারে আবিষ্কারের অনেক বছর পর তাঁর স্বীকৃতি মেলে।

হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে তাঁর অনেক বড় স্তম্ভও গড়া হয়েছে।

(সংগৃহীত)